জামাতি মানিমেশিন কাশেম আলীর ফাঁসির রায় ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ পাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুমকি

মাহবুবুল আলম
Published : 4 Nov 2014, 08:09 AM
Updated : 4 Nov 2014, 08:09 AM

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষনেতা তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক, জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৪টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা ,অপহরণ নির্যাতনের ১০টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। দুই অভিযোগের মধ্যে একটিতে সর্বসম্মতিতে আরেকটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। অপর ৮টি অভিযোগে সর্বমোট ৭২ বছর করাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বাকি ৪টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল এই ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্নপ্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জামায়াতের শূরা সদস্য ও জামায়াতের মানিমেশিন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদর মহলে বাঙালী খান হিসেবে উপাদি পাওয়া কুখ্যাত আলবদর নেতা কাশেম আলীকে চার্জ ১-খালাস, চার্জ ২- ২০ বছর কারাদণ্ড, চার্জ ৩- ৭ বছর কারাদণ্ড, চার্জ ৪- ৭ বছর কারাদণ্ড, চার্জ ৫- খালাস, চার্জ ৬- ৭ বছর কারাদণ্ড, চার্জ ৭- ৭ বছর কারাদণ্ড, চার্জ ৮- খালাস, চার্জ ৯- ৭ বছর কারাদণ্ড, চার্জ ১০ ৭ বছর কারাদণ্ড, চার্জ ১১- সর্ব-সম্মতিতে মৃত্যুদণ্ড, চার্জ ১২: সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে মৃত্যুদণ্ড, চার্জ ১৩- খালাস, চার্জ ১৪- ১০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।এই রায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক কতটা উল্লসিত হয়েছে, তা কাল সারাদিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের কল্যাণে দেখতে পেয়েছে দেশের মানুষ। মানুষ শুধুমাত্র উল্লাস বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি; তারা অনতি বিলম্বে এ পর্যন্ত যত রায় হয়েছে তা অতি দ্রুত বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত ও অভিহিত জামায়াতে ইসিলামকে নিষিদ্ধ করে, তাদের সব সম্পদ ও অর্থবিত্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার ও দাবি জানিয়েছেন। যাক আমার এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু এটা নয়। তাই কলেবর না বাড়িয়ে মূল আলোচনায় ফিরে আসি।

৩ নভেম্বর ২০১৪ দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত সুমি খানের 'ফাঁসির রায়ের পরও মীর কাশেমের ঔদ্ধত্য' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কাশেম আলীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ নিয়ে বলে বলেছেন' ঠাট্টা তামাশার মেজাজে কাঠগড়ায় উঠলেন ঘাতক মীর কাশেম। রায় ঘোষণার মুহূর্তে সেই চনমনে মেজাজের চোখ ঠাণ্ডা খুনীর চোখে পরিণত হলো। বেলা দশটা ৪২ মিনিট। বেশ ফুরফুরে মেজাজে কাঠগড়ায় উঠেছেন নীল শার্ট ও অফ হোয়াইট কোট, কালো প্যান্ট কালো জুতো পরা বেশ স্যুটেড ব্যুটেড মীর কাশেম। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁর সিকিউরিটিতে থাকা ধানমণ্ডি থানার ওসিসহ অন্য পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে ঠাট্টা মস্করা করতে থাকেন। আঙ্গুল দিয়ে মুখ দেখিয়ে বলেন, 'মুখে টেপ লাগিয়ে কথা বলব।' এর ১০ মিনিট পর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন বিচারকের আদালত বসার পর ডান হাঁটুর ওপর বাঁ পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বাঁ হাঁটুর ওপর বাঁ হাতের আঙুল নাচাতে থাকেন। ১১টা থেকে বিস্তারিত রায় শুনতে শুনতে কাশেমের চেহারায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে। বাঁ হাতের তর্জনী উঠে যায় বাঁ গালে। ট্রাইব্যুনাল-২ চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়তে পড়তে সাড়ে ১১টায় দুটি অভিযোগে মীর কাশেমের মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতার ভঙ্গিতে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বলে 'রক্তচক্ষু' মীর কাশেম আদালতকে বললেন 'শয়তান…!' এক মিনিটের মধ্যে দ্বিতীয়বার বলে উঠলেন … …'শয়তান…!! কিছুক্ষণ নীরব থেকে অস্থির হয়ে বলে উঠলেন 'মিথ্যা ঘটনা… মিথ্যা শাস্তি ..কালো আইন টিকবে না…।'

প্রিজনভেনে ওঠার সময় দু'হাত উচিয়ে 'ভি' চিহ্ন যে দৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেছে তার এমন উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ নিয়ে দেশপ্রেমিক বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে তারা সারাদিন বিভিন্ন চ্যানেলে জামায়াতিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, এই আলবদর কমান্ডারের দ্রুত ফাঁসির রায় কার্যকর করে বুঝিয়ে দিতে হবে তার মতো ঘৃণ্য অপরাধীর বাংলাদেশের মাটিতে এক মুহূর্তও শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার অধিকার নেই।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত কেবলমাত্র পাকি দোসরদেরই ঐদ্ধাত্যপূর্ণ আচরণ শেষ কথা নয়। তাদের পিতৃভূমি পাকিস্তানও যুদ্ধাপরাধের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশকে হুমকী ধমকী দিয়ে চলেছে। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর পরই পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে রায়ের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে। পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলাম কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, শেখ হাসিনার সরকার পাকিস্তানের বন্ধুদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি দিয়ে আমাদের ইগোতে আঘাত হানছে। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছিল। গোলাম আযমের মৃত্যুতে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলাম গায়েবানা নামাজ শেষে বলেছে, এর জন্য শেখ হাসিনাকে চরম মূল্য দিতে হবে।

আবার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হুমকী দিয়ে বলেছে 'একাত্তরের আগে ও পরের যে কোন বিষয়ে পাকিস্তান তার অবস্থানেই আছে। পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিক এ ধরনের অন্যায় বিচারের প্রতিবাদ জানাচ্ছে'। এই মন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরকে পাকিস্তানের পরীক্ষিত বন্ধু বলে অভিহিত করে এ বিচার বন্ধের জন্য হুশিয়ারী উচ্চারণ করে। রাজাকার তার উত্তরসূরিরা বিচার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করলেও তাদের পক্ষে পাকিস্তানীদের জোরালো অবস্থানই দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ম্যাসাকারে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী লক্ষ লক্ষ অপরাধ সংগঠিত করেছিল।

পরিশেষে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এটা একাত্তর নয়, ২০১৪ সাল। একাত্তরে আমরা যেভাবে তাদের ও তাদের প্রভুদের পরাজিত করেছি ২০১৪ সালেও ওইসব ঘৃণ্য অপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে বাংলাদেশ অভিশাপমুক্ত হবে। তাই 'ভি' চিহ্ন দেখালে একমাত্র আমারই দেখাতে পারি; পরাজিত পাকিদের দোসররা নয়।