এবং সালাহ উদ্দিন কাহিনী

মাহবুবুল আলম
Published : 15 May 2015, 12:12 PM
Updated : 15 May 2015, 12:12 PM

কথিত নিখোঁজ হওয়ার ৬৪ দিন পর শেষ পর্যন্ত সালাহ উদ্দিনের গুম নাটকের নাটকের অবসান হলো। ১০ মার্চ রাতে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩-বি নম্বর সড়কের একটি বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাট অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন তার স্ত্রী। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা তাকে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন হাসিনা আহমেদ। কিন্তু আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয় সালাহউদ্দিন কোথায় আছেন তারা জানেন না। বিএনপির পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সালাহউদ্দিনকে নিয়ে গেছে। নিখোঁজ হওয়ার পর অনেক চেষ্টারপরও তার সন্ধান মেলেনি। বিএনপি জোটের টানা অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল তখন অজ্ঞাত স্থান থেকে এক মাসের বেশি সময় ধরে বিএনপির নামে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। এভাবে অজ্ঞাত স্থান থেকে বিবৃতি পাঠানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

১০ মে ২০১৫ গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজের ২ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তার হদিস না পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে তিনি অবিলম্বে সালাহউদ্দিনকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। তিনি অভিযোগ করেন সালাহউদ্দিন আহমেদকে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি বাসা থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে। ২ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সহায়তায় স্বামীর খোঁজ চেয়ে হাসিনা আহমেদ উচ্চ আদালতে যাওয়ার পর সালাহউদ্দিনকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেন আদালত। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, তারা এই বিএনপি নেতার কোন খোঁজ জানে না। তবে সালাহউদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া গেল কি না সে বিষয়ে নিয়মিত অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট ১২ এপ্রিল আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দেয়।

নিখোঁজ হওয়ার ৬৪ দিন পর হদিস মিলেছে তার। তিনি এখন মেঘালয়ে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের অন্য নেতারা এবং সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ ধারাবাহিক মিথ্যাচার চালিয়ে এতদিন বলে আসছিলেন সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সালাহউদ্দিন নিখোঁজের সঙ্গে জড়িত। এদিকে বিডিনিউজ জানায়, সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী ভারত থেকে স্বামীর ফোন পাওয়ার কথা বলার অন্তত ১২ ঘণ্টা আগে ওই নামে এক বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা জানিয়েছে মেঘালয় রাজ্যের পুলিশ। মেঘালয় রাজ্যের শিলং নগর পুলিশের সুপার বিবেক শ্যাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভারত প্রতিনিধিকে জানান, সোমবার রাতে শহরের গলফ লিংক এলাকা থেকে ৫৪ বছর বয়সী এক বাংলাদেশীকে তারা গ্রেফতার করেন। ওই ব্যক্তি পুলিশকে বলেন, তার নাম সালাহউদ্দিন আহমেদ, তিনি বাংলাদেশী। কিন্তু ভ্রমণের কাগজপত্র দেখাতে না পারায় পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। তাকে খুবই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। কথাবার্তাও স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল না। এ কারণে আমরা তাকে মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ এ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেই। জানা যায়, সালাহউদ্দিনকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে বিএনপি হাইকমান্ড ও তার স্ত্রী হাসিনা খবরটি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় পুলিশ মেঘালয় থেকে তাকে গ্রেফতারের পর তড়িঘড়ি করে সংবাদ মাধ্যমে এ খবর প্রচার করেন হাসিনা আহমেদ। আর এ খবর প্রচারের আগে তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দেখা করেন সালাহউদ্দিন এখন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ের পাস্তুরহিল এলাকার মিম হ্যানস মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন বলে খালেদা জিয়াকে জানান।
আমরা সবাই জানি যে, সালাহ উদ্দিন আহমেদের নামে বেশ ক'টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে টানা অবরোধ চলাকালেই একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এ পরিস্থিতিতে টানা এক মাস অজ্ঞাত স্থানে থেকে বিএনপির পক্ষে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠানোর পর গ্রেফতার এড়াতে ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে স্বেচ্ছায় উধাও হন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষখদের ধারণা সালাহ উদ্দিনের উধাও হওয়ার বিষয়টি জানতেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। কিন্তু এটাকে নিয়ে রাজনীতি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিলেন তারা। তাই ধারাবাহিকভাবে মিথ্যাচার করছিলেন। কিন্তু সত্য কোনদিন চাপা থাকেনা বলেই অবশেষে ধরা পড়ে গেলেন সালাহউদ্দিন। সেই সঙ্গে সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে সকল মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে গেল বিএনপির। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও মনে করছে, সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপি যে নোংরা রাজনীতি করতে চেয়েছিল তা আর সম্ভব হলো না। টানা ৯২ দিন নাশকতামূলক আন্দোলন চালিয়ে বিএনপি জোট ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের হাতে আর কোন অস্ত্র ছিল না। তাই সালাহউদ্দিনের নিখোঁজের ঘটনাকে নিয়ে রাজনীতি করে মানুষের সহনুভূতি আদায় করে দীর্ঘ তিন মাসের নাশকতার চিত্র ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল তারা।
সালাহ উদ্দিনের এ স্বেচ্ছা অন্তর্ধান নিয়ে সারা দেশের মানুষের মধ্যে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। একই সাথে বিএনপি ঘরানায়ও আলোচনা-সমালোচনা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে সালাহউদ্দিনের সন্ধান পাওয়ার পর স্ত্রী হাসিনা আহমেদ মঙ্গলবার দুপুরে খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে তার বিশেষ সহকারী এ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে 'হটটকে' লিপ্ত হন। শিমুল বিশ্বাস হাসিনা আহমেদকে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, আপনার স্বামী ভারতে পালিয়ে গেছে আপনি তা জেনেও আমাদের জানাননি কেন? এর জবাবে ক্ষিপ্ত হয়ে হাসিনা বলেন, সালাহউদ্দিনকে ভারত পাঠিয়েছেন আপনারা। তাই এখন আপনারাই জানেন, আমি জানি না।'
তাই সালাহ উদ্দিনের সেচ্ছা অন্তর্ধান নিয়ে নানাবিধ গল্প-গুজবের ঢাল-পালা বিস্তার করছে। তিনি কিভাবে কোনপথে কোন উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়া পাড়ি জমালেন তা নিয়ে এক একজন এক এক রকম বিশ্লেশষণ করছেন। তবে অনেকেই মনে করছেন সিলেট অঞ্চল দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত হয়ে নেপালে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু নেপালে ভূমিকম্প হওয়ায় আর নেপাল যাওয়া হয়নি তার।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ হওয়া এবং দুই মাস পর ভারত থেকে স্ত্রীকে ফোন দেয়ার ঘটনা বিএনপির মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মুখোশকেই জাতির সামনে ফের উন্মোচিত করে দিয়েছে বলে মনে করছেন সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সরকার ও বিরোধী দলের বেশ কজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, আন্দোলন-নির্বাচনসহ সবক্ষেত্রে ব্যর্থ বিএনপি সালাহউদ্দিনকে 'গুমের' অভিযোগ করে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল, তা আজ জাতির সামনে প্রমাণ হয়ে গেছে। পরাজিত দলের নেত্রী খালেদা জিয়াও সস্তা সেন্টিমেন্ট আদায়ে সালাহউদ্দিনকে সরকার ও প্রশাসন 'গুম-খুন' করতে পারে এমন অভিযোগ করেছিলেন। বিএনপি নেত্রী সবকিছু জেনেশুনেই যে এমন মিথ্যাচার করেছিলেন, তাও আজ জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখন খালেদা জিয়ার উচিত, সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে তাঁর করা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও দুঃখ প্রকাশ করা।
এদিকে অনেক জল্পনা-কল্পনার পর সালাহউদ্দিন নাটকের অবসানের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। মাহফুজ রহমান নামের একজন লিখেছেন, নাটকীয়তার পর আসল কথা হলো সালাহউদ্দিনকে গ্রেফতার করেছে মেঘালয় পুলিশ। এরপর তাকে গতকাল বিকেলেই মিমহ্যাঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রশ্ন হলো এতদিন কেন তিনি ভারতে পালিয়ে ছিলেন। অনিমেষ রহমান নামে একজন লিখেছেন, এবারের অস্কার পুরস্কারের জন্য বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদের নাম প্রস্তাব করছি। এফএম শাহিন লিখেছেন, 'গুম-নাটক!!! বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের গুম-নাটক চলল কিছুদিন; কিছু মিডিয়া আর সুশীল কত্তো বাক-বাকুম করল। কী হলো? সালাহউদ্দিন তাঁর স্ত্রীকে ফোন করে বলল, আমি আছি। স্ত্রী : কোথায়? সালাহউদ্দিন : মেঘালয়, অসম, শিলং।' সুলতান মির্জা লিখেছেন, সালাহউদ্দিনের বউ আর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আসলে কি কারণে সালাহউদ্দিনকে নিখোঁজ থাকতে হয়েছিল সেই রহস্যের জট খোলা প্রয়োজন। পলাশ নামের একজন লিখেছেন, যদি অভিনয় শিখতে চাও, সালাহউদ্দিনের বউয়ের কাছে যাও! অতি সত্বর বেগম জিয়ার প্রযোজনায় বড় পর্দায় আসতে যাচ্ছে ছিঃনেমা 'সালাহউদ্দিন এখন মেন্টাল।'
নিবন্ধের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। তাই শেষ করতে চাই এই বলেই, বিএনপি যেভাবে নেতিবাচক রাজনীতির বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে তাতে অচিরেই বর্তমান ইতিবাচক বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুস্থ্যধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে না পারলে বিএনপির মতো দেশের অন্যতম বৃহত দল অস্তিত্ব সংকটে পড়তে বাধ্য তা বলে দিতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।