সারাদেশেই ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে টালমাটাল আওয়ামী লীগ

মাহবুবুল আলম
Published : 25 Nov 2014, 09:14 AM
Updated : 25 Nov 2014, 09:14 AM

আমার আজকের এ লেখায় আমি এখন আলোচনা করতে চাই বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগের সারাদেশেই ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে টালমাটাল অভ্যান্তরিণ বিষয় নিয়ে। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ ও টকশো' প্রর্যালোচনা করে যা বোঝা যাচ্ছে তাতে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আওয়ামী লীগের সর্বস্তরেই এখন অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে। সরকারী দল আওয়ামী লীগের মধ্যে যে অসন্তোষ ক্রমেই দলা পাকাচ্ছে, তা ব্যাপকভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়ছে সারা দেশে। এখন ঘরের আগুনে পুড়ছে শাসক দল আওয়ামী লীগ! পদ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সৃষ্ট দলীয় অন্তর্কোন্দলে রক্তপাত যেন থামছেই না। আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, অন্তর্দলীয় কোন্দল আর ক্ষমতার লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগই। যাকে বলে ঘরের শ্রত্রু বিভীষণ। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের ওপর যেন নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলেছে তৃণমূলে সংগঠিত এ দলটি। দলের শুভকাঙ্খিরা মনে করেছে এতে 'দলের চেইন অব কমান্ড' ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত ক্ষমতার মোহে যে কোন মূল্যে পদ আঁকড়ে রাখার মানসিকতার প্রতিযোগিতায় সারাদেশেই সৃষ্ট দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিব্রতকর অবস্থায় সরকারকে। বর্তমানে বিরোধী বিএনপি-জামায়াতের জোরালো কোন আন্দোলন নেই। তা সত্বেও সরকারী দল ও সহযোগী সংগঠনের কর্মকাণ্ড আর মন্ত্রী, এমপিদের একের পর এক লাগামহীন বেফাঁস মন্তব্য চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে সরকারকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে দলের ভেতর থেকেই।

বাংলাদেশের প্রচীণ ও ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে আওয়ামী লীগে দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় নিজেদের দীর্ঘদিনের একক সাম্রাজ্য ধরে রাখতে যুবলীগ-ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহারের কারণেই থামানো যাচ্ছে না সংঘাত, সংঘর্ষ, ও প্রাণহানীর ঘটনা। আওয়ামী রাজনীতির আদর্শহীন ওয়ানটাইমার নেতা-কর্মীদের ভিড়ে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করার কারণে অন্তর্কলহ দিন দিন বাড়ছেই।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে দেশব্যাপী সৃষ্ট আওয়ামী লীগের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মূলে রয়েছে পদ আর ক্ষমতার মোহ। ভাল পদ পদবী আকড়ে ধরে থাকতে না পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য, তদ্বির, বদলি, দখল, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিও করা যায় না। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও দলের প্রভাবশালী নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার আর প্রশ্ন বানে প্রায়শই বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে সরকারকে।

জানা গেছে, সর্বশেষ সিলেট-নান্দাইল-কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংঘাত-সংঘর্ষে তিনজনের প্রাণহানির ঘটনায় চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে শাসক দলটিকে। 'সংঘর্ষে জড়িত কেউ দলের কেউ নন, বহিরাগত'- প্রতিটি ঘটনার পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে একথা বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হলেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এমন প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটছে। এসব সংঘাত-সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত যে-ই হোক তাকে দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্যও ইতোমধ্যেই সরকারের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে।

দলের এ অবস্থা সামাল দিতেই ডিসেম্বরের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে সারাদেশে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। এমনকি নিজে প্রথম তাঁর ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে সারাদেশে সম্মেলনের সবশেষ প্রস্তুতিও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছ থেকে জানেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা মেয়াদোত্তীর্ণ সকল জেলা ও মহানগর কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে নতুন কমিটি গঠন করতে যেয়েই প্রকট হয়ে ওঠেছে দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও হানাহানী। কোথাও একযুগ, বা ৬-৭ বছর পর জেলা বা মহানগরের সম্মেলনেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে কোন পরিবর্তন না হওয়ায় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। দলীয় কাউন্সিল ঘিরে অনেক স্থানেই দলের শীর্ষ নেতাদের সামনে পদপ্রত্যাশী বিবদমান দু'গ্রুপের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেও দেখা গেছে।

এছাড়াও মূল দল আওয়ামী লীগের বাইরে বিভিন্নস্থানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘাত-সংঘর্ষের মূল কারণই হচ্ছে আধিপত্য বিস্তার আর কমিটির পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা। দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোতেও সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর এই সম্মেলনের শুরু হতেই নতুন কমিটিতে ঢোকার লড়াইয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আর আওয়ামী লীগের প্রভাশালী নেতারাও একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে তুলতে সহযোগী সংগঠনকে ব্যবহার করতেও দ্বিধা করছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অনেক ভাল পদক্ষেপে সরকার যখন সব কিছুই গুছিয়ে ওঠতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই সরকারী দলের কিছু নেতার অতিকথন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংগঠনের শৃংখলা বিরোধী কর্মকান্ড সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সরকারের সকল অর্জন ম্লান হচ্ছে। অনেকের মতে এসব কোন্দল, দ্বন্দ্ব আওয়ামী লীগের নৌকা ডুবানোর আত্মঘাতি খেলায় মেতে ওঠেছে। সুতরাং সময় থাকতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এর জন্য সরকারকে চরম মূল্য দিকে হতে পারে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মাত্র কয়েক মাসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন একজন। অস্থিরতা সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। ছাত্রলীগের এই কর্মকান্ড থামাতে না পারলে সরকারের সব অর্জন ধূলিষ্যাৎ হয়ে যেতে পারে এমন মত আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতার। এ নিয়ে তারাও বেশ ক্ষুব্ধ ও বিব্রত। দলের সিনিয়র নেতারা মনে করেন, সময় থাকতেই ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সরকারকেই এর মাসুল দিতে হবে।

পরিশেষে এই বলেই শেষ করবো, সরকারী দল আওয়ামী লগের ঘরে যে আগুনের সূত্রপাত হয়ে ধোঁয়া ছড়াতে শুরু করেছে তাতে সরকার যদি ধোঁয়া দেখেও না দেখার ভান করে থাকে, এক সময় এ ধোঁয়ার কুন্ডলী ভেদ করে আগুনের লেলিহান শিখা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। ধোঁয়া দেখে আগুনের আলামত বোঝতে যদি সরকার অবহেলা করে, তবে এক সময়ে এসে সে আগুন নিয়ন্ত্রনের বাইরেও চলে যেতে পারে।