কত রঙ্গ জানরে বন্ধু কত রঙ্গ জান

মাহবুবুল আলম
Published : 7 Jan 2015, 04:34 PM
Updated : 7 Jan 2015, 04:34 PM

৫ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সাবেক বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে দেশেবাসী যে অজনা আতঙ্কের মধ্যে ছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে। সেদিন সারা দেশে বিচ্ছিন্ন দু'একটি ঘটনা ছাড়া বড় তেমন কোন নাশকতা বা অরাজগতার ঘটনা ঘটেনি। তবে বিএনপি-জামায়াতের বিশেষ করে শিবিরের নৃশংসতায় হামলায় প্রাণ গেল চারজন সাধারণ নাগরিকের। আমরা সাধারণ পাবলিক নিহত চারজনকে সাধারণ নাগরিক বললেও নিহতদের দুইজনকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের কর্মী বলে দাবী করে নতুন মাত্রা যোগ করতে চেয়েছে কিন্তু আপাতঃ দৃষ্টিতে কোন মাত্রা যোগ হয়নি। কিন্তু এ কর্মসূচিকে ঘিরে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা সত্যি দুঃখজনক।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশ দল (যদিও দেশের মানুষ বিশ দলে অন্তর্ভূক্ত বিএনপি জামায়াত ছাড়া বাকি সব দলই প্যাডসর্বস্ব বলে জানে) ঘোষণা করেছিল সেদিন ঢাকায় সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ হলেও যে কোন পরিস্থিতিতেই তারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথ দখলে রাখবে। কিন্তু সেদিন বিএনপির নেতাকর্মীদের রাজপথে দেখা যায়নি বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। উল্টো ক্ষমতাসীন আমাওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাজপথ নিজেদের দখলে রেখে প্রামাণ করেছে ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে বিএনপি তথা বিশ দলের এদিন এসপারওসপার করে ফেলার হুমকী ছিল কাগুজে হুমকী। একদিকে প্রেসক্লাবে অবস্থান নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্যদিকে বিএনপির গুলশানের দলীয় কার্যালয়কে ঘিরেই রচিত হয়েছে যাবতীয় রাজনৈতিক রঙ্গ।

বিএনপি নেতারা দাবী করেছে বালু ইটের ট্রাক দিয়ে আমাদের নেত্রীকে অবরুদ্ধ করে না রাখলে সে দিন ঠিকই গণঅভ্যুত্থান ঘটে যেত। কিন্তু সরকার প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে আমাদের গণঅভ্যুত্থান চেষ্টা ভন্ডুল করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো মূর্খরা যত গণঅভ্যুত্থান দেখেছি এবং এ সম্পর্কে যতটুকু জানি কোন সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ রাজপথে নেমে এলে দুইটি বা চারটি ই-বালুর ট্রাক কেন শত শত ইট-বালুর ট্রাক ব্যবহার করে এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর সকল বাধাকে উপেক্ষা করে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসে দিনের পর দিন রাজপথে অবস্থান করে সরকারকে অচল করে দিত এবং একদিন সত্যি সত্যি গণঅভ্যুত্থান ঘটে যেত এবং অভ্যুত্থানকারীরা তাদের নেত্রীকে অবরোধমুক্ত করে আনতো। কিন্তু সেদিন যেখানে প্রাণের ভয়ে বিএনপির নেতানেত্রীরাই রাজপথে নামেনি, এবং দলের মহাসচিব প্রাণের ভয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে জনগণ কার ভরসায় প্রাণ দিতে গনঅভ্যুত্থান ঘটাতে রাজপথে নেমে আসবে, এ প্রশ্নটি আমি বিএনপি নেতাদের করলে নিশ্চয় অন্যায় বা বেয়াদপী হবেনা?

দেশব্যাপী যখন নিজ দলের কর্মসূচী চলছিল, বিএনপির মহাসচিবই মাঠে নেই তখন তিনি, প্রাণের ভয়ে একটানা টানা ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় কাটালেন জাতীয় প্রেসক্লাবে! খেলেন ক্লাবের খাবার। সাংবাদিকসহ দলীয় নেতাদের সঙ্গে রাত কাটালেন। সোফায় ঘুমালেন সকাল ১০টার বেশি সময় পর্যন্ত। এ নিয়ে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকরা ফখরুলের জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং জাতীয় প্রেসক্লাব 'বহিরাগত' মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচী চলবে বলে ঘোষণা দেন। তাঁদের দাবি, কর্তৃপক্ষকে প্রেসক্লাব 'বহিরাগত' মুক্ত করতে হবে। তা না করলে সাধারণ সদস্যরা ব্যবস্থা নেবেন। তখন উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় তাঁদেরই নিতে হবে বলে নেতারা হুঁশিয়ার করেন। গতকাল দেড়টার দিকে প্রেসক্লাবে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী যখন ফকরুলের প্রেসক্লাবে অবস্থান নিয়ে হুশিয়ারী উচ্চারণ করছিল তখন মির্জা ফখরুল ছিলেন দ্বিতীয় তলার পাশের কক্ষেই। সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রেসক্লাবে আশ্রয় নেয়া ফখরুলসহ সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে বের করে দিতে প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানানো হয়। প্রেসক্লাবকে একটি রাজনৈতিক দলের আখড়া বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এ কারণেই কর্তৃপক্ষ ফখরুলসহ নেতাকর্মীদের রাতভর আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের জায়গা। এটাকে রাজনৈতিক কার্যালয় হতে দেব না।'সংবাদ ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রেস সচিব ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কালাম আজাদ, বিএফইউজের মহাসচিব আব্দুল জলিল ভুঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। একদিকে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকদের প্রতিবাদ অন্যদিকে প্রেসক্লাবের বাইরে চলছিল প্রজন্ম লীগের সমাবেশ । অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাসান মাহমুদ। প্রেসক্লাবের ভেতরে ফখরুল আশ্রয় নেয়ায় সরকার সমর্থকরা বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ নিয়ে দেখা দেয় উত্তেজনা। উত্তেজিত জনতা কয়েক দফা ক্লাবের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালান। বাইরে থেকে জুতো প্রদর্শন করেন। ফখরুলকে প্রেসক্লাব থেকে বের করে দেয়ার আহ্বান জানান তাঁরা।

এমতাবস্থায় সকাল থেকে গণমাধ্যম কর্মীরা মির্জা ফখরুলের বক্তব্য নেয়ার জন্য চেষ্টা করেন। সকালে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ইউনুস বলেন, স্যার আলাদা করে কোন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন না। সবার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলবেন। বেলা ১১টার দিকে সাংবাদিকদের বলা হয়, মির্জা ফখরুল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস ব্রিফিং করবেন। তবে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে অবস্থান করা এক সাংবাদিক নেতা বলেন, কয়েকটি মামলায় আগাম জামিন ও তাঁকে যেন কোন প্রকার হয়রানি করা না হয় এ জন্য হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে। বিকেলে আবেদনটির নিষ্পত্তি হওয়ার কথা রয়েছে। হাইকোর্টের আদেশ পেলেই মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে বের হয়ে যাবেন। এ ব্যাপারে মঙ্গলবার সকালে জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর প্রেসক্লাব থেকে বের হব আমরা। প্রেসক্লাবের ভেতরে ফখরুল ও শফিউল আলম প্রধানকে ঘিরে ছিলেন বিএনপির একাধিক নেতা ও সাংবাদিক। তাঁদের একটু পর পর বিভিন্ন জনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায়।

অবশেষে বিকেলে বিএনপি দলীয় পেশাজীবীদের এক অনুষ্ঠানে দীর্ঘ সময় ধরে বক্তব্য দিলেন, সরকারকে গালমন্দ করে অনেক কথা বলে জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানালেন। প্রেসক্লাবে দীর্ঘ ২৪ ঘন্টার অধিক সময় অবস্থানের পর সরকার সমর্থিত সাংবাদিকদের প্রতিবাদের মুখে প্রেসক্লাব থেকে বিকেল চারটার পর বের হওয়ার সময় গ্রেফতার হলেন পুলিশের হাতে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব প্রেসক্লাবে অবস্থান নিয়ে ১৯৯৬ সালের মতো সচিবালয়কে ঘিরে জনতার মঞ্চের মতো মঞ্চ গড়ে তুলে সচিবালয়কে অচল করে দেয়ার কৌশলেই জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, কিন্তু জনগণ বিএনপি-জামায়াত তথাকথিত বিশ দলের ডাকে সাড়াতো দেয়ইনি বরং তারা অফিস আদালত ও ব্যবসাপাতি করার জন্যে রাস্তায় নেমে এসে মানুষের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করে তুলেছিলেন। এর ফলেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রেসক্লাব ঘিরে পাতানো নাটকের অবসান হয়। এবং তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন।

একদিকে প্রেসক্লাবে মীর্জা ফখরুল ইসলাম রঙ্গ অন্যদিকে রিজভীর পর বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার দলীয় কার্যালয়ে টানা অবস্থানের নাটক। রিজভী নাটকের পর একই নাট্যমঞ্চে অবস্থান শুরু করলেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির পল্টনের কার্যালয়ে একাধিকবার অবস্থান ছাড়াও একবার টানা ৫২ দিন অবস্থান করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আর বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া শনিবার রাতে থেকে টানা প্রায় ৪ দিন ধরে অবস্থান করছেন বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে। গুলশানেই নিজ বাসভবন সামনে থাকতে বেগম জিয়া কেন গুলশানেরই দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছেন, সেই বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে গুলশানের বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে টানা অবস্থান করে দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পাওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা, মানবাধিকার সংগঠন, সুশীল সমাজ, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের তীব্র নিন্দা-প্রতিবাদ আদায় ও সহানুভূতি পাওয়ার মাধ্যমে সরকারের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবেই বিএনপি নেত্রী গুলশানের নিজ বাসভবনের পরিবর্তে গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। কেননা, নিজ বাসায় অবস্থান করলে এই ধরনের কৌশল গ্রহণের সুযোগ পাওয়া যেত না। আবার আন্দোলনের ব্যর্থতার দায়ভার যাতে নিজ ও নিজ দলের কাঁধে না বর্তায় সেজন্যও এ ধরনের কৌশল নেয়া হয়েছে।'

যাক শেষ করবো এই বলেই বিএনপি নেত্রী এ ধরনের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়ে সাময়িকভাবে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ দেশেরর মানুষ সর্বোপরি দলীয় নেতাকর্মীদের বোকা বানাতে পারলেও সরকার গোয়েন্দা সংস্থাকে বোকা বানাতে পারেননি। তাই সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা বিদেশী নেত্রীবৃন্দ ও মিডিয়ার নিকট এসব ছলচাতুরীর প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বলছে, বিএনপির নেত্রীর কার্যালয়ের সামনেতো এখন কোন অবরোধ বা পুলিশি বাধা নেই; তিনি কু-মতলবে রিজভীর পর দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে মিডিয়া ও জনগণের সহানুভূতি আদায়ের ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর আমরা আমজনতাওতো দেখছি জনগণ বিএনপি অবরোধের ঢাক প্রত্যাক্ষাণ করে সারাদেশের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে।