নোংরা রাজনীতির কাছে জিম্মি পদ্মা সেতু

মাহবুবুল আলম
Published : 8 Sept 2012, 08:26 AM
Updated : 8 Sept 2012, 08:26 AM

এ শিরোনামটি আমার নিজের নয় এটি দৈনিক জনকন্ঠে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে ধার করা। পদ্ম সেতু নিয়ে যে নোংরা রাজনীতি হচ্ছে এমনই একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ম্যাগাজিন 'দ্য ইকোনমিস্ট'-এ। সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে দৈনিক জনকণ্ঠ উপরোক্ত শিরোনামের সংবাদটি পরিবেশন করে। 'বাংলাদেশ ট্রাবল্ড ওয়াটার্স' শিরোনামে 'দ্য ইকোনমিস্ট' এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। সংবাদ প্রতিবেদনটিতে বলা হয় 'দেশীয় নোংরা রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে পদ্মা সেতু' । বিদেশী দাতা গোষ্ঠীর সহায়তার প্রতিশ্রুত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এটি অবকাঠামোগত সবচেয়ে বড় প্রকল্প। সেই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়,…'৩শ' কোটি ডলারের এই সেতুটি গঙ্গার শাখা নদী হিসিবে পরিচিত পদ্ম নদীর ওপর নির্মিত হওয়ার কথা। কিন্তু দেশের দারিদ্র্যপীড়িত দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রায় তিন কোটি জনগোষ্ঠীকে দেশের বাকি অংশের সাথে যুক্ত করাই ছিল এই সেতু নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য। প্রস্তাবিত ৩.৮ মাইলের এ সেতুটি ভারতে ঢোকার প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশের এ বিরাট অংশকে এই সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের অবদান রাখত।

আমরা সবাই জানি, পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকার ভিত্তিক একটি প্রকল্প। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে পদ্মাসেতু নির্মাণে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই সেতু তৈরীর জন্য সরকার বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবির সঙ্গে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই ২৯০ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০ কোটি ডলার বিশ্বব্যাংকের, এডিবি, জাইকা ও আইডিবির ১৫০ কোটি ডলার বাকি ৫৫ কোটি ডলার সরকারের নিজস্ব উৎস থেকে আহরণের কথা। সরকার জমি অধিগ্রহণ বিরোধ, অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ পরিশোধসহ প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণের ১০০ কোটি টাকার কাজ প্রায় সম্পন্ন করে ফেলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকেই। কিন্তু হঠাৎ করেই বিশ্বব্যাংক নির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়া পদ্মাসেতু প্রকল্পে বায়বীয় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋণ মঞ্জুর স্থগিত করে দেয়। বিশ্ব ব্যাংকের পাশাপাশি এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও অর্থছাড় স্থগিত রাখে। ফলে পদ্মাসেতু তৈরী নিয়ে সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তার। সরকারও সেতু তৈরীর দৃঢ় অঙ্গিকার নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে পদ্মাসেতু নির্মাণ চুক্তি স্থগিত প্রশ্নে একটি দেশবিরোধী চক্রের তৎপরতার কথা প্রকাশ হতে থাকে, যে চক্রের ইন্ধনদাতা বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকার। গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যাবস্থাপনা পরিচালক নোবেল লরিয়েট ড. মুহম্মদ ইউনুছ এ চক্রের হোতা হিসাবে সব কলকাঠি নেড়ে এ ঋণচুক্তি স্থগিত রেখেছে। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় যখন বিশ্বব্যাংক ঋণের টাকা ছাড়ের সাথে ড. ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে পুনঃনিয়োগের শর্ত জুড়ে দেয়। এ শর্ত জুড়ে দেয়ার পর দেশের মানুষের কাছে আরো স্পষ্ট হয় কা'দের লবিংয়ের কারণে বিশ্বব্যাংক দুর্নিতির অভিযোগে ঋণচুক্তি বতিল করেছে।

দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুরু থেকেই বলে আসছিলেন যে, সরকার বিরোধী শক্তি কিছুতেই চায় না, বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের হাতে এত বড় একটি অবকাঠামো নির্মিত হোক। কেননা, এর সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটি মানুষের ভোটের রাজনীতির হিসেব-নিকেষ জড়িত। অনেক আগে থেকেই এসব অঞ্চলে ভোটের রাজনীতিতে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও তাদের প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলাম এগিয়ে ছিল। তাই তারা বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে মনগড়া দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এ প্রকল্পে বাঁধার সৃষ্টি করে। বিদেশী লবিস্টের পাশাপাশি কাজে লাগায় বিএনপির মিত্র বলে পরিচিত ড. মুহম্মদ ইউনূসকে। এর আগেই গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু নিয়ে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারের সাথে ড. ইউনূসের প্রতিশোধ পরায়নতা কাজ করছিল। পশ্চিমা বিশ্বে ড. ইউনূসের লবিং সবচেয়ে কার্যকরী হয়। এবং সুপার পাওয়ার আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক বায়বীয় দুর্নীতির অভিযোগ তোলে ঋণচুক্তি বাতিল করে।
এটাকেই 'দ্য ইকোনমিস্ট' নোংরা রাজনীতি হিসেবে অভিহিত করে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। কেননা পদ্মা সেতু নির্মিত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে প্রাণের সঞ্চার হতো এর মাধ্যমে দেশের জিডিপিতে ১.২ ভাগ অবদান রাখা সম্ভব হতো। লাভবান হতো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অবহেলিত দারিদ্র্যপীড়িত ৩ কোটি মানুষ। কিন্তু দেশের নোংরা রাজনীতির বলি হলো বাংলাদেশেরে মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এটা এখন প্রায় নিশ্চিত যে, বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আমলে স্বপ্নের সেতুটি নির্মান হলো না। তাই আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের প্রশ্ন এমন নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে আমাদের আর কত স্বপ্নের অপমৃত্যু হবে এভাবে?
সর্বশেষ: এ সংক্রান্ত একটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে দৈনিক জনকন্ঠের ১০/০৯/২০১২ তারিখের পত্রিকায়। প্রশ্ন ছিল'পদ্ম সেতু প্রকল্প বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে-যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ইকোনিমিস্টের এমন মন্তব্যের সঙ্গে আপনি কি একমত? উত্তরে মন্তব্যের পক্ষে হ্যা বলেছে ৯৫% না বলেছে ৫% মন্তব্যদাতা ছিল ২০১১০ জন।