বাংলাদেশের রাজনীতিকদের দৃষ্টি এখন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে

মাহবুবুল আলম
Published : 26 April 2014, 05:12 PM
Updated : 26 April 2014, 05:12 PM

ভারতের চলমান লোকসভা নির্বাচন এখন অনেকটাই শেষ পর্যায়ে। নয়টি ধাপের মধ্যে বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে ষষ্ঠ দফা নির্বাচন২৫ এপ্রিল শেষ হয়েছে ভারতের ৫৪৩ আসন বিশিষ্ট লোকসভায় এরই মধ্যে ৩৪৯ আসনেরনির্বাচন শেষ হয়েছেগতকাল ২৫ এপ্রিল ২০১৪ বৃহস্পতিবার ১১৭ আসনের ভোটগ্রহণের মধ্যদিয়ে অর্ধেকের বেশি আসনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছেআর ভোটগ্রহণবাকি আছে ১৯৪টি আসনের আরও তিন ধাপে বাকি আসনগুলোর ভোটগ্রহণহবেনির্বাচন শেষ হবে ১২ মে২০১৪ আর ভোটের ফল জানা যাবে ১৬ মেতাই এ বিশ্বায়নের যুগে ভারতের এ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সেই নির্বাচনের ফলাফলের দিকে।

আমরা সকলেই জানি বাংলাদেশের মানুষ এখন ভারতের নির্বাচন নিয়ে অনেকটাই দুই শিবিরে বিভক্ত। একপক্ষে আছে বর্তমানে বাংলাদেশের শাসকদল আওয়ামীসহ প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী-সমর্থকগোষ্ঠী; যারা ভারতে প্রগতিশীল বিশেষ করে কংগ্রেস বা কোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে স্বস্তিবোধ করে; অপর দিকে বিএনপি-জামায়াতসহ ডান ও অতিডান এবং প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর নেতাকর্মী-সমর্থক কংগ্রেস ও বামদল বিরোধী, তারা বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দল ক্ষমতায় এলে খুশি হয়। বলতে গেলে এই দুই শিবিরে বিভক্তির সমীকরণ কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা তারও আগে ৪৭-এর দেশবিভাগের পর থেকেই। শুধু ভারত কেন? আমেরিকা ও ব্রিটেনের নির্বাচন নিয়েও আমাদের দেশের মানুষকে দুই শিবিরে বিভক্ত হতে দেখি। ব্রিটেনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল সমমনাদল যেমন লেবার পার্টিকে সমর্থন করে অপর দিকে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো টোরি দলকে সমর্থন করে। আর বিগ পাওয়ার আমেরিকার নির্বাচনেওতো একই কথা খাটে। এখানেও একদিকে আওয়ামী লীগ ও সমামনা রাজনৈতিক দলগুলো যেমন ডেমোক্রেটদের সমর্থন করে অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো রিপাবলিকানদের সমর্থন করে থাকে। এই সমীকরণে ভারতের মতো বিশ্বের বৃহত একটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচণ নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের মানুষ দুই বা তকোধিক শিবির ভাগ হবে না সেটাতো আশাই করা যায় না।

তাই এবারের ভারতের লোকসভা নির্বাচনেও একই সমীকরণ কাজ করছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সমর্থকরা মনে করছে কংগ্রেস নেত্রীত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এলে তাদের সাথে স্বাস্তির সাথে কাজ করা যাবে পক্ষান্তরে বিজেপির মতো উগ্রসাম্প্রদায়িক দল বা জোট ক্ষমতায় এলে তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক কাজ করতে কিছুটা হলেও সমস্যা হতে পারে। অপর দিকে বিএনপি-জামায়াত মনে করে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দল বা জোট ক্ষমতায় এলে তারা স্বস্তি পাবে। তাদেরকে আস্থায় নিয়ে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ হবে; কংগ্রেস নেত্রীত্বধীন জোট ক্ষমতায় এলে যা সম্ভব নয়। এ কথা এখন সবাই জানে যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল জামায়াত বিএনপির সাথে বিজেপির যে সুসম্পর্ক রয়েছে তা কিন্তু আওয়ামী লীগের সাথে বিজেপির নেই।

ভারত বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতীম দেশ। শুধু তাই নয় এ দেশটির সাথে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারতো কিনা তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। ভারত আমাদের অর্থ দিয়ে অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ করে, সর্বোপরি প্রায় কোটি বাংলাদেশী শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আমাদেরকে চির কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে রেখেছে। একথা বলাতে আমাদের দেশের ভারতবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী অনেক ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল আবার আমাকে ভারতের দালাল বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করবে না, তা জেনেও একজন কৃতঞ্জ জাতির কৃতঞ্জ নাগরিক হিসেবে আমার মতো বাংলাদেশের অনেক প্রগতিশীল নাগরিক ও রাজনৈতিক দল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

বিশেষ করে ভারতের তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিচক্ষণ নেত্রীত্বে আমাদের দেশের এককোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ট্রেনিং দিয়ে সাহায্য করেই তিনি ক্ষান্ত হননি; তিনি তার চৌকুষ কূটনীতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশে বিশেষ করে তখনকার বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী দেশ সোভিয়েট ইউনিয়নকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পক্ষে অবস্থান নিতে কূটনৈতিক তৎপরায় সফল হয়েছিলেন।

তাই একটি নিকট প্রতিবেশী একটি বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে যখন সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে তখন না হয় রাজনীতিকদের কথা বাদই থাকলো। আর এ বিষয়েতো নিবন্ধের আখ্যানভাগেই আলোচনা করা হয়েছে। এখন আমি ভারতের চলমান লোকসভা নির্বাচনের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে ২৬ এপ্রিল ২০১৪ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত কাওসার রহমানএর 'তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গঠনের সম্ভাবনা আরও প্রবলবিজেপির ১৮০'র বেশি আসন পাওয়া অসম্ভব' শিরোনামের প্রতিবেদনের অংশবিশেষ উল্লেখ করতে চাই।  কাওসার রহমানতাঁর প্রতিবেদনে বলেছেন,'ষষ্ঠ দফা ভোটের পর ভারতে তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গঠনেরসম্ভাবনা আরও প্রবল হয়ে উঠেছেনতুন করে জল্পনা হচ্ছে কংগ্রেস সমর্থিততৃতীয় ফ্রন্টের সরকার নিয়েবলা হচ্ছে, বিজেপির নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদিরপক্ষে ১৭০ থেকে ১৮০টির বেশি আসন পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবেফলে যতই মোদিহাওয়া উঠুক এবার ম্যাজিক সংখ্যা যে কেউ পাচ্ছে না তা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েউঠছে রাজনীতিকদের কাছেআর এ কারণেই কংগ্রেস সমর্থিত তৃতীয় ফ্রন্টের সরকারগঠনের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছেগত ছয়টি ধাপের ভোটের প্রবণতা দেখে রাজনীতিকরা নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেনবিশেষ করে দিল্লীর ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন রাজ্যভিত্তিক অনেকছোট দলের নির্বাচন শেষ হয়েছে কিংবা শেষ পর্যায়ে রয়েছেএ কারণেই সরকারগঠনের ম্যাজিক সংখ্যা নিয়ে আলোচনা সূত্রপাত হচ্ছে৫৪৩ আসন বিশিষ্ট ভারতীয়লোকসভায় সরকার গঠনের জন্য কাক্সিক্ষত বা ম্যাজিক সংখ্যা হচ্ছে ২৭২ম্যাজিক সংখ্যা যে এবার এককভাবে কোন দল বা জোট পাচ্ছে না তা অনেকটাইপরিষ্কার হয়ে উঠছেআর এ কারণেই সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে তৃতীয় ফ্রন্টেরসরকারের'

যদিও ভারতের সাথে বাংলাদেশে বাণিজ্য ঘাটতি গঙ্গার পানির নায্য হিস্যা, সীমান্ত বিরোধ, সিটমহল করিডোরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কিছু টানাপোড়েন আছে তবু বিশ্বের বৃহত জনশক্তির দেশ যার সীমান্ত বাংলাদেশকে দক্ষিণ দিক অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর ছাড়া তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে সে হিসেবে তাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলতে পারলে আমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবার কথা নয়। তবু পাকিস্তানের জন্মলগ্ন ৪৭' সাল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশেও ভারতবিরোধী বিশাল একটি জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠেছে। যাদের পেছনে আবার কলকাঠি নাড়ে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। কেননা পাকিস্তান মনে করে ভারতের সহযোগিতার কারণেই একটি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে ভাগ হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে শুধু দাঁড়ায়ইনি একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হতে যাচ্ছে। তাই বিশ্বের চতুর্থ শক্তিধর রাষ্ট্র ভারতের চিরবৈরী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীরা কিছুতেই চাইবে না ভারতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। সেই কারণেই তাদের ইচ্ছা ও প্রার্থনা দিল্লীর মসনদে যেন কিছুতেই কংগ্রেস জোট বসতে না পারে।  তবে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যারা কমবেশি খবরাখবর রাখেন তারা সবাই জানেন, সেখানে ক্ষমতার হাত বদল হলেও তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে তেমন কোনো হেরফের হয় না। পৃথিবীতে দেশকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসে এমন যে ক'টি দেশ আছে এদের মধ্যে ভারতীয়রা হলো অন্যতম দেশপ্রেমিক জাতি। সে হিসেবে বিজেপির কট্টর হিন্দুবাদী নেতা মোদী ক্ষমতায় এলেও দেশের সার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন কাজে হাত দিতে সাহস পাবে না। তা করতে গেলে ক্ষমতার গদী উল্টাতে সময় লাগবে না।

যাক লেখার পরিধি আর না বাড়িয়ে এই বলে শেষ করবো, বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা লাভের গর্ভ যাতনায় ছটফট করছিল তখন স্বয়ং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী একজন ধাত্রির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আলোর মুখ দেখিয়েছিলেন। কাজেই যে দেশ ও দেশের জনগণ সর্বোপরি সে দেশের সরকার তাঁর দেশের সেনাবাহিনী প্রায় ৮ সহস্রাধিক সেনা সদস্যের জীবন বলি দিয়ে আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের পথকে সুগম করেছিলেন সে দেশ ও সে দেশের জনগণের অসীম ত্যাগের কথাতো কোন কৃতঞ্জ জাতি ভুলে যেতে পারে না। এ কৃতঞ্জতা প্রকাশ করলে কেউ যদি ভারতের দালাল বলে গালি দেয় তাতে আমার কোনো দুঃখবোধ থাকবে না।