নারী-পুরুষের বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক: পারিবার ও সামাজিক কাঠামো নড়বড়ে করে দিচ্ছে

মাহবুবুল আলম
Published : 7 July 2014, 08:22 AM
Updated : 7 July 2014, 08:22 AM

আমাদের বর্তমান অস্থির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারী-পুরুষের বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে, যার কারণে আমাদের পরিবার ও সমাজ জীবনে সামাজিক মূল্যবোধের সকল পরিকাঠামো প্রবল নদী ভাঙ্গনের কবলে পতিত হয়েছে। এতদিন ধর্মীয় অনুশাসনের ভয়ে আমাদের সমাজের নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের বিষয়টি একটা সীমারেখা অনসরণ করে চললেও পাশ্চাত্য ও আকাশ সংস্কৃতির প্রাবল্যে এ বিষয়টির অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের পারিবারিক ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও স্তরে। নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠা বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কীত বিষয়টিকে এক নামে পরকীয়া হিসাবে অবহিত করতে পারি।

পরকীয়া শব্দের রসায়ন বিশ্লেষণ করলে পরকীয়া সন্মন্ধে অনেকটাই ধারনালাভ করা সম্ভব। তাই আমি পরকীয়া শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণে যেতে চাই। পরকীয়ার অর্থ হলো পরসম্বন্ধীয় বা অন্যের। পরকীয় শব্দ থেকেই পরকীয়া শব্দের উৎপত্তি। যা এক ধরণের ভালোবাসা বা অনুরাগ। তবে শাশ্বত প্রেম বা ভালোবাসা বলতে আমরা যা বুঝি, পরকীয়া তা নয়। আমরা সচরাচর মন্দ অর্থে তা ব্যবহার করে থাকি। এর অন্যে যুতসই অর্থ হলো অন্যের স্ত্রী বা স্বামী অথবা পরপতœী বা পরপতি বা পরস্ত্রী, কুমারীর প্রতি অনুরাগ ও ভালোবাসা। বৈষ্ণব শাস্ত্রে পরকীয়াবাদ নামে প্রেমবিষয়ক এক মতবাদ রয়েছে; বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের অনেকেই এই মতবাদে বিশ্বাসী। তাই আমরা অনেক বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর মধ্যেই এক ধরণের বন্ধনহীন ভালোবাসা বা প্রণয় দেখতে পাই যা পরকীয়ারই অন্য একটি রূপ। তবে মনোবিজ্ঞানীরা এটিকে দেখছেন মানুষের কু-অভ্যাস ও মানসিক সমস্যা হিসাবে।

শুধু বর্তমান যুগেই নয় বহু বহু যুগ আগে থেকেই মানব-মানবীর মধ্যে পরকীয়ার বিষয়টি চলে আসছে। যা আমরা বিভিন্ন সময়ের সাহিত্য থেকে জানতে পাই। অনেক আগের রাজা বাদশারা নিজেরা পরনারী ও সুরাষক্ত থাকলেও তাদের স্ত্রীদের পরকীয়া থেকে দূরে রাখার জন্যে অন্তপুরের কারারক্ষীদের খোজা করে রাখতো। এই কথা থেকে ও বুঝা যায় মানব সভ্যতার পর থেকেই পরকীয়ার বিষয়টি চলে আসছে। তবে সব সময়েই আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এটিকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। তবু থামছেনা পরকীয়ার ঘটনা বরং বর্তমানে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার এই যুগেও যেন এটি সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে আমাদের সমাজ ও পারিবারিক ক্ষেত্রে এক বিরূপ পরিবেশের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে মোবাইল সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের উত্তরণের সাথে সাথে পরকীয়ার দুষ্ট থাবা ক্রমেই বিস্তার হচ্ছে দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে। এই জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রে সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিদ জটিলতা। হেলে পড়ছে পারিবারিক কাঠামোর খুঁটিগুলো। পরকীয়ার আগুনে কারো কারো সোনার সংসার পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে পরিবারে সৃষ্টি হচ্ছে অবিশ্বাস। অবিশ্বাস থেকে মানুষের সুখের সংসারে নেমে আসছে অশান্তি। সমাজে বেড়ে যাচ্ছে বহু বিবাহ ও বহুগামিতার মতো ঘটনা। পরকীয়াকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে কেউ কেউ করছে লিভটুগেদার; পরিনামে ঘটছে অনাকাঙ্খিত বিবাহ বিচ্ছেদ।

শুধু তা ই নয় এই পরকীয়ার কারণেই অনেক ক্ষেত্রে ঘটে যাচ্ছে খুনখারাবীর মতো ঘটনাও। সাম্প্রতি সময়ের পত্র-পত্রিকার দিকে তাকালে এর ভয়ানক চিত্র ফুটে ওঠবে। স্বামীর পরকীয়ার নিষ্ঠুর বলি হতে হয়েছে জুরাইনের রাশেদুল কবিরের স্ত্রী রিতা ও তার দুই সন্তানকে। আদাবরে মায়ের পরকীয়ার সম্পর্কের বিশ্রী দৃশ্য দেখে ফেলায় খুন হতে হয়েছে নিষ্পাপ শিশু সামিউলকে। এ ছাড়া প্রায়ই স্বামীর পরকয়ীয়ার সম্পর্ক দেখে ফেলায় স্ত্রী খুন, স্ত্রীর পরকীয়ায় বাঁধা দেয়ায় স্বামী খুন, পরকীয়ার টানে ৩ সন্তানের জননীর পরপরুষের হাত ধরে গৃহত্যাগ। শালীকে নিয়ে দুলাভাই নিরুদ্দেশ, গৃহশিক্ষকের হাত ধরে গৃহকর্ত্রীর পলায়নজাতীয় কত খবর পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে। তাই পরকীয়ার কারণে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধনগুলো ক্রমেই ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে নারী নির্যাতন ও এসিড সন্ত্রাসের ঘটনাও।

পরকীয়াকে আমাদের সমাজবিদরা এক ধরণের অনাচার ও সমাজবিরোধী কাজ বলে মনে করে থাকেন। মনোবিজ্ঞানীরা এটিকে মনে করছেন মানুষের একটি সাইকোলজিক্যাল সমস্যা হিসাবে। এমন ও দেখা গেছে যারা পরকীয়া করছে, তারা শুধু একা নিজেই এক কাজটি করছেন না। অন্যকেও এ কাজে উৎসাহিত করছে। এটা ঘটছে মহিলাদের ক্ষেত্রে সব'চে বেশী। তবে পুরুষরা কিন্তু তেমন পিছিয়ে নেই। যখন কোনো পরকীয়া সংগঠিত হয় তখন তা একজন নারী-পুরুষ, পুরুষ-নারীর মধ্যেই সংগঠিত হয়। মহিলাদের কারণে পরকীয় বেশি ঘটছে, বলে যারা মনে করেন, তাদের মত হচ্ছে মাহিলারা হলো মায়ের জাতি। কিন্তু তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে কোনো পুরুষের পক্ষে কোনো মহিলার সাথে পরকীয়ায় জড়ানো সম্ভব নয়। কোনো কোনো সমাজ বিজ্ঞানীর মতে সবচেয়ে বেশি পরকীয়া হচ্ছে গার্মেন্টস কর্মী, ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে। কেননা, উভয় পেশার নারী-পুরুষ পালাক্রমে নাইট শিফটে ডিউটির কারণে পরষ্পরের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পায়। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে পরকীয়া ও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তাদের অনেকেই। তা ছাড়াও অনেক সময় ডাক্তার ও মহিলা রোগীর সাথেও এ ধরণের পরকীয়া ও অনৈতিক সম্পর্কের কথা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমার নিজের জানামতে অতি সম্প্রতি এক ডাক্তার ও তরণী রোগীর মধ্যে এ ধরণের পরকীয়ার কারণে ডাক্তার তার বড় বড় দুই বাচ্চা ফেলে ওই তরণীকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।

গামেন্টস সেক্টরে পরকীয়ার বিষয়টি আরো বেশী। এখানে শতকরা আশিভাগ কর্মীই সাধারণ ও গরীব ঘরের মেয়ে। তাদেরকে নানা প্রলোভনে ফেলে বা কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়েই পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে। এ ধরণের পরকীয়া শেষ পর্যন্ত পরকীয়ার গন্ডি অতিক্রম করে অনৈতিক সম্পর্কের দিকে গড়ায়। যা নিয়ে পরিবারে পরিবারে সন্দেহ অবিশ্বাসের কারণে স্বামীর হাতে স্ত্রী, বা স্ত্রী ও তার প্রেমিকের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে। সেসব ঘটনার খুব কমই পত্রিকা বা থানা পর্যন্ত গড়ায়।

শুধু তা ই নয় কর্পোরেট অফিস গুলোতে এখন প্রায় নারী পুরুষের অনুপাত ৬:৩ সেখানেও কাজ করতে করতে কেউ কেউ একজন আরেকজনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতন এবং স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণহীনতার কারণে অফিসে এসে শান্তি বা ভালোবাসার পথ খোঁজে। এদের কারো কাছেই তখন স্বামী-স্ত্রী বা সংসার বিবেচ্য হয়ে ওঠে না। তাদের কাছে মোহনীয় হয়ে ওঠে নিষিদ্ধপ্রেম।

তা ছাড়া আজকাল অনেক মহিলার স্বামীই পেট্রো-ডলারের লোভে বিদেশে পারি জমায়। সেই সুযোগটিই গ্রহণ করেন অনেক স্ত্রী। সেই সুযোগে পরনো প্রেমিক বা স্বামীর বন্ধু বা অন্য কারো সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে তারা। স্বামীরা যখন বিদেশের মাটিতে কঠিন জীবন সংগ্রামে থেকেও সুন্দর আগামীর স্বপ্নের জাল বোনে, কাকের, কোকিলের বাচ্চা লালনের মতোই টাকা পয়সা হজম করেন স্ত্রীর প্রেমিক প্রবরটি। কারো স্ত্রী হয়তো পরকীয়ার নীল হাতছানিতে ডুবে গিয়ে, শুধু সম্পর্কটা টিকেয়ে রাখে কোন রকমে। এসব পরকীয়ার থাবা ক্রমেই বিস্তার ঘটছে বিভিন্ন নামী-দামী প্রাইভেট স্কুলের অপেক্ষমান মহিলা অভিভাবদের মধ্যেও। মোবাইলের কল্যাণে বাচ্চাকে ক্লাশে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপে মগ্ন থাকে অনেকেই। সেখানে পুরনো প্রেমিক, বা ছেলে বা মেয়ের ক্লাশমেটের কোনো বাবা, বা মা যেখানে যা প্রযোজ্যের মতো পরকীয়া করে যাচ্ছে।

এ ছাড়াও আজকাল অতি আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে যেয়ে, অনেক পরিবারে সৃষ্টি হয় না টানাপোড়েন, সেই টানাপোড়েন থেকে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার শিকার হয়ে অনেকেই পরকীয়ার নীল ছায়ায় আশ্রয় খোঁজেন। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো মহিলা তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে পরকীয়ার প্রেমিককে ফোন করে বাসায় ডেকে এনে অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছেন। এমন ঘটনা যে পুরুষের বেলায় ঘটেনা তা ও কিন্তু নয়।

আবার মোবাইলের অপব্যবহারের মাধ্যমে অনেকে শিকার ধরে। একবার দু'বার মিসডকলের অজুহাতে কল করে রেসপন্ড পেলেই শুরু হয় মোবাইল প্রেম। এ প্রেম গড়াতে গড়াতে একসময় রূপ নেয় পরকীয়ায়। পরকীয়ার ব্যাপারটি যে শুধুমাত্র বিবাহিত পুরুষ-মহিলার মধ্যেই ঘটছে তা নয়। অনেক কুমারীও বিবাহিত পুরুষের সাথে এমনকি কয়েক সন্তানের পিতার সাথে; বিপরীত দিকে অনেক অবিবাহিত তরুণও অনেক বিবাহিত মহিলা বা কয়েক সন্তানের মায়ের সাথে দিব্যি পরকীয়া করে বেড়াচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব বিষয়-আসয় পারিবারিক ভাবে জানাজানি হয়ে গেলে সে ক্ষেত্রে যদি বিচার শালিস বা আইনের আশ্রয় গ্রহণ করা হয় তখন সেব সব ব্যক্তিদের মোবাইলে আড়িপেতে অমন ঘটনা নিশ্চিত হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বর্তমানে আমাদের সামাজিক জীবনে এই পরকীয়া অন্ধকার আগ্রাসী মেঘের মতো ঢেকে দিচ্ছে, আমাদের সততা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিষয় আসয়কে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে পরকীয়ার কু-প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ পরকীয়ার কারণে একদিন আমাদের সামাজিক কাঠামোর খুঁটিগুলো হেলতে হেলতে, ভেঙে পরতে পারে একটা সময়ে এসে।