হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যে ছিটমহলবাসীরা ফিরে পেল স্বাধীনতা

মাহবুবুল আলম
Published : 14 May 2015, 04:52 AM
Updated : 14 May 2015, 04:52 AM

মাহবুবুল আলম//

সম্প্রতি বহুল প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হওয়ার পর উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাস হয় বিলটি। বিলের লক্ষ্য হচ্ছে, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময় এবং প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করা। রাজ্যসভায় পাসের পর লোকসভায় বিলটি উত্থাপন করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপিত হলে তা বিনা বাধায় গৃহীত হয়। পরদিন তা লোকসভায় উত্থাপিত হয় এবং অভূতপূর্বভাবে কোন বিরোধিতা ছাড়া ৩৩১ ভোটে দীর্ঘ ৬৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সর্বসম্মতভাবে বিলটি পাস হয়। আরও একবার প্রমাণিত হলো যদি দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব থাকেন তা হলে তাদের মধ্যে অনেক কঠিন সমস্যারই সহজ সমাধান সম্ভব। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি পাসের ফলে দু'দেশে আটকেপড়া প্রায় ৫১হাজার জনগণের দীর্ঘদিনের দুর্দশার লাঘব হবে। ভারতের লোকসভায় এতদসংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল ৩২২-১ ভোটে পাস হয়। এর মধ্য দিয়ে ছিটমহল হস্তান্তরের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনল ভারত। লোকসভায় বিলটি পাস হওয়ার পর পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসন ছেড়ে বিরোধী বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যান এবং কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীকে ধন্যবাদ জানান। বিল পাসে সহায়তার জন্য বিজু জনতা দলের (বিজেডি) নেতা পি মাহতাব, তৃণমূল কংগ্রেসের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এআইএডিএমকের পি বেনুগোপালকেও ধন্যবাদ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল লোকসভায় পাসের খবর নরেন্দ্র মোদি নিজেই ফোন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার টুইটার বার্তায় তা জানান। টুইটারে নরেন্দ্র মোদি লেখেন, সংবিধান সংশোধন বিল সংসদে পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অন্য উচ্চতায় পৌঁছল। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা দুই দেশের সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান হলো। শেখ হাসিনাও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের সরকার, জনগণ ও তার নিজের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী জানান, ভারতের লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হওয়ার পর পরই নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে বিষয়টি অবহিত করেন এবং অভিনন্দন জানান। নরেন্দ্র মোদি বলেন, '১৯৭৪ সালের ১৮ মে আপনার পিতা বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। আপনার সরকারের সময় সেই মে মাসে বিলটি পাস হলো।' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিলটি পাস হওয়ায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, বিরোধীদলীয় নেতা সোনিয়া গান্ধী, ভারত সরকার, লোকসভা ও রাজ্যসভার সব সদস্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। বাংলাদেশের দুঃসময়ে সবসময়ই তারা আমাদের পাশে ছিল। এখনো আছে।

বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর পরই ছিটমহলবাসীদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। নারী-পুরুষ,শিশু-বৃদ্ধ সবেই মিলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে মিছিল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। একে অপরকে গলায় জড়িয়ে ধরে, কেউবা কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে যান। সবাই মিলে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করেন। অনেক মুরব্বী বলেন, শেখ সাহেব ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার জন্যই আজ আমরা স্বাধীনতা ফিরে পেলাম। আল্লাহ যেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হায়াত দারাজ করেন। তাছাড়া সারা দেশেই এ নিয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। যে বিএনপি এতদিন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে গোলামী চুক্তি হিসাবে অভিহিত করে রাজনীতি করেছে সেই বিএনপিও বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর ভারত সরকার তথা মোদী সরকারকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ না জানিয়ে ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানানোয় খালেদার সমালোচনা করছেন দেশের সাধারণ মানুষ। প্রিয় পাঠক আপনারা সবাই হয়তো জানেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে দিল্লীতে রাষ্ট্রীয় সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনকল্পে একটি চুক্তি করেছিলেন। যাক নিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী অনেক রাজনীতি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনাকে ভারতীয় সেবাদাস প্রমানিত করার নানাবিদ অপপ্রচার চালানো হয়েছে। কিন্তু ধর্মের কল যে বাতাসে নড়ে তা এদেশের মানুষ এতদিনে বেশ বুঝতে পেরেছেন।

এ পর্যায়ে অবার ফিরে আসি ছিট মহল প্রসংগে। অখণ্ড ভারত বিভক্ত করে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লগ্নে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে রেডক্লিফের মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব ছিটমহলের। এক দেশের ভূখণ্ডে থেকে যায় অন্য দেশের অংশ। এতে এক অসহনীয় মানবিক সমস্যার উদ্ভব হয় । ১৬২ টি ছিটমহল আছে দুই প্রতিবেশী দেশে। এর মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল আছে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে। এসব ছিটমহলে বসবাসকারী জনসংখ্যা সংখ্যা ৫১ হাজার। সাম্প্রতিক (২০১১) জনগণনা অনুযায়ী ভারতের ছিটমহলে বসবাসরত লোকসংখ্যা ৩৭ হাজার এবং বাংলাদেশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ১৪ হাজার। ২৪২৬৮ একর ভূমি নিয়ে দুই দেশের ছিটমহল। তার মধ্যে ভারতের ১৭ হাজার ১৫৮ একর। বাংলাদেশের ছিটমহলের জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর অধিকাংশই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এ সবের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯, পঞ্চগড়ে ৩৬, কুড়িগ্রামে ১২ ও নীলফামারিতে চারটি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে ৪৭টি কুচবিহার ও চারটি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। কুচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন থানা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আট থানা পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কুচবিহার একীভূত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখণ্ড আসে বাংলাদেশের কাছে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখণ্ড যায় ভারতে। এই ভূমিগুলোই হচ্ছে ছিটমহল।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কিভাবে এ সমস্যার উদ্ভব হলো। ১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্টবেটন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণের কমিশন। ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এর তিন দিন পর ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র। কোনো রকম সুবিবেচনা ছাড়াই হুট করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যথাযথভাবে হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা-বাগানের মালিকেরা নিজেদের স্বার্থে দেশভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে। আর উত্তরাধিকার সূত্রেই উপমহাদেশের বিভক্তির পর এই সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছে দুই দেশ। ১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন চক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের পক্ষ থেকে যথাযথ সাড়া পাওয়া না যাওয়ায় তা আর সফলতার মুখ দেখেনি।

সমস্যার সৃষ্টি হয় ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানে দেশ বিভাজনের পরে। যখন রংপুর চলে যায় পূর্ব পাকিস্থানে এবং কোচবিহার চলে যায় ভারতে। সমস্যার শুরু এখানেই। এই সমস্যা হবে জেনেই ব্রিটিশরা কিন্তু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। তারা "রেডক্লিফ কমিশন' গঠন করে দেশবিভাজনের সীমানা নির্ধারণের কাজ করেছিল। কিন্তু রেডক্লিফের অদূরদর্শিতা, উভয় দেশের রাজাদের স্বার্থ, স্থানীয় জমিদারদের লোভ, তৎকালীন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বের নিকটস্থ চা বাগান মালিক ও ভূস্বামীদের প্রতি স্বজনপোষণ করতে গিয়ে সীমানা নির্ধারণের কাজটি সঠিকভাবে হতে পারেনি। ফলে একদিকে যেমন স্থানীয় মানুষের সাথে আলোচনা ছাড়াই তাদেরকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অন্যদেশে, অপরদিকে ছিটমহল এলাকাগুলির মানুষেরা হয়ে গিয়েছেন নিজভুমে পরবাসী। সমস্যার শুরু সেখানেই।বাংলাদেশের মানচিত্রের উত্তর-পশ্চিমাংশ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সীমান্তের কাছাকাছি কয়েকটি জেলার অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখ- দ্বীপের মতো ভাসছে। অপরদিকে ভারতের মানচিত্রেও তাই। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত বুকার অব বুকারস পুরস্কারপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপন্যাস 'মিডনাইটস চিল্ড্রেন'-এ দেশ বিভাগের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ছিটমহলগুলোকে রেডক্লিফের কালির ছিটা হিসেবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। মানচিত্র তৈরি করতে গিয়ে ছিটমহল সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে।

ছিট মহলের বাসিন্দাদের জীবন এক কথায় দুর্বিষহ। তাদের জন্য কোন দেশের সরকারের কোন পরিষেবা নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তা, পানীয়, বিদ্যুৎ, সেতু, হাটবাজার, পুলিশ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, ভোটাধিকার, কর্মসংস্থান, কিছুই নেই। আছে শুধু ছয় দশক ধরে তীব্র বঞ্চনা, সরকারী প্রতিশ্রুতি, চোরাকারবারি, মাদকপাচার, সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর অত্যাচার আর অশিক্ষা। প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ এখানে নিরক্ষর। ছয় দশকেরও বেশী সময় ধরে নাগরিকত্বের পরিচয় ছাপিয়ে যে মানুষগুলোর প্রধান পরিচয় হয়ে উঠেছিলো ছিটমহলের মানুষ। সেই বিড়ম্বনার অবসান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সীমান্ত ভাগাভাগির হিসাব-নিকাশের ফাঁদে পড়ে যাদের ছিলোনা চলাচলের রাস্তা, চিকিৎসার হাসপাতাল, শিক্ষার স্কুল তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটেছে এবার। এই সমস্যা নিরসনে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সদিচ্ছা যে ছিলো তার প্রমাণ ৭৪ এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি কিংবা ২০১১ এর হাসিনা-মনমোহন প্রটোকল সই তার স্পষ্ট প্রমাণ। নানা জটিলতায় আটকে থাকা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের সংবিধান সংশোধনীটি ভারতের রাজ্যসভা-লোকসভায় পাশ হবার পর ছিটমহলবাসীদের নাগরিক অধিকার এখন সুনিশ্চিত।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে দিল্লীতে রাষ্ট্রীয় সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনকল্পে একটি চুক্তি করেছিলেন। যাতে বলা হয়েছিল, এক দেশের ভেতর যে অন্য দেশের ছিটমহল আছে তার একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত। এই ছিটমহলজনিত সমস্যা সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন ইংরেজ সাহেব সিরিলি রেডক্লিফ সেই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভারতবর্ষকে ফালি ফালি করে দেয়ার। তা নির্দয়ভাবে করেছিলেন তিনি। রেডক্লিফ কখনও বোঝার চেষ্টা করেননি তিনি যে হাজার বছরের শাশ্বত বাংলাকে পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে ভাগ করছেন তাতে বাঙালীদের কী কী মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। ঠিক তাই ঘটেছিল। শুধু পরিবারই বিভক্ত হয়নি এক দেশের স্থলভূমি অন্যদেশে রয়ে গিয়েছিল। এর ফলে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে এই ভূমি বা ছিটমহলের বাসিন্দারা মানবেতর জীবন যাপন করছিল।

মনবতাবাদী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চুক্তিটি বাস্তবায়নে ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা কথাও বলেন। এ আলোচনার ফলাফল ছিটমহলবাসীকে আশান্বিত করে তোলে। শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় সেই আশার আলো আরও প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। দেশহীন মানুষদের আলোর দিশা দেখালেন শেখ হাসিনা। ছিটমহলবাসীদের মানুষ এবং নাগরিকের মর্যাদাও দিলেন। মানবেতর ও অবরুদ্ধ জীবন থেকে তাদের বের করে আনার কাজটিও সুচারুরূপে সম্পন্ন করার পক্ষপাতী তিনি। তাই পূর্বাহ্ণেই ছিটমহলের বাসিন্দাদের দেশের মূলধারায় নিয়ে আসার কাজটিও শুরু করতে সচেষ্ট রয়েছেন। সীমান্ত জটিলতাটি কখনই রাজনৈতিক ছিল না, ছিল মানবিক। ৬৮ বছর ধরে বিশ্ব হতে বঞ্চিত যে নারকীয় জীবন কাটিয়ে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সেই অর্ধলাখ মানুষ এই প্রথম মুক্তির আলো পেতে যাচ্ছেন। ইংরেজরা এ উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তাদের ছিটমহল সমস্যার সৃষ্টি করে গেছেন অযাচিতভাবেই। অভিশপ্ত জীবনের ভার বইবার সব কষ্টকর অবস্থান হতে তাদের মুক্ত করার জন্য যিনি সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট, যিনি ১৯৭৪ সালের চুক্তিটিকে হুবহু বাস্তবায়নে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন, তিনি শেখ হাসিনা। সেই তৎপরতার ফসল ভারতের রাজ্য ও লোকসভায় সংবিধান সংশোধন বিল পাস। নজিরবিহীন ঘটনা যে, ভারতের যেসব রাজনৈতিক দল স্থলসীমান্ত চুক্তি পাসের বিরোধিতা করে আসছিল এতদিন ধরে, শেখ হাসিনার লিয়াজোঁর ফলে সেই তারাই বিল আনেন এবং সকল দলের সম্মতিতে তা পাস হয়। যে অসম প্রদেশের বিরোধিতার কারণে বিজেপিসহ কয়েকটি দল চুক্তিটিকে ঝুলিয়ে রেখেছিল, সেই অসমের রাজনীতিকদের বিলের সপক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। সীমান্তচুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের ইতিবাচক ভাবমূর্তি যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অনুরূপভাবে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ক্যারিশমাও প্রমাণিত হয়েছে। স্পষ্ট হয়েছে, নিজের দেশের স্বার্থরক্ষায় শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, দক্ষতা, যোগ্যতা, কর্মকুশলতা ও স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ। ছিটমহলবাসীর আস্থা, বিশ্বাসও তিনি অর্জন করতে পেরেছেন কাজের ভেতর দিয়ে।
বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত কুটনৈতিক সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। বলতে গেরে তিনি এখন অভিনন্দনের বন্যায় ভাসছেন যেন। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান একটি স্বরচিত কবিতাও পাঠ করে ফেলেছেন গতকালের মন্ত্রীসভার বৈঠকে । কবিতাটি ছিল এ রকম- শুরুটা পিতার করা/কন্যা করেছে শেষ/সার্থক হোক সীমান্ত চুক্তি/ ভারত-বাংলাদেশ/ ছিটমহলের মানুষের মাঝে বইছে আনন্দ বন্যা/অভিনন্দন দীর্ঘায়ু হে বঙ্গবন্ধু কন্যা।

সম্প্রতি একটি সহযোগী দৈনিকে 'পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করলেন কন্যা' শিরোনামের নিবন্ধে গবেষক ও বিশ্লেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ইউজিসির চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেছেন,' ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠন করলে পুরো বিষয়টা নিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বিজেপিকে একটি হিন্দুত্ববাদী দল হিসেবে দেখা হয় এবং মনে করা হয়েছিল যেহেতু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কংগ্রেসের বন্ধু ছিল সেহেতু বিজেপি আওয়ামী লীগের শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হবে। এতে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ বিরোধী মহল বেশ উৎফুল্লই হয়েছিল। কিন্তু গত দু'বছরের কার্যকলাপে নরেন্দ্র মোদি প্রমাণ করেছেন তিনি জাত রাজনীতিবিদ। দলের উর্ধে উঠে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখতে জানেন। উপলব্ধি করেছেন ভারত এখন আর ষাটের দশকে নেই। দেশটি এখন একটি উদীয়মান পরাশক্তি। জাতিসংঘে স্থায়ী পদের জন্য চেষ্টা করছে। তার জন্য এই অঞ্চলের সব দেশেরই সমর্থন চাই।'

১১ মে২০১৫ দৈনিক জনকন্ঠে 'স্বদেশের নয়া মানচিত্রে আঁকা তাঁর মুখ' শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে জাফর ওয়াজেদ বলেছেন,' প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতা তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সম্পাদিত চুক্তির বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অবিচল থেকে দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার দরজা উন্মুক্ত করে দিলেন। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসায় শেখ হাসিনা গোড়া থেকেই অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে গিয়েছেন। সাফল্যও পেয়েছেন। কঠিন হলেও পার্বত্য শান্তিচুক্তি করে ভারত থেকে শরণার্থীদের ফেরত এনেছেন নিজ বাসভূমে। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে ছেড়েছেন। সমুদ্র জয় করেছেন মুর্শিদাবাদে বাংলাদেশ সীমান্তে জেগে ওঠা চরের মালিকানাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সহিংস ঘটনার পর শেখ হাসিনা দূতিয়ালী চালিয়ে সেই চর বাংলাদেশের দখলে নিয়ে আসেন। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধানে অনমনীয় মনোভাব নিয়ে দেশের স্বার্থকে রক্ষা করে চলেছেন। আগামীতে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিও করাতে পারবেন। ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে যতই মতবিরোধ থাক শেখ হাসিনা তাঁর সপ্রতিভ রাজনৈতিক উজ্জ্বলতায় উভয়ের কাছে নিজস্ব দাবি আদায়কে গুরুত্ববহ করে তুলতে পেরেছেন।

পরিশেষে বলতে চাই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ও ত্যাগের কথা বাংলার মানুষ কোনদিন ভুলবে না ভুলতে পারে না। আমাদের দেশের একটি মহল যতই ভারতবিরোধিতার জিগির তুলুক না কেন, তা হালে পানি পায়নি। কেননা, ভারত বার বার প্রমাণ করেছে তারা আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু ও নিরাপদ প্রতিবেশী। আর বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষও ভারতকে সুপ্রতিবেশী হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। আর ভারতের বর্তমান মোদী সরকার এবং শেখ হাসিনার সরকারের মধ্যে যে আন্তরিকতা ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে প্রতিবেশী দু'দেশই লাভবান হবে। এটাই এখন বিশ্বরাজনীতির চরম বাস্তবতা।