আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষও দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল

মাহবুবুল আলম
Published : 9 Nov 2012, 05:17 PM
Updated : 9 Nov 2012, 05:17 PM

সদ্য সমাপ্ত বিশ্বের সব'চে ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বেসরকারী ফলাফলে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী বারাক ওবামা ৩০৩ ইলেক্টোরেল কলেজ ভোটে জয়লাভ করে দ্বিতীয়বারের মতো সুপার পাওয়ার আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর একমাত্র প্রতিদ্ধন্ধি রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রোমনিকে স্পষ্ট ব্যবধানে হারিয়ে আবারো হোয়াইট হাউজের চাবি করায়ত্ব করলেন বারাক ওবামা। প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচন ছাড়াও সিনেট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট ও প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু প্রেসিডেন্ট ফর্ম অব গভর্নমেন্ট সেহেতু প্রেসিডেন্ট পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণ ভোটে দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। এ লড়াইয়ে ওবামা ৫০% আর মিটি রোমনি পেয়েছেন ৪৮% ভাগ ভোট। কিন্তু ইলেক্টোরেল কলেজ ভোটে বারাক ওবামা মিট রোমনিকে বিশাল ব্যবধানে অর্থাৎ ৯৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যেখানে ২৭০ ইলেক্টোরেল কলেজ ভোটের দরকার সেখানে ওবামা পেয়েছেন ৩০৩ ভোট। প্রয়োজনের চেয়েও ৩৩ ভোট তিনি বেশি পেয়েছেন। তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ফ্লোরিডার ২৯ ভোটের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই ২৯টি ভোটের সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে ওবামা যে আরো বড় ব্যবধানে জয়ী হবেন তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ওবামার এ বড় ব্যবধানে জয়ের ব্যাপারে কারা বেশি অবদান রেখেছে এ প্রসঙ্গে 'সিএনএন' বলেছে, বারাক ওবামার এ বিজয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে সংখ্যালঘু নারী, উদারপন্থী ভোটার ও তরুণ প্রজন্ম এবং স্যুয়িং বা দোদুল্যমান ভোটারদের অবদান সবচেয়ে বেশি।

বিশ্বের সবচেয়ে এ ব্যয়বহুল নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রেরই জয় হলো, জয় হলো গণতন্ত্রপ্রিয় শান্তিকামী মানুষের। এমনিতেই বিশ্ব অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন থেকে ঝেঁকে বসে আছে চরম অর্থনৈতিক মন্দা; যার ঢেউ সারা বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসে আছড়ে পড়ে সেসব দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে টালমাটাল করে দিচ্ছে। এরমধ্যে যদি আবার যুদ্ধ-বিগ্রহ, অস্থিরতা ও দেশে দেশে অশান্তি বিরাজ করে তবে তার পরিনতি যে আরো খারাপ হবে এ নিয়ে উৎকন্ঠিত ছিল বিশ্ববাসী।

যাক, এসব ভারি ভারি বিষয় নিয়ে আমার এ আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য হলো সাতসমুদ্র তের নদীর ওপারের সেই আমেরিকার প্রেসিন্ডিন্ট নির্বাচনের দিকে যেমন সারা বিশ্বের নজর ও পর্যবেক্ষণ ছিল, তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের নজরটা একটু যেন বেশিই ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের উপর। এই নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তাদের কর্মী সমর্থক ও সাধারণ মানুষ ছিল একেবারে দুই শিবিরে বিভক্ত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও উদার এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও এর কর্মী সমর্থক ও সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি আর কিছু ডানপন্থী ও উগ্রডানপন্থী, মৌলবাদী ইসলামী জঙ্গিদল ও তাদের সমর্থকদের সমর্থন ছিল রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রোমনির প্রতি। তবে সমর্থনের পাল্লাটা বেশ ভারী ছিল ওবামারই। এর প্রমাণ ও মিলেছে, আমেরিকান দূতাবাসে আয়োজিত ডামি বা নমুনা ভোটের আয়োজনে ওবামা দুইশতের অধিক ভোট পেয়েছেন আর রোমনি পেয়েছেন ত্রিশেরও কম ভোট। এই নমুনা বা ডামি ভোটে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা ও এলিট শ্রেণীর প্রতিনিধি ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ অনেকেই।

আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ কেন দুই শিবিরে বিভক্ত হবে এর সরল সমীকরণ ও শান-এ-নজুলটিও কিন্তু আমেরিকাকে নিয়ে আমাদের দেশের দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতি বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাথে জড়িত। কেননা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তখনকার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি বিরোধিতা করে পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষ অবলম্বন করেই ক্ষান্ত থাকেনি; বাঙালি নিধনে অস্ত্র-গোলা বারুদসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। বিপরীত দিকে ডেসমাক্র্যাট পার্টি ও সেদেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। সেই থেকে রিপাবলিকান পার্টির সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও উদারপন্থী রাজনীতিক এবং সাধারণ মানুষের সাথে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয় যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশ যাতে স্বালম্বি হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে সে জন্যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত অর্থসাহায্য ও পিএল-৪৮০ অধীনে খাদ্য সাহর্য বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই কারণেই কৃত্তিম খাদ্যসংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে মানুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ঠ ও এঁকে যাতে আমেরিকা বলয়ের কোন দেশ স্বীকৃতি না দেয় তারও কম চেষ্টা করেনি নিক্সন ওহেনরি কিসিঞ্জার। তাছাড়া কিসিঞ্জার বাংলাদেশেকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে অপপ্রচার চালিয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে কেবলমাত্র পাকিস্তানের পরাজয় ছিল না, এ পরাজয় ছিল পাকিস্তানের কট্টর সমর্থক নিক্স প্রশাসনেরও। তাই এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ১৯৭৫ সালে চরম উগ্রপন্থীদের সৃষ্ট অরাজগতা এবং বিভিন্ন নাশকতায় ইন্দন দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করতে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মাধ্যমে সব ধরনের সাহায্য করেছিল নিক্সন প্রশাসন। সেই কারণেই রিপাবলিকান পার্টিকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও প্রগতিশীল উদারপন্থী মানুষ সুনজরে না দেখার প্রধান কারণ।

এছাড়াও রিপাবলিকানরা যুদ্ধবাজ, সন্ত্রাস, ইহুদীবাদ লালনকারী হিসেবে সারা বিশ্বেই পরিচিত। আফগানিস্তানে সোভিয়েট দখলদারিত্বকে কেন্দ্র করে সে দেশের মুজাজিদদের সাহায্য করতে যেতেই আল-কায়দা জঙ্গিসংগঠন ও ওসামা বিন লাদেন নামক বিশ্বসেরা জঙ্গি সৃষ্টি করে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়েছিল। তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশের মদদপুষ্ট হয়ে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল ফিলিস্তিন ও গাজায় হত্যাযজ্ঞের ও যুদ্ধের মাধ্যমে অশান্তি সৃষ্টি করেছিল । এছাড়াও রিপাবলিকান সরকার ও প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য তথা ইরাক-ইরানের মধ্যে উপসাগরীয় যুদ্ধ বাঁধিয়ে আট বৎসর যাবত সেখানে তাদের অস্ত্রবিক্রির বাজার সৃষ্টি করার পাশাপাশি তেল সম্পদকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল।

যে সাদ্দাম হোসেনকে ধ্বংস করার জন্য এত তোড়জোর ও রক্তকক্ষয় হলো সেই সাদ্দাম হোসেন ছিল রিপাবলিকান প্রশাসনেরই সৃষ্টি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করায় আমাদের দেশের দেশের কিছু ডান ও অতিডান উগ্র মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠী এবং এদেশের পাকিস্তানবাদী রাজনৈতিক দল এদের সমর্থক প্রায় সবায় রিপাবলিকানদের পছন্দ ও সমর্থন করে থাকে। পক্ষান্তরে ডেমোক্র্যাটরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনদানের কারণে এবং তাদের উদারপন্থী ও যুদ্ধ নয় শান্তিনীতির কারণে বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল তাদের সমর্থক এবং উদারপন্থী সাধারণ মানুষ ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করে থাকে। বিশেষ করে আমেরিকার ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বর্তমান কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উদার পররাষ্ট্র নীতি, জঙ্গিবাদ বিরোধী ভূমিকার জন্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের তাবৎ শান্তিকামী মানুষ ডেমোক্যাকটদের সমর্থক।

বর্তমান পরিবর্তনশীল বিশ্বরাজনীতি ও বিশ্বরাজনীতির মুরব্বি হিসেবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে আমাদের দেশের প্রধান দু'টি রাজনৈতিক শিবির ডেমোক্যাট ও রিপাবলিকান এই দু'টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এর একপক্ষে অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ছিল আওয়ামী লীগ ও এর মিত্রসহ প্রগতিশীল উদারপন্থী রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার মানুষ আর অন্যপক্ষে অর্থাৎ রিপাবলিকানদের পক্ষে ছিল বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য উগ্র মৌলবাদী ইসলামী জঙ্গিদল। দ্বিতীয় পক্ষ চেয়েছিল মিট রোমনি পাশ পাশ করুক কেন তারা চেয়েছে উপরে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। তাছাড়া বারাক ওবামা সন্ত্রাস দমনে অনেকটাই সফল বললে ভুল বলা হবে তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মেনোবল ও সাহস একেবারেই ভেঙে দিয়েছেন।

সুতরাং বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে এমনই প্রেক্ষাপটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল খুবই গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও আমেরিকার সরকার বদলের সাথে তাদের পররাষ্ট্রনীতির খুব একটা হেরফের হয় না তবুও শান্তিকামী বিশ্ববাসী চেয়েছিল উদারপন্থী, জঙ্গিবাদ ও যুদ্ধবিরোধী ওবামাই জিতে আসুক; তা হলে অন্তত আগামি চার বছর বিশ্বের মানুষ কিছুটা হলেও শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।