পাহাড় ঝরণার পথে পথে…

আসিফ মাহবুব
Published : 2 Jan 2017, 03:19 PM
Updated : 2 Jan 2017, 03:19 PM

ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, টিটোরিয়াল, পরীক্ষা খুব যেন যান্ত্রিক করে তুলছে জীবনটাকে। তার উপর ক্যম্পাসে সাংবাদিকতার দায়িত্ব। সবমিলিয়ে ব্যাস্ত জীবন। তাই কাজের গতিশীলতার জন্য প্রয়োজন আনন্দ। আর সে আনন্দের খোড়াক যোগাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি তিন দিনের জন্য প্রকৃতির স্বর্গরাজ্যে ঘুরে আসার আয়োজন করলো।

সবার মতামতে স্থান ঠিক হলো খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি। কিন্তু যাওয়ার দিনটিতেও সাংবাদিকতা যেন আমাদের পিছু ছাড়লোনা। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করেছে। তাড়াহুড়া করে নিউজটি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশের প্রাঙ্গণে দাড়িয়ে থাকা বাসটিতে উঠলাম সবাই। ক্যাম্পাসের বাস কলাবাগান গিয়ে থামলো। সেখান থেকে শান্তি পরিবহণে করে রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ির পথে যাত্রা শুরু।

আমারা যারা জুনিয়র ছিলাম তাদের বসতে হলো পিছনের সিটগুলোতে। তাই রাস্তার সবগুলো উঁচু নিচু স্থান আমাদের স্বাগত জানিয়েছে বেশ করে। যার জন্য আমারা ঘুমাতে পারিনাই পুরো রাতে। কুমিল্লায় পৌঁছে রাত ৩ টায় বাস দিলো যাত্রা বিরতি। সেখানে হাতমুখ ধুয়ে হালকা চা নাস্তা খেয়ে আবার গাড়ির চাকা ঘুরা শুরু।

ঘুরতে ঘুরতে সকলে গিয়ে পৌঁছলাম খাগড়াছড়ির স্বর্গরাজ্যে। তখন কুয়াশাচ্ছান্ন আকাশ। সূর্যিমামাও দেখা দেয়নি তখনো। সে সময় আমাদের বাস চলছে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। সবুজ অরণ্যে ভরা উঁচু উঁচু পাহাড়, তার মাঝে কোথাও কোথাও আবার অনেক নীচু। তা দেখে চক্ষু শিতল হয়ে আসছে। সাড়া রাতের না ঘুমানো যন্ত্রণা যেন নিমিষে কেটে গেল।

প্রথম দিনের পরিকল্পনা মত সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভাড়া করলাম ছান্দের গাড়ি খ্যাত এক ধরনের গাড়ি। উঠে পড়লাম সবাই। কেউ ছাদে কেউবা ভিতরের সিটে বসা। প্রথমে সাহস করতে পারছিলাম না ছাদে উঠার। পরে ছাদে উঠে আর নামতে চায়নি, অপরূপ দৃশ্য গুলো দেখে। যদিও মাঝে মাঝে আঁকা-বাকাঁ, উচু-নীচু রাস্তায় চলতে গিয়ে বেশ ভয় লেগেছিল। তবে আবার যখন প্রকৃতির সে দৃশ্যের মাঝে হারিয়ে যেতাম, তখন তা আর মনেই থাকতো না। চলছে গাড়ি।


এবার সবার কন্ঠে যেন প্রতিভা জেগে উঠলো। গান না গাইতে পারলেও গলা খুলে গান গাচ্ছে নিজের মত করে। হঠাৎ পথে যাত্র বিরতি। কারণ সেখানে একটি ঝর্ণা আছে। নাম হাজাছড়া ঝর্ণা।


বেশ খানিকটা চিকচিকে পানি পার হয়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। ছবি, সেলফি আর ঝর্ণার পানিতে এক মনমুগ্ধকর সময় কাটাচ্ছিলাম। ঠিক তখন রাহাত ভাই বললো আর থাকা যাবেনা। কারণ সাজেক ভ্যালীর পথে রওনা দিতে হবে এখনই। অবশেষে উঁচু-নীচু পাহাড়, আকাঁ বাকাঁ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্যালীতে। সাজেকের পুরোটাই পাহাড়ে মোড়ানো এক মন মাতানো পথ।


প্রকৃতির এই রূপ যেন রাঙ্গামাটির ছাদ! নয়নাভিরাম অরণ্যভূমি আর পাহাড়ের বন্ধনে যেখানে মেঘের দল প্রেমে মেতে আছে । পৃথিবীর এ যেন এক মনোরম ভূ-স্বর্গ। চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। সমতল থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উচুঁ পাহাড়ের মুক্ত আকাশের নিচে বিশাল সমৃদ্ধ বনভূমির সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়েছে কেবল সাজেক ভ্যালিতে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জুম চাষ, পাহাড়িদের কষ্টের জীবন দেখে সত্যিই বিবেক নাড়া দিয়েছে।

ঘুরে ঘুরে এসব দেখছি আর পাহাড়ারের পথে পথে হাঁটছি। এসব করতে করতে দুপুর নেমে বিকাল হওয়ার পথে। খেতে হবে। তাই নেমে আসলাম পাহাড় থেকে। আদিবাসীদের হাতের রান্না করা খাবারে সেড়ে নিলাম দুপুরের খাওয়া। তারপর আরেকটু ঘুরলাম। ফিরার সময় হয়েছে এবার। কারন সাজেক থেকে ৪টার পর কাউকে বের হতে দেওয়া হয়না।


আবার ছান্দের গাড়িতে উঠে খাগড়াছড়ি শহরে এসে পৌঁছলাম। রাতে পুরো খাগড়াছড়ি শহড় ঘুরে দেখলাম। রাতের খাওয়া শেষে ক্লান্ত শরীলে নিমিষে ঘুম চলে আসলো। পরেরদিন সকালে উঠে নাস্তা সেরে এবার রওনা দিলাম রিছিং ঝর্ণার পথে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে বেশ খানিকটা পথ দূরে রিছিং ঝর্ণা।


পাহাড়েরের উঁচু নীচু পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম সেখানে। আমার দেখা এক অনণ্য সুন্দর ঝর্ণা এটি। এ ঝর্ণার পানিতে গোসল করলাম সবাই। তবে জায়গাটা বেশ ঢালু। তাই সাবধান করতে হবে। আর সেখান থেকে পিচ্ছিল খেয়ে নিচে নামা যায়। বেশ সুন্দর ও আনন্দ লাগে সে নিচে নামার দৃশ্য। সে আনন্দটা আমাদের মোটামুটি সবাই লুফে নিয়েছে।


যারাই এ ঝর্ণায় যাবেন এ অনন্দটা লুফে নিতে ভুলবেন না। যদিও তা করতে গেলে আপনার প্যান্টটা ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে ৯৫ ভাগ। এখান থেকে গোসল শেষ করে আলুটিলার পথে রওনা দিলাম। সেখানে গিয়ে ঢুকার মুখেই চোখে পড়লো বিশাল এক বট গাছ।


বট গাছে আলুটিলা বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের বাণী লেখা। এক পাশে টিকিট কাউন্টার। কাউন্টার থেকে টিকেট কাটার পর হাতে ধরিয়ে দিল মশাল। তা নিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছি আলু-টিলার গুহার মুখে। গুহার সম্মুখে অনেক পাথর খন্ড পড়ে আছে। বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক এ গুহাটি প্রায় ১০০ মিটার-এর মতো লম্বা। এর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। এবার আমরা আমাদের মশাল জ্বালালাম। কারণ গুহার ভিতর গাঢ় অন্ধকার।


পায়ের নিচে পিচ্ছল পাথরের খণ্ড। তার ভিতর দিয়ে চিকচিকে পানি বয়ে যাচ্ছে কুল কুল করে। চোখে কিছু দেখছিলাম না। মশালের আলোয় সামনের অন্ধকার ঠেলে আমরা সবাই আস্তে আস্তে আগাচ্ছি। মাঝে মধ্য গুহার দেয়ালে হাত রেখে ব্যালেন্স নিতে হচ্ছে। এভাবে মিনিট বিশ যাওয়ার পর আমারা শেষ করলাম আলু টিলার অভিজান। সবমিলিয়ে আলুটিলা অভিজান ছিল এক স্বরণীয় মূহুর্ত। সেখান থেকে বের হয়ে, কিছু দূর পথ গিয়ে, প্রায় দুহাজার সিড়ি বেয়ে গেলাম দেবতার পুকুরে। চারদিকে পাহাড় আর মাঝখানে পুকুর তা দেখে সত্যিই অবাক হয়েছে। তারপর রাঙ্গামটির পথে যাত্রা শুরু। রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউজে আমারদের থাকার ব্যাবস্থা হলো। সেখানে জিনিস পত্র রেখে পুরো রাঙ্গামটি শহরে ঘুরলাম। স্থানীয় কিছু জিনিসপত্র কেনাকাটা করলো সবাই।


রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুম। সকালে উঠে কাঁপ্তাই লেক দেখার জন্য যাত্রা শুরু। এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় এ লেকটিতে ঢুকার আগে চোখে পড়লো একটি পার্ক। সেখানে কিছু ছবি তুলে উঠে পড়লাম নৌকায়। তারপর চলতে শুরু করলো দিগন্ত যেন যার শেষ নেই সে লেকের পানিতে। লেকের দুপাশে অসংখ্য উঁচু নিঁচু পাহাড়। মাঝখানে পানির থৈথৈ, তার মাঝ দিয়ে চলছে আমাদের নৌকা। পানির কলতান আর নৌকার আওয়াজে নাচতে শুরু করলো মাহী ও হীরা ভাই। পরে তাদের সাথে যুক্ত হলো রাহাত ভাই সহ বাকিরা। তারপর নৌকা গিয়ে থামলো সুবলং ঝর্ণার কাছে।


তারপর বৌদ্ধ মন্দিরের পাহাড় সহ আরো অনেক পাহাড় ঘুরলাম। এবার দেখার পালা ঝুলন্ত ব্রিজ। দুপাশে দুটি পাহাড় মাঝখানের পানিতে ব্রিজটি ঝুলছে। ব্রিজের এক পাশের পাহাড়ের উপর রয়েছে শিশুদের জন্য দোলনা, স্প্রিং সহ অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থা। সেখানে ছবি, সেলফি আর কিছু কেনাকাটা করে শেষ হলো আমাদের ভ্রমণ। এ ভ্রমণে সুজন ভাইয়ের ভিডিও করা, আর পোঁকা মাকড়ের ছবি তুলা নিয়ে সকলের কাছে বেশ আলোচিত। আর প্লাবন ভাইয়ের 'টোটালি আন এসপেক্টেড' ডায়লগটি ভ্রমনে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। হিরা ভাইয়ের খাওয়া দাওয়া আর ছবি তোলা ভ্রমনে জুগিয়েছে হাসির খোড়াক। হিমেল ভাইয়ের গাড় বাকা করে ছবি তুলার স্টাইল নিয়ে কম কথা হয়নি। সব মিলিয়ে ভ্রমনটা ছিল সত্যিই মনমুগ্ধ কর।