আলোর পাখিরা একে একে চলে যায়

মাহবুবুল আলম
Published : 4 Dec 2014, 12:02 PM
Updated : 4 Dec 2014, 12:02 PM

"আলোর পখিরা একে একে চলে যায়" এটা আমার একটি কবিতা শিরোনাম। এর কিছু পঙক্তি এরকম 'আলোর পাখিরা একে একে নিরুদ্দেশে চলে যায়;/ চলে যায় একেবারে না ফেরার দেশে,/আসেনা ফিরে আর এই তল্লাটে/… আলোর পাখিরা দূরদেশে চলে যায়/আঁধার তাড়াবে কে/ এমন সারথী খুঁজে ফিরি কত পাইনা কোথাও খোঁজে/চারপাশে শুধু কপট মানুষ /মুখে তাদের ভয়ঙ্কর দুঃর্গন্ধে ঠাসা;/আলোর পাখিরা ফিরে এসো/আলো নিয়ে আঁধারের পুরবাসে…।

আমার এ কবিতার আলোকেই আমার আজকের লেখার এই শিরোনাম। কেননা, বাংলাদেশে সৎ, সাহসী ও ভাল মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে স্বার্থপর নেতিবাচক চিন্তা-চেতনার মানুষের সংখ্যা। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী মুক্তবুদ্ধি, দেশপ্রেমিক কিছু মানুষ ইতমধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ, দেশ গঠনে যাদের অবদান চির স্মরনীয় হয়ে থাকবে। মাত্র পনের বিশ দিনের ব্যবধানে চলে গেলে বেশ কয়েকজন মুক্তবুদ্ধি চিন্তা-চেতনার মানুষ। তাঁদের প্রয়াণে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। ২৯ নবেম্বর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী। রাজধানীর কাওরানবাজারে বাস চাপায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর এই অকাল প্রয়াণে দেশের সাংবাদিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রেই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

এর একদিন পরই চলে যান শিল্পী, সাহিত্যিক কাইয়ুম চৌধুরী। বেঙ্গল উৎসবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে হঠাৎ করেই মঞ্চে লুটিয়ে পড়েন উপমহাদেশের খ্যাতিমান এই চিত্রশিল্পী। হঠাৎ করে এভাবেই যে তিনি চলে যাবেন কেউকখনো ভাবেনি। দেশপ্রেমিক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার এই মানুষটির কাছে আরও অনেক প্রত্যাশা প্রাপ্তি ছিল এ দেশের মানুষের। কিছু দিন নীরবে-নিভৃতে চলে যান খ্যাতিমান সাংবাদিক এবিএম মূসাও। সাংবাদিকতায় বর্ণময় অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ সাংবাদিক পেশায় তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকেছেন প্রায় ৬০ বছর ধরে।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরীও নেই। ৮৮ বছর বয়সে মারা যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস এই অধ্যাপক। ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস ও বাংলার ইতিহাস গবেষণায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও বিদায় নেন অনেকটা দেশের একটা অস্থির সময়ে, যখন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। শিক্ষাক্ষেত্রে যে অবদান তিনি রেখে গেছেন, এ জন্য বাঙালি জাতি তাঁর কাছে চির ঋণী। আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠায় তিনি আরও অনেক অবদান রাখতে পারতেন।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশা করে যিনি আমাদের গৌরবের সারাজীবনের জন্য সম্মানের ও গৌরবের আসনে বসিয়েছিলেন তিনি হলেন স্থপতি মঈনুলিইসলাম । তাঁর হঠাৎ করে চলে যাওয়ার ক্ষতি যেন পূরণ হবার নয়। দেশ, জাতি ও মুক্তিযুদ্ধকে কতটা গভীরভাবে নিজের আত্মায় ধারণ করে জাতীয় স্মৃতিসৌধের যে নকশা তিনি প্রণয়ন করেছেন তা তাঁর সৃজনশীল কর্মের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এ ছাড়াও চলতি বছরের আট অক্টোবর চিরবিদায় নেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন। ৮৮ বছরের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রগতিবাদের পক্ষে লড়াই চালিয়ে চিরবিদায় নেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এই সংগঠকআবদুল মতিন। সারা বাংলাদেশ যাকে চেনে ভাষা মতিন নামে। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ যেন মেনে নেয়ার মতো নয়। দেশ- বিদেশের লাখো কোটি ভক্ত-অনুরাগী তাঁকে খুঁজে ফিরে। একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ ১৯ অক্টোবর হঠাৎ করেই পরপারে চলে যান। ২০১১ সালে জাতীয় অধ্যাপক হন সালাহউদ্দীন আহমদ। যাকে বলা হয় ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী। অনেক আগেই মারা যান শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তারপর কবি সুফিয়া কামাল, ভাষার কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী, স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান।

এভাবেই একে একে চলে যাচ্ছেন দেশের খ্যাতিমান উজ্জল নক্ষত্র আলোর মানুষগুলো। তাদের চলে যাওয়ায় দেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ও দেশপ্রেমিক মানুষের বড় অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব মুক্ত চিন্তার দেশপ্রেমিক মানুষগুলো তাঁদের কর্মে, চিন্তা ও মননে বাংলাদেশকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। তাদের চির বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে মেধার সঙ্কটও দেখা দিচ্ছে। শিক্ষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, রাজনীতি, সাংবাদিকতা, ইতিহাস চর্চা, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ, বিজ্ঞান, গবেষণা, শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে সবখানেই যেন ধাক্কা আসছে। ইতিহাস বিকৃতি রোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আলোকিত মানুষগুলোর কোন বিকল্প ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠায় এবং সত্য–শুদ্ধতার যেন অভাব দেখা দিয়েছে হঠাৎ।

এই বলেই শেষ করবো মৃত্যুর অমোঘ নিয়মে আলোছড়ানো মানুষগুলো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও আমাদের মাঝে বিকিরণ করে করে গেছেন তাঁদের আদর্শ, চিন্তা-চেতনা জ্ঞানের প্রজ্জোলিত শিখাকে। তাই আমাদের এখন প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত, আমরা এসব মহাগুণী ও জ্ঞানীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিনত করবো; যাতে তাদের আত্মারা শান্তি পায়।