ঘরে-বাইরে একঘরে হতে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত সিংহভাগ মানুষ ও কোন রাষ্ট্রই তাদের পাশে নেই

মাহবুবুল আলম
Published : 19 Feb 2015, 03:07 PM
Updated : 19 Feb 2015, 03:07 PM

রাজনৈতিক অধিকারের দোহাই দিয়ে বিএনপি-জামায়াত তথা ২০ দলীয় জোট দেশের নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গিদের নিয়ে গত ৪৪ দিন যাবত সারাদেশে সন্ত্রাস নাশকতা, ও পেট্রোলবোমায় দেশের সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে মারারা যে মানবতাবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে তাতে, ২০ দলীয় জোট বিশেষ করে বিএনপির প্রতি দিনে দিনে ক্ষোভ বাড়ছে। তারা ৫ জানুয়ারি থেকে এই ৪৪ দিনে বাংলাদেশ ও বিশ্বের মুসলমানদের হজ্বের পরে বিশাল ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিশ্ব এসতেমা, হিন্দুদের সরস্বতি পূজা, ঈদ ই মিলাদুন্নবী সর্বোপরি দেশের ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষাথীকে জিম্মি করে অবরোধের পাশাপাশি এ পর্যন্ত লাগাতার তিন সপ্তাহের হরতাল পালন করে জনমানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। তাই কেউ আর এখন বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস আশ্রিত নাশকতা ও মানুষ পুড়িয়ে মারায় কর্মসূচি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরাও আন্দোলনের মাঠ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। সারাদেশের জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে ওঠছে।

এতদিন বিএনপি-জামায়াত যেসব দিশি দেশের সহানুভূতি সমর্থনের আশায় ছিল সেসব বিদেশি দেশ ও দাতাগোষ্ঠীও মনে করছে বিএনপি একটি 'ত্রাসের পরিবেশ' সৃষ্টি করেছে। এবং বিশেষ বিশেষ জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্দন ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে এ ধরনের কাজ করে যাচ্ছে বিএনপি। তাই এতদিন বিদেশীদের প্রতি ভরসা করে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে গেলেও এখন কোন রাষ্ট্রই তাদের পাশে নেই। অপরপক্ষে বিদেশী দেশগুলো মনে করছে বর্তমান সরকার অতীতের চেয়ে এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। বিরোধী দল দেশে একটি 'ত্রাসের পরিবেশ' সৃষ্টি করছে বলেও মনে করেন তারা। আন্দোলনের নামে পেট্রোলবোমা, জ্বালাও-পোড়াও, নিরীহ মানুষ হত্যা, জনসম্পৃক্ততা না থাকা ইত্যাদির কারণে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিতে পারছেন না বিদেশীরা। এছাড়া এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সংলাপের যৌক্তিতা আছে কি-না সেটা ভেবে দেখছে জাতিসংঘ।

বিএনপি-জামায়াত জোট প্রায় দেড় মাস ধরে টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে গেলেও কোন একটি বিদেশী রাষ্ট্রই এই কর্মসূচীকে সমর্থন দেয়নি। প্রায় সব দেশের কূটনীতিকরা বিএনপিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। তাদের অভিমত, বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্মসূচী চালিয়ে যেতে হবে।

গতকাল ১৭ফেব্রুয়ারি িএক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশে নবনিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাক গলাবে না। বার্নিকাট বলেন 'এই দেশের রাজনৈতিক সমস্যা এখানকার রাজনীতিবিদ ও জনগণই সমাধান করবে। তিনি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করতে বাংলাদেশে এসেছেন।' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য,চীন জাপান, ভারত সোভিয়েট রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসি আগেই তাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভারত সরকার মনে করে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকার আত্মবিশ্বাসী। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার পঙ্কজ শরন দিল্লীতে পেশ করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধে গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও বোমাবাজিতে 'ত্রাসের পরিবেশ' সৃষ্টির বিষয়টিও স্বীকার করেছেন পঙ্কজ শরন। এক মাসেরও বেশি সময়ের অবরোধে নাশকতায় এরই মধ্যে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের অধিকাংশই পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। যেসব জেলায় বেশি সহিংস ঘটনা ঘটেছে সেগুলো চিহ্নিত করেছে ভারত। সেগুলোর মধ্যে ফেনী, চট্টগ্রাম, যশোর, বরিশাল, রংপুর, মাগুরা ও ঢাকা রয়েছে। ভারতীয় হাইকমিশনারের প্রতিবেদনে বলা হয়, দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে হাসিনার সরকার। সহিংসতা দমনে বাংলাদেশ সরকার কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে এবং তা কাজে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং এরই মধ্যে তারা বেশ সফলতাও পেয়েছে। ভারতের হাইকমিশনার প্রতিবেদনে জানান, পেট্রোলবোমা মেরে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যায় সাধারণ জনগণ বিক্ষোভকারীদের বিপক্ষে চলে গেছে এবং তা সহিংসতা দমনে জনসাধারণের সমর্থন পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করছে।

বিএনপির টানা আন্দোলনের মধ্যেই গত সপ্তাহে বাংলাদেশের যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার তাগিদ দেন। তিনি শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরিয়ে আনতে আস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সকলপক্ষের প্রতিও আহ্বান জানান। তবে তিনি সেখানে কোন সংলাপের কথা বলেননি। এছাড়া সম্প্রতি ওয়াশিংটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফারনান্দেজ তারানকোর বৈঠক হয়েছে। তবে কোন পক্ষই বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে সংলাপ বা নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে মতামত দেয়নি। এদিকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতায় জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো ঢাকা আসছেন বলে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর এলেও এখনও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জাতিসংঘ মহাসচিবের সহযোগী মুখপাত্র এরি কানেকো জানিয়েছেন। তারানকোর ঢাকা সফর অনেকটাই অনিশ্চিত বলে জানা গেছে। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপের যৌক্তিকতা আছে কি-না সেটাই এখন ভেবে দেখছে জাতিসংঘ। সেটা না থাকলে তারানকো বাংলাদেশে আসবেন না।

বিএনপির ডাকা চলমান লাগাতার হরতাল-অবরোধের প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই চার দফায় ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সরকারের সঙ্গে বিদেশী কূটনীতিকদের নিয়ে প্রথম দফায় ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়। অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, কানাডা, ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক হয়। তৃতীয় দফায় সার্ক ও আসিয়ান দেশের প্রতিনিধি ও চতুর্থ দফায় ওআইসি ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। গত ১৪ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকে বিদেশী কূটনীতিকরা আন্দোলনের নামে সহিংসতা কঠোর হাতে দমন করতে তাগিদ দিয়েছেন তারা। বিএনপি আন্দোলনের নামে সহিংসতা করছে বলেও অভিমত প্রকাশ করেন বিদেশী কূটনীতিকরা। একই সঙ্গে বিএনপিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতি করার সুযোগ দেয়ার জন্যও আহ্বান জানান তারা। এরই মধ্যে কানাডা, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপানের কূটনীতিকরা দেশের চলমান সহিংসতার তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছেন। এসব দেশের কূটনীতিকরা বলছেন, সহিংস কর্মকান্ড চালিয়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী করা যায় না। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় তারা তীব্র নিন্দা জানান। শান্তিপূর্ণ উপায়ে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের আহ্বানও জানিয়েছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। সর্বশেষ মঙ্গলবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সহিংসতার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, সহিংসতা কোনভাবেই যৌক্তিক নয়।

এমতাবস্থায় বিএনপির নীতির্ধিারক ও বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের মধ্যে দেখা দিয়েছে গভীর হতাশা। তারা মনে করছেন বিএনপির আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ এখন আর বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়ার নিয়ন্ত্রণে নেই। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ও আইএসআই ও আন্তর্জাতিক জঙ্গিসংগঠন আইএস এর পরামর্শ ও নির্দেশনায় লন্ডনে নির্বাসিত তারেক রহমান ফোনের মাধ্যমে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণভার নিজ হাতে তোলে নিয়েছেন। সেই কারণেই বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী মহল বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিএনপি নামক দলটি এখন যে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে, দিনে দিনে জনসমর্থন হারিয়ে খাদে পড়ে নিজ্জিত হতে সময় লাগবে না। তাছাড়া, দেশের যুবসমাজ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষার্থরা তাদের শিক্ষাজীবন অনশ্চিত করে তোলার জন্য তারা আর কোনদিন বিএনপিকে সমর্থন করবে বলে মনে হয় না। এতে বিএনপির রাজনীতিতে যে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচত প্রভাব পড়বে সে নেতিবাচক প্রভাব কোনদিন আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কিনা তা অিনেকটাই নিশ্চিত।

সুতরাং বিএনপির জন্য সামনে এক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে, বিএনপি। ঘরে-বাইরে বিএনপি যেভাবে একঘরে হয়ে যাচ্ছে তাতে জেনারেল জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি চরম এক অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হয়ে পাকিস্তানী মুসলিম লীগের ভাগ্যিই বরণ করতে হয় কি না কে জানে।