বিএনপির পরনির্ভরশীল আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ও বাস্তবতা

মাহবুবুল আলম
Published : 24 August 2014, 06:25 AM
Updated : 24 August 2014, 06:25 AM

রমজানের ইফতার পার্টি কেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিএনপির শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে মধ্যম সারির নেতারা ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলনের যে হুমকি ধমকি দিয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল সত্যি সত্যিই যদি বিএনপি জামায়াত এক হয়ে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে তবে কোন দিকে যাবে দেশের রাজনীতি এ নিয়ে ব্যবসায়ি শিল্পতি থেকে শুরু করে দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ একটা আতঙ্কের ভেতর দিন কাটাচ্ছিল। এর সাথে বাড়তি আশঙ্কা যোগ হয়েছিল সৌদী আরবে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক মিশনকে ঘিরে। এই প্রেক্ষিতে রাজেনৈতিক সচেতন অনেক মানুষই মনে করে ছিল যে, তারেক রহমান হয়তো তার মা বেগম খালেদা জিয়াকে সরকারের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে গিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার পরমর্শাই দিয়ে থাকতে পারেন। সৌদি আরব থেকে ফিরে বেগম খালেদা জিয়া সর্বশক্তি নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, 'আপনারা প্রস্তুত হোন, ঈদের পর সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।' আর বিএনপিতে পদ-পদবী রক্ষায় ব্যস্ত নেতারা বেগম জিয়ার এ নির্দেশনায় আরো এক কাঠি বোড়িয়ে বলেছিলেন, এমন আন্দোলন গড়ে তোলা হবে যে, সরকার ক্ষমতা ছেড়ে পালানোর পথও পাবে না। আর বিএনপির কেন্দ্রিয় নেতা ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মিনুতো আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহেই দিন তারিখ ঠিক করে দিয়ে বলেছিলন ২৫ আগস্টের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটানো হবে। কিন্তু ২৫ আর একদিন পরেই ২৫ আগস্ট। এ সময়ের মধ্যে মিনু সরকার পতনের যে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন তার ই বা কি হবে তা বিএনপির শীর্ষ থেকে প্রান্তিকস্তরের কোন নেতাকর্মীই জানে না।

বিএনপির আন্দোলনের হুমকি যে তর্জন-গর্জন ছাড়া আর কিছুই নয় তা ইতিমধ্যেই দেশের মানুষের কাছে পরিস্কারভাবে ফুটে ওঠেছে। ঈদ হয়ে গেছে প্রায় একমাস হতে চললো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি ঈদের পর কঠোর আন্দোলন দূরের কথা তেমন কোন আন্দোলন কর্মসূচীই ঘোষণা করেনি। তবে সাধারণ নেতাকর্মীরা যাতে হতাশ না হয় সে জন্য সম্প্রতি গাজায় ইসরাইলী হামলার প্রতিবাদে কালো পতাকা মিছিল এবং সম্প্রচার নীতিমালার প্রতিবাদে সমাবেশ কর্মসূচী পালন করে। সেই সমাবেশ থেকেই বিএনপি নতুন আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে এমনটাই মনে করেছিল অনেকেই। কিন্তু নতুন কোন আন্দোলনের কর্মসচি ঘোষণা না করায় বিএনপি নেতাকর্মীরা যারপর নাই হতাশ হয়েছে। তার ওপর চলমান আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২১ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশব্যাপী গণসংযোগের যে কর্মসূচি চলমান সর্বত্রই ফ্লপ হচ্ছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে। ২ মাস আগে থেকেই খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়র নেতারা ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের কথা ধারাবাহিকভাবে বলতে থাকে এবং সরকার পতনের হুমকি দিতে থাকেন। বিএনপি নেতাদের এই হুমকি-ধমকির প্রেক্ষিতে সরকারী দলও বিএনপি কঠোর আন্দোলন শুরু করলে তা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখেন। বিএনপি এখন পর্যন্ত আন্দোলনের কোন কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। অচিরেই যে এমন কর্মসূচি ঘোষিত হবে তাও মনে হচ্ছে না। এতে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ বিশেষ করে ব্যবসায়ি সমাজ অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে বলে মনে হয়।

সরকারের বিরুদ্ধে এখনি কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে বিএনপির মধ্যে দুইটি পরস্পরবিরোধী অংশ কাজ করছে। দলের একটি অংশ এখনই সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে এগিয়ে নিতে চাইলেও বিএনপির অন্য একটি অংশ ও বিএনপি হাইকমান্ড সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা থেকে আন্দোলনের পরিবর্তে সরকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতায় যেতে চাচ্ছে। কেননা তারা মনে করেন বিএনপিকে পরমুখাপেক্ষী আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেরদের শক্তিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জামায়াত ও অন্যন্য উগ্র ইসলামিক দলগুলোর সাহায্যে পরমুখাপেক্ষী আন্দোলনের পরিনতি কি হয় তা তারা ইতিমধ্যেই টের পেয়েছে। তাছাড়া জামায়াত, হেফাজত ও অন্যান্য সরকারবিরোধী ইসলামী দলগুলোও বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের বিরুদ্ধে অলআউট আন্দোলনে যেতে রাজি নয়। তাদের কথা হলো আমাদের কাধে বন্ধুক রেখে বিএনপিকে আর শিকার করতে দেয়া উচিত নয়। বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাও আন্দোলনেও অন্যান্য সব শক্তি সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামলেও বিএনপি নেতারা আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। যার ফলে আন্দোলনতো সফল হয়ইনি, বরং সরকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তিকে ব্যবহার করে ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনও সম্পন্ন করে ফেলে। সে সময় বিক্ষিপ্ত ভাবে কোথাও কোথাও ভীতি সঞ্চার করে, নির্বাচনী কেন্দ্র পুড়িয়ে দিয়ে নির্বাচন ঠেকানো যায়নি। এতে বরং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতাকর্মীরা সরকারী কাজে বাঁধা, ভোট কেন্দ্র আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, হত্যা ও ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়ার মামলায় পর্যুদস্ত। সুতরাং বর্তমান বাস্তবতায় নতুন করে এখনি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলারই নামান্তর। তাই জামায়াত-হেফাজতসহ সরকারবিরোধী ইসলামী দলগুলোর অভিমত হলো জোট প্রধান হিসেবে বিএনপিকেই আগে আন্দোলনের মাঠ গরম করে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তারপর বিএনপির অবস্থা দেখে-শুনে আমরা আন্দোলনে শরিক হবো এর আগে নয়।

এ প্রসঙ্গে দৈনিক জনকন্ঠে ২৩ আগস্ট 'সমঝোতা চায় বিএনপি' শীর্ষক শিরোনামের উপশিরোনাম 'আন্দোলন করে আগামী নির্বাচন আদায়ের পথে হাঁটতে চাচ্ছে না বিএনপি, লক্ষ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ' নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির দুই নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে, …বর্তমান সরকার যেভাবে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে তাতে আন্দোলন করে যে এ সরকারের পতন ঘটানো যাবে না তা দলীয় হাইকমান্ড বুঝতে পেরেছেন। একদিকে জামায়াতসহ বিএনপি জোটের অন্য শরিক দলগুলো আগের মতো আর রাজপথে শক্তি প্রয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। আর বিএনপির নেতাকর্মীদেরও এককভাবে আন্দোলন করে সরকার হটানোর মতো অবস্থা নেই। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আগের মামলার পাশাপাশি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতকেন্দ্রিক মামলাগুলো সচল হবে এ কথা সবারই জানা। আর সরকারের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নতুন করে আন্দোলন শুরু হলেই সেসব মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত করা হবে। তখন আন্দোলনতো দূরের কথা নিজেদের মামলা সামলাতেই নেতারা হিমশিম খাবেন। তাছাড়া আন্দোলনের জন্য দেশে যেরকম পরিবেশ পরিস্থিতি থাকা দরকার বিএনপির জন্য সে অবস্থা এখন নেই। দলের চেয়ারপার্সন নিজে অসুস্থ এবং বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তার স্পর্শকাতর মামলায় অভিযুক্ত থাকায় তার ২ ছেলে সপরিবারে বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসিত।'

বর্তমান এই বাস্তবতা ও পরিস্থিতিতে দলের অন্য কোন নেতার ওপরওই যেন আস্থা রাখতে পারছেন না বেগম খালেদা জিয়া । কেননা তার কাছে নাকি এমনও অভিযোগ আছে যে তার চারপাশে যেসব নেতারা আছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারী দলের কাছে সব ফাস করে দেয়ার আত্মঘাতি কাজে লিপ্ত রয়েছে। আবার দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বাড়াতে গোপনে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সাথে ভালভাবেই তাদের সুসম্পর্ক বজায় রেখে আখের গোছাচ্ছেন। তাই বেগম জিয়া কাউকেই আস্থায় নিয়ে দল গোছানো থেকে শুরু করে আন্দোলনের কর্মসূচি কিছুই গ্রহণ করতে পারছেন না। এ কারণেই দীর্ঘদিন দল চলছে একজন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দিয়েই। ভারপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে ফকরুল ইসলামও তারেক জিয়া ও খালেদা জিয়ার নির্দেশ ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাই কেন্দ্র থেকে শুরু করে সারাদেশের সকল স্তরে এখন দল অগোছালো। সুতরাং দলের এ অবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে এককভাবে অলআউট আন্দোলনে যাওয়ার শক্তি বা ক্ষমতা কোনটাই নেই। আর একটি কথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বিএনপির ইতিহাসে পরনির্ভরশীলতা ছাড়া গণঅান্দোলন দূরে থাক একক কোন আন্দোলনও গড়ে তোলার ইতিহাস নেই।

সুতরাং বর্তমান বাস্তবতা ও পরিস্থিতিতে জামায়াত, হেফাজত ইসলামসহ অন্যান্য সরকারবিরোধী ইসলামী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আর এই সুযোগে শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে সরকার ও দলীয় প্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগকে অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছেন। সরকারী দল আওয়ামী লীগ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্ত অবস্থানে আছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সেই কারণেই হয়তো আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলছেন এবার যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে ৫ বছর মেয়াদ শেষে আবারও একই পদ্ধতিতেই নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে কোন দল আসুক আর না আসুক তাতে আওয়ামী লীগের কিছু আসবে যাবে না।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকারী দল আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক অবস্থা যে নিকট অতীতের যে কোন অবস্থার চেয়ে ভাল তা অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। তারা তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা আগের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সরকারে দলের কিছু সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রী পরিষদে স্থান দেয়ার পাশাপাশি জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জেপির শীর্ষ নেতাদের নিয়ে সরকার গঠন করে আগের সরকারের চেয়েও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের সিনিয়র নেতারা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে নির্বাচনের-আগে পরে সহিংস ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সফর করে নিজেদের অনুকূলে জনসমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পরিশেষে এই বলেই শেষ করতে চাই, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এবং পরবর্তীতে সহিংসভাবে নির্বাচন ঠেকাতে না পেরে বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় রয়েছে। এমতাবস্থায় দলের সকলস্তরের নেতাকর্মীরাই এখন চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। জামায়াতের কারণে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আজ বেকায়দায় পড়েছে মনে করে দলের একটি অংশ আপাতত জামায়াতকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। তাই বিএনপি কৌশলে আপাতত আন্দোলন কর্মসূচী না দিয়ে সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে সারাদেশের সকল জেলা সফর কর্মসূচী শুরু করেছেন ২১ আগস্ট থেকে। এ সফর শেষ হবে ৩১ আগস্ট। এরপর এ কর্মসূচী শেষে ১ সেপ্টেম্বর থেকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচী দিয়ে সময় পার করার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। তারপর কোরবানির ঈদ। কোরবানির ঈদের পর সারাদেশের স্কুল-কলেজে পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তাই এই বাস্তবতায় বিএনপির পক্ষে কঠোর আন্দোলন যে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না তা বোঝার জন্যে কারোই বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।