মওদুদী দর্শনে বিশ্বাসী জামায়াত-শিবিরের সহিংস ও প্রগতিবিরোধী রাজনীতি

মাহবুবুল আলম
Published : 24 Sept 2014, 07:44 AM
Updated : 24 Sept 2014, 07:44 AM

আমি আজকের এ নিবন্ধের শুরুটাই করতে চাই জামায়াতে ইসলামের জন্মইতিহাস থেকে। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ভারতের হায়দারাবাদে পাঠানকোটে আবুল আ'লা মওদুদী জামায়াতে ইসলামী নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনটি জামায়াতে ইসলাম নামে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান নিয়ে সে সময় বেশ আন্দোলন চলছিল। সে আন্দোলনকে আবুল আ'লা মওদুদী ঘোষণা করে 'আহাম্মকের বেহেস্ত বা কাফেরদের রাষ্ট্র হিসেবে। মাওলানা আবুল আ'লা মওদুদী অনুসারি ছিলেন জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামক রাজনৈতিক দলটির। মওদুদী কতটা মুসলিম লীগ বিরোধী ছিলেন তা বোঝা যায় জামায়াতে 'ইন্তেখাবী গ্রন্থে'। তিনি মুসলিম লীগ সম্পর্কে বলেছিলেন,'ওরা পরিবেশকে পায়খানার চেয়েও খারাপ করে ফেলেছে। এ ছাড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহরও ঘোর সমালোচক ছিলেন মওদুদী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা যখন প্রায় নিশ্চিত ওই সময়ে মাওলানা আবু আ'লা মওদুদী বলেছিলেন,'ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে এই মুহুর্তে বেশী প্রয়োজন হলো এখানে হুকুমতের আইন প্রতিষ্ঠা করা।' স্বাধীনতার কয়েক দিন আগে ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পাটনায় জামায়াতের সম্মেলন করেন মওদুদী। স্বাধীনতার পর আগস্ট মাসেই মওদুদী পাকিস্তানে ফিরে এসে লাহোরে একটি বস্তিকে 'দারুল ইসলাম' ঘোষণা করে সেখানে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। এখান থেকেই দল পরিচালনা করে তিনি উগ্রবাদী বইপুস্তুক প্রকাশ করতে থাকেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াত শাখার আহ্বায়ক করা হয় খুররম শাহ মুরাদকে। মাওলানা আব্দুর রহিম, ব্যারিষ্টার কোরবান আলী ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। আব্দুর রহীম কারমাইকেল কলেজ থেকে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন গোলাম আযমকে। '৬৬তে আওয়ামী লীগের ৬ দফার তীব্র বিরোধিতা করে জামায়াত। ৭০-এর নির্বাচনে জামায়াত পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি আসনে জয়লাভ করে। একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে সারা দেশব্যাপী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী গঠন করে গণহত্যা চালায়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল যখন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রবাসী সরকার গঠন করে তখন জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় ঘোষণা দিয়ে 'শান্তি বাহিনী'র কার্যক্রম শুরু করে। তাদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত, আব্রু হরণ করে, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে বাংলাদেশে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল।

স্বাধীনতা লাভের পর দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে জামায়াত নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস ও বিয়োগান্তক হত্যাকান্ডের পর জিয়াউর রহমানের আর্শীবাদে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসে যুদ্ধাপরাধীদের এই দলটি। প্রথম ইসলামিক ডেমোক্রেটিক দলের হয়ে কাজ চালায় তারা। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে কয়েকটি পদে জয়লাভ করে আইডিএল। ওই বছরেই জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এসে আইডিএল ভেঙ্গে গঠন করেন 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ'। ভারপ্রাপ্ত আমির নির্বাচিত হন ঘাতক আব্বাস আলী খান। একে একে দলে চলে আসেন ঘাতক যুদ্ধাপরাধী সব জামায়াত নেতাই।

দেশ স্বাধীন হবার পর দেশে প্রত্যাবর্তন করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা ও পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সহযোগীশক্তি হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে হত্যা রাহাজানী, অগ্রিসংযোগ, ধর্ষণ, লুটতরারাজের মতো কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত করেছিল তার বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। তাদের বিচারের জন্যে ১৯৭৩ সালে দালাল আইন তৈরি করে তাদের বিচারও শুরু করেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সে বিচার বন্ধ করে দিয়ে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামকে পুনর্বাসিত করেন। এই ধর্মীয়গোষ্ঠী যদি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা না করতো, তাদের পক্ষে অস্ত্র না ধরত তা হলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে এত প্রাণক্ষয় হতো না। তা ছাড়া স্বাধীনতার পরপর এরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নাশকতা সৃষ্টি করে চলেছিল। এমনই বাস্তব অবস্থা উপলব্দি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ওইসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন সে দলগুলো হলো- জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম।

কিন্তু স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে তিন বছর যেতে না যেতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে, জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখল করেন এবং 'হ্যা' 'না' ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তথাকথিত নতুনধারার রাজনীতি চালুর নামে স্বাধীনতা বিরোধী ওইসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। এবং 'মানি ইজ নো প্রোবলেম' ও 'আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পরিটিশিয়ান' থিউরির মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিন্ন করার লক্ষ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তোষণে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদও তার পূর্বসুরির পথ অনুসরণ করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করার খেলায় মেতে ওঠেন। এভাবেই দেশে আবার নিষিদ্ধঘোষিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরুত্থান ঘটে। জিয়া, এরশাদ ও বেগম জিয়ার আমলে পবিত্র ও শান্তির ধর্ম ইসলামকে পূঁজি করে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে এরা দলকে যেমন মজবুত আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে, পাশাপাশি নিজেরাও গায়ে-গতরে মোটাতাজা হয়ে ওঠেছেন। এদের পক্ষে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ও খারাপ কাজটি করেছেন জিয়া পতœী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যুদ্ধাপরাধী, নিজামী, মুজাজিত ও কামরুজ্জামানের মতো কুখ্যাত রাজাকারকে মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্ত¯œাত পতাকা। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনীতির সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সংস্কৃতিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে অবৈধ উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজের প্রভাব বিস্তারে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের এ সুদূরপ্রসারি লক্ষ্যপূরণে প্রথমেই বেছে নেয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতকে। প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারী ব্যাংক-বীমাসহ দেশের আনাচে-কানাচে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার শুরু করে; পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাখাতে ক্লিনিক, ডায়গোস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে যেমন দলের ফান্ডকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তোলা হয়েছে অন্যদিকে সেসব প্রতিষ্ঠানে অসহায় বেকার যুবক ও যুবমহিলাদের চাকুরী দিয়ে তাদেরকে জামায়াতে ইসলামের ভাবাদর্শে গড়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষাখাতে প্রান্তিক পর্যায়ে কিন্ডার গার্টেন স্কুল গ্রামে-গঞ্জে প্রাইভেট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের বর্তমান প্রজন্মকে ব্রেনওয়াসের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাবধারার পরিপন্থী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলেছে। এই সময়ে জামায়াতে ইসলামের তত্ত্বাবধানে সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠার গতিকেও বেগবান করা হয়। তাই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাখাতে জামায়াতে ইসলামের একচেটিয়া রাজত্ব। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে তাদের একচেটিয়া প্রাধান্যের কারণে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল ব্যারিস্টার ও সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারে নিজেদের মতাদর্শের লোকদের কর্মসংস্থানের নামে তাদেরকে পরোক্ষভাবে জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। অনেকে আবার বোঝে বা না ঝোঝেও জামায়াতের ফাঁদে পা দিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থক হতে বাধ্য হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী শিক্ষা খাতে তাদের জাল এতটাই বিস্তার করেছে যে, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তাদের প্রকাশ্য বা গোপন সংগঠন ও মতাদর্শের লোকজন নিয়োজিত আছে। আর জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরেই তাদের নেটওয়ার্কের জাল বিস্তৃত হয়েছে যার ফলে কিছুতেই রাষ্ট্র বা প্রশাসনের সিক্রেসি রক্ষা করা যাচ্ছে না। তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আগেবাগেই সব গোপন খবর জেনে যাচ্ছে। এই গোপন খবরা-খবর জানার জন্যে শুধু প্রশাসনেই নয় বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো দলেও লেবাস পাল্টে এজেন্ট ঢুকিয়ে রেখেছে।

পবিত্র ইসলাম ধর্মকে পূঁজি করে জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে রাজনীতি করে আসছে তার জন্মলগ্ন থেকে। আল্লার আইন কায়েমের নামে ধোঁকাবাজির রাজনীতি করলেও একমাত্র লেবাস ছাড়া তারা নিজেরা ও পরিবারের সদস্যদের অনেকেই ইসলামী লাইনে লেখা পড়া না করে আধুনিক ও বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পশ্চিমা ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে চলেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার করিব পাকিস্তানকে নিয়ে একটি মূল্যবান ডকুমেন্টারী বানিয়েছেন। সেখানে তিনি মওদুদীর এক পুত্রের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন, সেই সাক্ষাতকারে মওদুদী পুত্র বলেছেন, তার বাবা তাদের জামায়াতে ইসলামের ধারে কাছেও ভিড়তে দেননি। বরং তিনি বলেছেন, জামায়াতি ইসলামী থেকে দূরে থাকতে। তাদেরকে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত না করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলতে নাছারাদের দেশে পাঠিয়েছেন। মওদুদীর পুত্রই জমায়াতি ইসলামীর অনুসারিদের ধোঁকাবাজ বলে অভিহিত করেছেন। যে জামায়াতে ইসলামের নেতাদের ছেলে-মেয়েরাই ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে সেখানে জামায়াতে ইসলামী আমাদের দেশের ধর্মভীরু গরীব ঘরের ছেলে-মেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে ওয়াজ নসিহত করছেন।

এখন আবারও একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক মওদুদীর ইসলাম দর্শন বিষয়ে। আল্লাহ ও ফেরেস্তাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন ইসলাম ধর্মের প্রতি আঘাতেরই শামিল। কেননা, সারা বিশ্বের মুসলমানরাই ফেরেস্তাদের মানে। কিন্তু মওদুদী বলেন,'ফেরেস্তা হলো ভারতের এবং গ্রীসের দেববেীর অনুরূপ।।' তাছাড়া মওদুদী খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এবং সাহাবাদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কটুুক্তি করতেও দ্বিধা করেননি। তিনি একদা দাবী করেছিলেন ইসলাম হলো ফ্যাসিজম। শুধু তা ই নয় আমাদের প্রিয় রসুল (স) সম্পর্কেও অবমাননাকর কথা বলেছেন। যা তাহহিমুল কোরআনের ১৮ খন্ডে বর্ণিত আছে। একই সাথে হযরত দাউদ সম্পর্কেও তিনি আপত্তিকর কথা বলেছেন। এবং দাসীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে বলেও ফতোয়া দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণ শরিয়তের পরিপন্থী জেনা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। মওদুদী বলেছেন, কোরআন ও সুন্নাহ অনুসারে নারী সংসদ দূরে থাক সরকারী কোন দায়িত্বপূর্ণ পদেও তারা যেতে পারবে না। তার এ মতবাদ অনুযায়ি নারী নেতৃত্ব না জায়েজে। কিন্তু আমাদের দেশে মওদুদীর শিষ্য গোলাম আযমদের কাছে খালেদা তাদের নেতা ও তারা প্রায়ই বিভিন্ন জনসভায় খালেদা জিয়ার পায়ের কাছে বিশেষ প্রাণীর মতো বসে থাকে ক্যুই ক্যুই আওয়াজ তুলে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন।

মওদুদীর আরেকটি মতবাদ হলো যারা জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কীত নন বা জামায়াতে ইসলামী করেন না তারা জান্নাতবাসী হবেন না। তারা মুরতাদ, তাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তাই আমাদের দেশের বাচ্চা জামায়াতরা তাদের ধর্মগুরু আবুল আ'লা মওদুদীর সব দর্শন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। শিবির বা বাচ্চা রাজাকাররা আমাদের দেশে যে রগকাটার রাজনীতির চালু করেছে তা তাদের শেখা মওদুদীর কাছ থেকেই। এ রগ কাটাকে তারা মহানবী (স) সময়ের ঘঁনা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। সাহবারা যখন ইসলাম প্রচারে যেতেন তখন ইসলামের শত্রুরা তাদের উটের পায়ের রগ কেটে দিত। সে সময়ে ইসলামের শত্রুরা যেসব অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতো এখনো আমাদের দেশের জামাতিরা সেসব অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার থাকে। তরবারী, ছোড়া , চাপাতি এবং আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ইসলামের প্রাগৈতিহাসিক সময়ের সব কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমান বাংলাদেশসহ পরিবর্তনশীল বিশ্বে জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে যতটা চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন; প্রতিষ্ঠা লাভের পর এ ধর্মভিত্তিক দলটি আর এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি। এ দলটি বর্তমানে ঘরে-বাইরে একা ও চাপের মুখে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় পথম সারির নেতাদের বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তাই তারা এ বিচার বানচাল করতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। এ জন্য তারা বেছে নিয়েছে সহিংসতা ও নাশকতার পথ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ ও দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য দেশব্যাপী পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমন, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্রিসংযোগসহ সৃষ্টি করছে নাশকতামূলক কর্মকান্ড। অগণতান্ত্রিক এসব ধ্বংসাত্বক ও নেতিবাচক কর্মকান্ডের জন্য দেশীয় মিত্রসহ সমর্থন হারাচ্ছে আন্তর্জাতিক মিত্রদের সমর্থনও। মুক্তিযুদ্ধেও চেতনার ধারক তরুণ প্রজন্ম জামায়াত-শিবিরের এসব সহিংস ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ডে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে রাজপথে নেমে এসেছে। তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবির এখন প্রবল প্রতিরোধের সন্মুখীন। এমতাবস্তায় দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠেছে।

বিগত চারদলীয় জোটের শাসনামলে দুধে-কলায় যেভাবে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠেছিল। ভাগ পেয়েছিল ক্ষমতারও। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে জামায়াতে ইসলাম কৌশলগত কারণে তাদের দলের ভেতরই যে সমস্ত উপ-সংগঠন গঠন করে বাংলাদেশেকে জঙ্গীরাষ্ট্রে পরিনত করতে চেয়েছিল সেসব সংগঠনের মধ্যে হিজবুত তাওহীদ, আল্লার দল, তওহীদি ট্রাষ্ট, হিজবুত তাহরীর, তামির উদ দীন, বাংলাদেশ ইসলামী সমাজ, উলামা আহঞ্জুমান, আল বাইয়্যানিয়াত, ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি ইত্যাদি। এর বাইরেও তানজিম ইসলামী, ইসলাম ও হরকাতুল মুজাহেদীন, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী দাওয়াত ই কাফেলা, মুসলিম মিল্লাত, শাহাদাৎ ই নবুয়ত, হিজবুল্লা শরিয়া কাউন্সিল, জইশে মোস্তফা, তওহীদি জনতা ও আল তুরাসহ বেশ কিছু সংগঠন এখনো গোপনে আল কায়দা ও আইএস এর মতো সংগঠনের সাথে যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশকে জঙ্গীদের ঘাটি হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার জঙ্গীবিরোধী ভূমিকার কারণে তারা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু তাদের অপচেষ্টা এখনো বন্ধ হয়নি বরং তা জোরদারের মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে তাদের সেই রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। সেই চারদলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির ভোটের রাজনীতির হিসেব-নিকেষের কারণে প্রাণে-প্রাণে ভালোবাসার সম্পর্ক আগলা হয়ে যেতে শুরু করেছে। শুরু হয়েছে বিএনপির সাথে নানা টানাপোড়েন। কিন্তু তবু তারা জোট ছাড়তে পারছে না। জোটের প্রধান শরিক বিএনপির ভিতরে জামায়াতবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়ে ওঠেছে। সারা দেশে জামায়াতবিরোধী মনোভাব আরও চাঙ্গা হয় ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে। সে সময় তারা ১৮ দলীয় জোটের কাঁধে চড়ে বিশেষ করে জোটের প্রধান দল বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির আড়ালে পুলিশের ওপর আক্রমণ, জ্বালাও-পোড়াও পেট্টোলবোমা মেরে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, লুটপাটসহ সারাদেশে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাই বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক শান্তিপ্রিয় মানুষ জামায়াত-শিবির ও বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ৫ জানুযারি ২০১৪'র সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। তাই এখন তারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে বাংলাদেশের রাজনীতির পালাবদলের জন্যে নানামুখী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশের বাইরেও জামায়াত-শিবিরের সহিংস রাজনীতির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের তালিকায় জামায়াত-শিবির একটি মৌলবাদী দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সেইসব দেশ এখন তাদের এড়িয়ে জলছে। আমেরিকা দূতাবাসের সাথেও এখন নেই এ দলটির দহরমমহরম ও গলায় গলায় ভাব। আমেরিকাও এখন তাদের সন্দেহের তালিকায় দেখছে। আগে যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছিল জামায়াতে ইসলামের দুর্গ ও ডোনার সেখানেও তাদের অবস্থা এখন নড়বড়ে। আর আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের কারণে জামায়াতের ইসলামীর জন্মস্থান পাকিস্তানে ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক জঙ্গিদল এখন কোণঠাসা। সেখানেও পিপলসপার্টিসহ সরকার জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে জামায়াতে ইসলামের লেজে-গোবরে অবস্থা এর জলন্ত প্রমাণ যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল বিভাগের ফাঁসির রায় কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ডের প্রতিবাদে ১৮ ও ২১ সেপ্টেম্বর দুই দিনের টানা ৪৮ ঘন্ঠার হরতাল ফ্লপ হওয়া। এই দুই দিনের হরতালে মানুষের জীবনযাত্রা অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক ছিল। । সব মিলিয়ে এ ধর্মভিত্তি ফ্যাসিষ্ট দলটি এখন কঠিন সময় পাড় করছে। ক্রমেই সংঙ্কুচিত হয়ে আসছে তাদের পৃথিবী।