আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের চিরবৈরিতা ও আবেগী বাঙালীদের কথা

মাহবুবুল আলম
Published : 10 July 2014, 08:31 PM
Updated : 10 July 2014, 08:31 PM

মাহবুবুল আলম।।

আর মাত্র দুই দিন। আগামী ১৩ জুন ফিফা ওয়াল্ডকাপ ২০১৪-এর ফাইন্যালের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল উত্তেজনা ও উন্মাদনা। যে ৩২ টি দল নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের মহারণ শুরু হয়েছিল, সেই ৩২ দেশের ২৭ দেশ ইতিমধ্যে যার যার দেশে চলে গেছে। ব্রাজিলে রয়ে গেছে মাত্র ৩টি দেশ আর্জেন্টিনা, জার্মানী ও নেদারল্যান্ড। এরই মধ্যে ব্রাজিল ও নেদারল্যান্ডের মধ্যে তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচটিও শেষ হয়ে যাবে। ১৩ জুন আর্জেন্টিনা ও জার্মানীর মধ্যে ফাইন্যালের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে বিশ্বকাপ ফুটবলের। ফাইন্যালে যে দল স্নায়ুরচাপ নিয়ন্ত্রণে করে কৌশলী ও ভাল খেলতে পারবে সেই দল বা দেশেই বিশ্বকাপ শিরোপার ট্রফি পাবে এটাইতো বাস্তবতা।

কিন্তু এ বাস্তবতাকে যেন আমরা আবেগী বাঙালীরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। খেলা নিয়ে আমাদের মধ্যে বিবাদ-বিভক্তি। তা চলতেই পারে তবে এটা যখন উত্তেজনা ও উন্মাদনার পর্যায়ে চলে যায় তখনই বিষটাকে আর সহজে মেনে নেয়া যায় না। যাক এসব কথা বাদ দিয়ে আসি একটু বিশ্লেষণে। এবারের বিশ্বকাপে অনেক অঘটন ঘটেছে। তা নিয়ে আগেই লিখেছি তাই এ নিয়ে লিখে কলেবর বাড়াতে চাই না। তবে যে অঘটনটির কথা না বললেই নয়, সেই অঘটনটি হলো প্রথম সেমি-ফাইন্যালে জার্মানীর কাছে ১-৭ গোলের ব্যবধানে শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে এবারের বিশ্বকাপে অন্যতম শীর্ষ ফেবারিট স্বাগতিক ব্রাজিলের বিদায় সবচেয়ে বড় অঘটন হিসেবে বিবেচিত হবে। ভাল পারফরমেন্স ও স্বাগতিক দেশ, নিজ দেশের কোটি কোটি দর্শক ও অন্যন্য বিবেচনায় ব্রাজিলই ছিল সবচেয়ে এগিয়ে। কিন্তু প্রথম সেমি-ফাইন্যালে জার্মানীর কাছে শোচনীয় পরাজয়ে সে দেশের মানুষ, বিশ্বের কোটি কোটি ব্রাজিল বক্তদের সাথে সাথে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যেও নেমে এসেছে যেন কবরের নিস্তব্দতা। তাদের মন এতটাই ভেঙে গেছে এ ভাঙা মন মেরামত করতে যে আরও কিছু দিন লেগে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৫০ সালে নিজ দেশে বিশ্বকাপ জিততে না পেরে ব্রাজিলীয়ানরা যেভাবে হতাশার সাগরে ডুবে গিয়েছিল । ৬৪ বছর পর ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ আয়োজন করে শিরোপা স্বপ্নে বিভোর ছিলেন ব্রাজিলিয়ানরা। সবচেয়ে বড় কথা ব্রাজিলের ফুটবলের ইতিহাসে এর আগে ৭-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারেনি ব্রাজিল। পাঁচবার বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলা ব্রাজিলকে এর আগে কখনও বিশ্বকাপে এত গোল হজম করতে হয়নি। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে ১৯২০ সালে উরুগুয়ের কাছে ৬-০ গোলের হারের পর সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হার এটি। তাই এই পরাজয়ে কোন 'ফুটবল গণিতের' ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেনি কোন ব্রাজিল সমর্থকই। এমন এক বেদনাদায়ক পরাজয়ে ব্রাজিল কোচ লুইস ফিলিপ সোলারি মিডিয়ার মুখোমুখি হতে যেন লজ্জা পাচ্ছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কি বলবেন যেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তারপর হঠাৎই নিজকে নিজের মধ্যে ফিরিয়ে এনে যা বললেন তা পাশা পাশি দাঁড় করালে এমন শোনাবে…ব্রাজিল জাতির কাছে এই মুহূর্তে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কিছু বলার নেই। আমি সত্যিকার অর্থেই লজ্জিত। দিনটা ব্রাজিলের ফুটবলের জন্য কেবলই লজ্জার। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে বড় ইতিহাস হয়ে থাকবে বেলোর এই নির্মম পরাজয়।… এ ধরনের হারের কারণ কোন ফুটবল মহাজ্ঞানীও দিতে পারবেন না। …পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পাঁচ গোল খেয়ে গেলে খেলা আর খেলা থাকে না। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উঠে আশার কোন সুযোগ ছিল না। ফিফার নিয়ম থাকলে ওখানেই আমি 'স্যারেন্ডার' করে মাঠ ত্যাগ করতাম।'

এই যখন অবস্থা তখন আমাদের দেশের কিছু কিছু ব্রাজিল বক্তের উত্তেজনায় নিজের জীবন ও বউ তালাকের মতো ঘটনাও ঘটেছে। মনমালিন্য হয়েছে, আপন ভাইয়ে-ভাইয়ে, বোন-ভাই, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধবের মধ্যে। যা কখনো কাম্য হতে পারে না। খেলাকে নিতে হবে খেলা হিসেবেই। কিন্তু বাংলাদেশের দর্শক ও সমর্থকদের সে উত্তেজনা যেন শেষ না হয়ে আরো বেড়ে গেছে। এ উত্তেজনা কি চরমে ওঠেছে তা টের পাওয়া যায় ফেইসবুকে ঢুকলেই।

বালাদেশের ফুটবল দর্শক ও সমর্থকদের আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ব্রাজিলের সমর্থক ভক্তের সংখ্যাই ৮০ থেকে ৮৫ ভাগের মতো। আর অন্যন্যরা জার্মানী, নেদারল্যান্ডসহ অন্যন্য দেশের সমর্থক। তবে মজার ব্যপার হচ্ছে রাতারাতিই এখানের সিংহভাগ ব্রাজিল ভক্ত এখন জার্মানীতে মাইগ্রেট করেছে। নিজেদের বুকের কষ্ট পাথরচাপা দিয়ে জার্মানীর সমর্থকে পরিনত হয়েছে। তারা কিছুতেই ল্যাটিন আমেরিকার অন্যতম ফুটবলপ্রিয় দেশ আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করবে না। এ বিষয়টি দ্বিতীয় সেমি-ফাইন্যালেও বেশ ক্রিয়াশীল ছিল। ব্রাজিল সমর্থকরা রাতারাতি নেদারল্যান্ড সমর্থকে পরিনত হয়ে কায়মনোবাক্যে আর্জেন্টিনার পরাজয় কামনা করছিল। কিন্তু আর্জেন্টনা ফাইনালিস্ট হয়ে যাওয়ায় ব্রাজিলিয়ান ভক্তরা জার্মানীর পক্ষে চলে গেছে। আর্জেন্টিনা যে ব্রাজিলেরই নিকট প্রতিবেশী ল্যাটিন আমেরিকার দেশ সে হিসেবে আর্জেন্টিনা শিরোপা জিতলে এ যাতনা ব্রাজিল সমর্থকরা সইতে পারবেনা বলেই এই মেরুকরণ ঘটেছে। এটা যে ব্রাজিল সমর্থকদের বেলায় ঘটছে তা কিন্তু নয়, আর্জেন্টিনার সমর্থকদের বেলায় একই ঘটনা ঘটতো। এটা যেন দুই দেশের দুই দলের চিরবৈরিতা। এই বৈরিতা দীর্ঘদিন থেকেই চলে আসছে।

এই বৈরিতার বিষয়টি কি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তা আরও টের পাই আজ সকালে ফেইসবুকে লগইন করে। কি যে তুমমুল বিতর্ক-ঝগড়া-ঝাটি-মনমালিন্য! কি যে বিদ্বেষপূর্ন স্টেটাস ঘৃণাবাক্যবাণ তা কেউ বুঝতে পারবে এখনো যারা ফেইসবুকে ঢুকেনি। এই কেইস আরো চলবে দুইদিন। এই দুই দিন কেউ কাউকে ছাড়বেনা এক ইঞ্চি ভূমি। এ প্রসংগে আমার নিজের মত হলো একটি খেলাকে কেন্দ্র করে উন্মাদনাকে এতোটা প্রশ্রয় দেয়া কিছুতেই ঠিক নয়। তবে ফুটবল বোদ্ধাদের অনেকের মতে এ বৈরিতা শেষ হবার নয়। এ বৈরিতার প্রকটভাবে শুরু হয় ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার শিরোপা জয়ের মাধ্যমে ম্যারাডোনার ফুটবলের ঈশ্বর বনে যাওয়া। এর আগ পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলের একমাত্র ঈশ্বর ছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে। কিন্তু ১৯৮৬তে এসে ল্যাটিন আমেরিকারই আরেক দেশ আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনার বিশ্ব ফুটবল ঈশ্বরের পদের দাবীদার হয়ে যাওয়ায় বৈরিতার শুরু। কেননা ব্রাজিলিয়রা মনে করে বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলেই সেরা। তাদের এ পরিসংখ্যানে ব্রাজিল অনেক এগিয়ে, ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলের পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ান। কাজেই ওই অঞ্চলের কোন দেশ যেন এ কৃতিত্বে অধিকারী না হয় সে জন্যই এ বৈরিতার সৃষ্টি, যেমন ক্রিকেট নিয়ে দুই প্রতিবেশি ভারত-পাকিস্তানের চিরবৈরিতা, তেমনি ফুটবল নিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনারও বৈরিতার শেষ নেই।

সেই বৈরিতায় এখন যুক্ত হয়েছি আমরাও বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকরা। আবেগ থাকা ভাল, কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এদেশের মানুষ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যে আবেগী লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে এই যে এত আবেগ এত আবেগ কিন্তু ভাল না। আমি হয়তো আবেবগহীন তাই এসব কর্মকান্ড দেখে মনে মনে বলি, হায়রে আবেগী বাঙালী জাতি।