ঈদের উদ্ভব ও মুসলিম উম্মার জীবনে ঈদের তাৎপর্য

মাহবুবুল আলম
Published : 27 July 2014, 07:20 AM
Updated : 27 July 2014, 07:20 AM

ঈদ মানে আনন্দ ঈদ মানে খুশি। এ কথা আমরা সবাই জানি। ঈদের সামাজিক অর্থ উৎসব আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। তাই প্রতি বছরই মুসলমানদের জীবনের ফিরে আসে খুশির ঈদ। প্রথমটি উদযাপিত হয় দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম সাধনার পর। যাকে আমরা বলি ঈদ-উল- ফিতর বা রোজার ঈদ, আর অন্যটি আত্মত্যাগের কোরবানীর ঈদ বা ঈদ-উল-আজহা। এই দুইটি ঈদই হলো মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশে ঈদের দিন দুইটি খুবই জাঁকজমকের সাথে উৎসবমূখর পরিবেশে পালিত হয়। সবাই এ দিন যার যার সাধ্যানুযায়ী ভালো পোশাক পরে। ঘরে ঘরে উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের অংশীদার হয়। দরিদ্র ও গরীবাও এ দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা আনন্দের সাথে পালন করে। মুসলমানেরা এ দিন কৃতজ্ঞচিত্তে খুতবাসহ ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে কুশল বিনিময় করেন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই কোলাকুলিসহ সালাম ও শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে ঈদকার্ড বিনিময় একটি জনপিয় প্রথায় পরিণত হয়েছে। আর তথ্য-প্রযুক্তির এ উৎকর্ষতার যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমেও আনন্দ-খুশি ও ঈদের আবেগ ভাগাভাগি করে থাকে। সমাজের ধনী ও সক্ষম ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা শর্তহীন অনুদান বিতরণ করে থাকে যা ধর্মীয় দিক থেকে ধনীদের জন্য যা বাধ্যতামূলক।

এই যে ঈদ, এই উৎসবের কীভাবে উদ্ভব হয়েছে তার ইতিহাস ও তথ্য সঠিকভাবে আজও জানা যায়নি। নানা ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র ও তথ্য থেকে বাংলাদেশে রোজাপালন এবং ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা উদযাপনের যে ইতিহাস জানা যায় তাতে ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদোৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশ আগে থেকেই। বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম-প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব-বাংলায় আসেন। অন্যদিকে আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকেরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় প্রভাব যে পূর্ব-বাংলায় পড়েছিল।

এ বিষয়ে নানা ইতিহাস গ্রন্থ পর্যলোচনা করলে আরও দেখা যায় অষ্টম শতকের দিকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ফলে, এই সুফি, দরবেশ এবং তুর্ক-আরব বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে সে যুগে তা ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব। এদেশবাসীর ধর্ম-সামাজিক পার্বণ নয়। এদেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় তাসকিরাতুল সোলহা নামক গ্রন্থে। এ গ্রন্থে দেখা যায় আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ সন মুতাবিক ৯৪১ খৃস্টাব্দে ঢাকায় আসেন। বঙ্গদেশে-ইসলাম আগমন পূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তানা গেড়ে ইসলাম প্রচার শুরু করেন বলে জানা যায়। শেখউল খিদা চন্দ বংশীয় রাজা শ্রীচন্দের শাসনকালে (৯০৫-৯৫৫ খৃস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেন বলে অনুমান করা হয়। তবে এদের প্রভাবে পূর্ব বাংলায় রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয়েছিল, তা বলা সমীচীন নয়। এঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ওইসব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন একথা বলাই সঙ্গত। কারণ বাংলাদেশে 'নামাজ', 'রোজা' বা 'খুদা হাফেজ' শব্দের ব্যাপক প্রচলনে বোঝা যায়, আরবীয়রা নয়, ইরানীরাই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কারণ শব্দগুলি আরবীয় ভাষার নয়, ফার্সি ভাষার।

ঢাকার ইতিহাসবিদ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেছেন : ১৬৪০ খৃ. বাংলার সুবেদার শাহসুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম একটি ঈদগা নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট। নির্মাণকালে ঈগদাটি ভূমি থেকে বার ফুট উঁচু করা হয়। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মুঘল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এ ঈদগা। প্রথমদিকে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন। পরে ঈদগাটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই ঈদগার পাশে উনিশ শতকের শেষদিক থেকে একটি মেলারও আয়োজন করা হয়। এই ঈদগার পার্শ্বে একটি সুন্দর সেতুর চিহ্নও রয়েছে। ঈদগাটি এখন সংরক্ষণ পুরাকীর্তি।

শামসুজ্জামান খান তার 'বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ' নিবন্ধে বলেছেন 'ঈদোৎসব শাস্ত্রীয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে দ্বাদশ শতকের বাংলায় ইসলাম এলেও চার/পাঁচশত বছর ধরে শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুপুঙ্খ অনুসরণ যে হয়েছিলো তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেকালের বাংলায় ঈদোৎসবেও তেমন কোনো ঘটা লক্ষ্য করা যায় না। এর কারণ হয়তো দুটি: এক. গ্রাম-বাংলার মুসলমানেরা ছিলো দরিদ্র; এবং দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো তেমন প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর অবস্থাও তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটাতো জানা কথাই যে সংহত সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। বৃহৎ বাংলায় ঈদোৎসব তাই সপ্তদশ, অষ্টাদশ এমনকি ঊনবিংশ শতকেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। নবাব-বাদশারা ঈদোৎসব করতেন, তবে তা সীমিত ছিলো অভিজাত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে, সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক উৎসব হিসাবে ঈদের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিলো না। তবে গোটা ঊনিশ শতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে তার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগর জীবন ও গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের ওপর। মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও এই চেতনাকে শক্তিশালী করেছে। আর তাই এই অনুকূল পরিবেশেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালিত বাংলাদেশ আন্দোলন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার যে নবরূপায়ণ ঘটেছে তাতে ঈদোৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নতুন গুরুত্ব পেয়েছে।'

মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ছিল। তার সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান না থাকলেও কিছু দূরত্ব ছিল। তাই ঈদ এ দেশে জাতীয় উৎসবে রূপান্তর হতে সময় নিয়েছে। তবে মুঘলরা যে ঈদের গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় খোলামেলা গণমুখী শাহি ঈদগাহের উপস্থিতি দেখে। সুফিসাধকদের ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে আলাদা, অধিকতর গণমুখী। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান লোকজ মেলা। সে ধারা আজো কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ঈদ আনন্দমেলার আয়োজন করা হয়। সামর্থের জোড়াতালির ভেতরও ঈদবাজার এখন অনেক বেশি জমজমাট ও উৎসবমুখর।

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপে কনিষ্ঠতম, কিন্তু আয়োজন-প্রয়োজনে ব্যাপকতর। এই মহান ও পুণ্যময় উৎসবের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৩৮৮ সৌর বছর আগে থেকে। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। আরবদের ইহুদি ধ্যানধারণা ও জাহেলি প্রথার পরিবর্তে দুই ঈদ ছিল আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য ঘোষিত উপহার। ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসী রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশে শুরু করল ঈদ-উল- ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা উৎসব উদযাপন। এর আগে পৌত্তলিক ভাবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজান নামে দু'টি উৎসবে মদিনাবাসী শরিক হতো। আরবরা এ মেলায় অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ কাজে মেতে ওঠতো। একই সাথে মেলায় আদিম উচ্ছ্বলতায়ও মেতে উঠত তারা। সেগুলো ছিল উচ্চবিত্তের খেয়ালিপনার উৎসব। এর পরিবর্তে জন্ম নিলো শ্রেণিবৈষম্য-বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত ইবাদতের আমেজমাখা সুনির্মল আনন্দে ভরা ঈদআনন্দ। আমেজের দিক থেকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ, আচরণের দিক থেকে প্রীতি ও মিলনের উৎসব ঈদুল ফিতর। ইসলামের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার দিকটি প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে ইসলাম সাম্য-মৈত্রী, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম ও ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে এর রূপময়তা সর্বত্র চোখে পড়ে। সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়। ভিন্ন ধর্মে মানুষও ঈদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল ভোগ করে। ঈদ উৎসবে গতানুগতিক জীবনধারার অধ্যাত্মবাদের সাথে যোগ হয় প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ভিন্নমাত্রিক জীবনধারা। তাই ঈদের আর্থসামাজিক গুরুত্বও অপরিসীম। ঈদের সাথে রমজানের আত্মশুদ্ধির কথাও বলা যেতে পারে। কারণ রোজার সাথে ঈদের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ।তাতে বদল হয়েছে ধর্মের অবিমিশ্র ও শুদ্ধ রূপেরও। যে কারণে বাংলাদেশের মুসলমানের সাথে আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনচর্চা এক হলেও উৎসব অনুষ্ঠানে রকমফের সহজেই চোখে পড়ে। এর মুখ্য কারণ, পোশাক-আশাক ও খাদ্যাভ্যাসে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ।

বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে দুর্গাপূজা ও ঈদ পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে শান্তিপূর্ণভাবে। এতে দুই ধর্মের লোকদের ধর্ম পালনে শান্তিপ্রিয় মনোভাব এবং সামাজিক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। গতবারও বিগত বছরের মতো দুর্গাপূজা ও ঈদ পাশাপাশি হয়েছে। সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিয়োজিত থাকেছেন। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে, নির্ভয়ে এবং সংঘাতমুক্তভাবে পারস্পরিক ধর্মীয় উৎসব পালন করবেন- এমনটাই কাম্য। সব মিলিয়ে দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনবোধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে গভীরভাবে। ধর্মীয় উৎসবগুলোর সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও বিকাশ ঘটছে। এ উৎসবগুলো স্থানিক পর্যায় থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃৃত প্রভাব ফেলছে। বাঙালি সংস্কৃতির বৈশ্বিক বিস্তারেও ভূমিকা রাখছে।

বাঙালির সংস্কৃতি হলো ধর্মনিরপেক্ষ মানবসংস্কৃতি, উদার সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিতে আছে সামাজিক সম্মিলন ও সমন্বিত ভাবধারা। বাঙালি সংস্কৃতির সামাজিক উপাদানগুলো সংস্কৃতির শক্তিকে বলিষ্ঠতা দিয়েছে। এমনকি ধর্মীয় উৎসব-পার্বণগুলোও পরিণত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির উপাদানে। শুধু তা ই নয় ধর্মীয় উৎসবগুলো আধ্যাত্মিক প্রেরণায় উজ্জীবিত করে মানুষকে। সেই সঙ্গে সামাজিক আনন্দের উজ্জীবনে এবং সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য গঠনেরও প্রেরণা জোগায়। বছর ঘুরে এলেই অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা আর মুসলমান ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ। কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই দুই সম্প্রদায়ের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।

ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর সামাজিক তাৎপর্য ছাড়াও রয়েছে অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও গুরুত্ব। ঈদ ও পূজা উপলক্ষে পোশাক ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য কেনাকাটার প্রস্তুতি, অতিথি আপ্যায়নের ধুমধাম। শহরে আলো ঝলমলে, সুসজ্জিতকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকেন অনুষ্ঠানস্থলের আয়োজকবৃন্দ। সেই সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুষ্ঠানাদি, কার্ড বিতরণ, আলোচনা ও ঘনিষ্ঠজনদের সংশ্লিষ্টতা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। উৎসবকেন্দ্রিক আয়োজন কম নয়। কে কত প্রতিযোগিতাপূর্ণভাবে সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে পারে, বিনোদনের আয়োজনে সফল হতে পারে তার একটি প্রবণতা বা ঝোঁক লক্ষণীয় হয় ওঠে।
ঈদ সামনে রেখে প্রতিবারই ঈদের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে, এতে একই সাথে চাঙ্গা হয়ে ওঠে দেশের অর্থনীতি। পুরো অর্থব্যবস্থা আবর্তিত হয় দেশের সবচেয়ে বড় এ ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতরকে কেন্দ্র করে। গত বছরের ঈদের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ মনে করেন। যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মানোনয়নের ফলে ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন প্রতিবছর বাড়ছে। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠায়। ঈদের সময় বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ বেড়ে যাওয়া গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। চাঙ্গা হয়ে ওঠে ব্যাংকিং খাতও এ উপলক্ষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অন্য সময়ের চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি লেনদেন হয়। অন্য সময় ব্যাংকগুলোতে প্রতিদিন কলমানি লেনদেন হয় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। ঈদ সামনে রেখে প্রতিদিন কলমানি মার্কেটে লেনদেন হয় সাড়ে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। ঈদ যত ঘনিয়ে আসতে থাকে ততই কলমানি মার্কেটে লেনদেন বাড়তে থাকে। অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ, মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকা-ের প্রসারই অর্থনীতির জন্য আয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মুদ্রা সরবরাহ গতিশীলতা আনয়ন করে। ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে যে কোনো ব্যয় অর্থনীতির জন্য আয়। দেশজ উৎপাদনে এর থাকে অনিবার্য অবদান। যে কোনো উৎসব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা আনয়ন করে, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় একটা স্বতঃপ্রণোদিত আবহ সৃষ্টি হয়।

তাই মুসলমানদের জীবনের ঈদের তাৎপর্য অনেক। ঈদ অর্থ খুশি এবং ফিতর এসেছে ফিতরা থেকে। সুতরাং ঈদুল ফিতরের অর্থ দাড়ায় দানখয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত। ঈদুল ফিতরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরস্পরের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য। সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য রমজান মাসে বেশি হারে দানখয়রাত, জাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক তাৎপর্য। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানবসম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। ঈদ-উ-আজহা ও এর ব্যতিক্রম নয়।

আজকের দিনে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য থেকে মানুষ অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষের ফলে গোটা সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান ঈদ নামমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন 'অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।' ঈদের বাজারের দিকে তাকিয়ে দেখালেই বোঝা যায়; সবাই কেমন অসহনীয় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারা অধিক মূল্যবান পোশাক-আশাকে সুসজ্জিত হয়ে সবার দৃষ্টিতে আকর্ষণের চেষ্টা করেন।

পরিশেষে এই বলে শেষ করবো, আল্লাহ রাববুল আলামিন উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্মানিত করে তাদের এ দুটো ঈদ দান করেছেন। আর এ দুটো দিন বিশ্বে যত উৎসবের দিন ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন ও সেরা ঈদ। ইসলামের এ দু'টো উৎসবের দিন শুধু আনন্দ-ফুর্তির দিন নয়। বরং এ দিন দুটোকে আনন্দ-উৎসব এর সাথে সাথে এই আজমান জমিনের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার ইবাদত-বন্দেগি দ্বারা সুসজ্জিত করতে পারলেই ঈদের তাৎপর্য আরো বেশি উদ্ভাসিত হবে।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যি ও কলামিস্ট