লক্ষাধিক মুফতি আলেম-উলামার জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়া আরও একটি অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করলো বাংলাদেশ

মাহবুবুল আলম
Published : 19 June 2016, 03:46 PM
Updated : 19 June 2016, 03:46 PM

বাংলাদেশ আরও একটি ইতিহাস সৃষ্টি করলো। বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক উস্কানী ও গুপ্তহত্যায় উদ্বিগ্ন দেশের লক্ষাধিক মুফতি, আলেম-উলামার ও আইম্মার যৌথ ঘোষিত ফতোয়ায় ইসলামের নামে জঙ্গীবাদ ও আত্মঘাতী হামলাকে 'হারাম, জঘন্য অপরাধ ও অবৈধ' বলে অভিহিত করে ফতোয়া জারি করেছেন। গতকাল শনিবার ১৮ জুন ২০১৬ শনিবার রাজধানীতে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সেই ফতোয়া প্রকাশ করে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের গ্র্যান্ড ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ঘোষণা দিয়েছেন- ধর্মের নামে সন্ত্রাসকারী, জঙ্গী, গুপ্তহত্যাকারীদের জানাজা পড়াও হারাম। ইসলাম এদের কখনই শহীদের মর্যাদা দেয় না। বরং যারা জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মারা যাবেন তারা শহীদের মর্যাদা পাবেন। অমুসলিমদের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, অবৈধ ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বিষয়টিকে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বললাম এ কারণে যে, বিশ্বের কোন রাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক ধর্মীয় নেতা একসাথে ঐক্যমত্যে পৌঁছে জঙ্গীবাদবিরোধী কোন ধর্মীয় ব্যাখ্যা বা ফতোয়া জারির ইতিহাস আছে কি না তা আমার জানা নেই। একথা আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবও তার বক্তৃতার এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। যেখানে কিছু সংখ্যক ধর্মীয় নেতাকে একত্রিত করে কোন বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছা একটি দুরূহ কাজে সেখানে ১ লক্ষ ১,৮৫০ জন মুসলিম ধর্মীয় নেতার সাক্ষর সম্বলিত একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা বা ফতোয়ায় উপনীত হওয়া সত্যি প্রশংসার দাবী রাখে। যে বিষয়টিকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশের আলেম-উলামার এমন একটি বড় কাজ করে দেখিয়েছেন তা অবশ্য অবশ্য অনুকরণীয়। কেননা, জঙ্গীবাদ ইস্যুটি শুধু একা বাংলাদেশেরই ইস্যু বা সমস্যা নয়, এটি আজ সারা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এমতাবস্থায় পৃথিবীর জঙ্গি ও সন্ত্রাসসংঙ্কুল অনেক বড় বড় দেশের পক্ষে এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি; কিন্তু আমাদের মতো একটি ছোট দেশের আলেম-উলেমারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্মত হয়েছেন, তা অবশ্যই একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আলেম-উলামারা একটি কথা প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছেন তা জোর দিয়েই বলা যায়, আর সে বিষয়টি হলো বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও তারা ধর্মান্ধ নয়। আমাদের দেশে যে মুষ্টিমেয় কিছু বিপদগামী ধর্মান্ধমানুষ বা ধর্মীয় নেতার জঙ্গী বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও সিংহভাগ মানুষই প্রকৃত ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী, তারা কখনো ইসলামে উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেন না।

যাক আবার মূল প্রসংগে ফিরে আসি। গতকাল ফতোয়া জারি উপলক্ষে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতায় ওলামা মাশায়েখরা বলেছেন, পবিত্র শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে কতিপয় সন্ত্রাসীগোষ্ঠী নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরান ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এরা ইসলামের কেউ নয়। এরা ইসলামের শত্রু। মানুষের চোখে ইসলামকে এরা একটা বর্বর নিষ্ঠুর ও সন্ত্রাসী ধর্মরূপে চিত্রিত করছে। জিহাদ ও সন্ত্রাস একই জিনিস নয়। জঙ্গীদের অনেকেই 'জিহাদী' বললেও তারা আসলে সন্ত্রাসী। ইসলাম সন্ত্রাস সমর্থন করে না। আর যারা বেহেশত পাওয়ার আশায় আত্মঘাতী হামলা করছে, বলছে মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী, তারা কোরান ও হাদিসের আলোকে বেহেশত পাবে না। তাদের স্থান নিশ্চিত দোজখে। 'মুসলিম সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমকে যদি কেউ হত্যা করে, সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না। অমুসলিমদের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, অবৈধ ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাক্ষর সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের গ্র্যান্ড ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ জানান দেশের ১ লক্ষ ১,৮৫০ জন মুসলিম ধর্মীয় নেতা, মাদ্রাসা শিক্ষক এতে স্বাক্ষর করছেন, সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যমতে ঢাকা বিভাগে ২৮ হাজার ৫৬, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ হাজার ৬৮১, খুলনা বিভাগে ১৪ হাজার ২৫০, রংপুর বিভাগে নয় হাজার ৭৭০, ময়মনসিংহ বিভাগে আট হাজার ৮৯২, রাজশাহী বিভাগে দুই হাজার ২০০, বরিশাল বিভাগে এক হাজার ৪৫০ এবং সিলেট বিভাগে ১৬ হাজার ২২৫-সহ মোট এক লাখ ১৫২৪টি স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়েছে।

এই ঐতিহাসিক ফতোয়ায় যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য,  বেফাকুল মাদারিসিল আরবী বাংলাদেশেরসহ সভাপতি, মাওলানা আশরাফ আলী, দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর প্রধান মুফতি, মাওলানা মুফতি আব্দুস সালাম, আল জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রামের প্রিন্সিপাল মাওলানা মুফতি আব্দুল হালিম বুখারী, জামিয়া দারুল মা'আরিফ, চট্টগ্রামের প্রিন্সিপাল, মাওলানা সুলতান যওক্ব নদভী, দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুফতি মাওলানা নূর আহমদ, জামিআ আরাবিয়া এমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ, ঢাকার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, পূর্ব সিলেট আযাদ দ্বীনী এদারা বোর্ডের সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ বিন ইদ্রীস লক্ষ্মীপুরী, পূর্ব সিলেট আযাদ দ্বীনী এদারা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী, জামিয়াতুস সাহাবা উল্টরার প্রিন্সিপাল আামীন উজানবী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, খাদিমুল ইসলাম গওহরডাংগা মাদরাসার প্রিন্সিপাল, মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন। আরও আছেন মাওলানা মুফতি মনসুরুল হক, মাওলানা মুফতি নুরুল হক জকিগঞ্জী, মাওলানা নোমান ফয়জী, মাওলানা মুফতি আব্দুল হক, মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী, মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান, মাওলানা আবদুল হক হক্কানী, মুফতি ইউসুফ শেমপুরী, মাওলানা আনোয়ারুল করীম যশোরী, মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ, মাওলানা মুফতি এনামুল হক, মাওলানা মুফতি আবুল কাসিম, মাওলানা নাসিরুদ্দীন, সিনিয়র মুহাদ্দিস, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ, মাওলানা শওকত সরকার, মাওলানা হাফিজুদ্দীন, প্রিন্সিপাল, মাওলানা আনাস, মুফতি সাইয়্যিদ নুরুল করীম, মাওলানা আবদুল আওয়াল, মাওলানা হেলাল আহমদ প্রমুখ।

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত লাখো আলেমের ফতোয়ায় অংশ নিয়েছেন বিপুল সংখ্যক নারী আলেম ও মুফতিও। দেশের ৯ হাজার ৩২০ জন নারী আলেমা স্বাক্ষর করেছেন এই ফতোয়ায় মহিলা আলিম ও মুফতিগণেরও দস্তখত করেছেন। দেশের নারী আলেমরাও জঙ্গীবাদবিরোধী ফতোয়ায় স্বস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসার আলেমা তানজিলা আফরিন, উম্মে হাফছা, আমেনা, কুলসুম রিমা, খাদিজাতুল কুবরা, তানজিম তাসফিয়া দিনা, আনিকা আহাদ, ফাতেমা খাতুনসহ আরও অনেকের নাম রয়েছে। এ মাদরাসাটির প্রিন্সিপাল চরমোনাই পীরের ভাই মাওলানা মুসতাক আহমদ। নরসিংদী জেলার কয়েকটি মহিলা মাদরাসার নারী আলেমদের মধ্যে রয়েছেন, আলেমা মোসা তৈয়্যবা, উম্মে সালমা, আমিনা, সুরাইয়া, মাকসুদা, তাসফিয়া, মুশফিকাসহ আরও অনেকে।

আমরা সবাই জানি যে, বিগত কয়েক বছর যাবত লেখক, প্রকাশক, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, অধ্যাপক, বিদেশী, হিন্দু পুরোহিত, খ্রীস্টান যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষুর ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে একই কায়দায় হামলার প্রেক্ষাপটে দেশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও মুফতি আলেম উলামাদের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো এ ধরনের শক্ত মতামত এলো।

৩২ পৃষ্ঠার ফতোয়াটির 'প্রসঙ্গকথায়' ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ লিখেছেন, 'মানবকল্যাণ ও শান্তির ফতোয়ার এই বারতা সন্ত্রাস পুরোপুরি ঠেকাতে না পারলেও এতে যে বহুলাংশে হ্রাস পাবে তাতে সন্দেহ নেই। সন্ত্রাসের মদদদাতারা এতে হতোদ্যম হবে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়।' শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম বলছিলেন, 'যারা ধর্মের নামে হত্যা এবং বিভিন্ন সন্ত্রাস করছেন তারা সঠিক কাজ করছেন না। ইসলাম ধর্মে হত্যাকে কোনভাবে সমর্থন করে না।

আলেম-উলামেরদের জন্য ফতোয়ায় প্রদত্ত প্রশ্ন ও এর উত্তর ক্রমানুসারে নিন্মে তুলে ধরা হলো:

এক নং প্রশ্ন : মহান শান্তির ধর্ম ইসলাম কি সন্ত্রাস ও আতঙ্কবাদী কর্মকান্ডকে সমর্থন করে? উত্তর : ইসলাম কখনো সন্ত্রাস সমর্থন করে না। অধিকন্তু সন্ত্রাস, হিংসা, হানাহানি নির্মূল করার জন্যই মহান ধর্ম ইসলামের আবির্ভাব। ইসলাম শান্তি ও ভালোবাসার ধর্ম। কুরআনের ভাষায় একজন মানুষের প্রাণ রক্ষা করা গোটা মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করা পক্ষান্তরে একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার নামান্তর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুই নং প্রশ্ন : নবী রাসূলগণ বিশেষ করে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি এই ধরনের হিংস্র ও বর্বর পথ অবলম্বন করে ইসলাম কায়েম করেছেন?

উত্তর : নবী ও রাসূলগণ বিশেষ করে ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কস্মিনকালেও সন্ত্রাস ও নির্মম বর্বরতার পথ অবলম্বন করেননি। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ হলো দাওয়াত ও মুহব্বাতের পথ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর অনুসারী সাহাবীগণ প্রেম ও খেদমতের (সেবা) মাধ্যমে মানুষকে কল্যাণের প্রতি, হেদায়েতের প্রতি দাওয়াত জানিয়েছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোটা জীবন এর জ্বলন্ত সাক্ষী। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সাথে সন্ত্রাসকে যুক্ত করা চরম মুনাফিকী ও মিথ্যাচার বলে গণ্য। সন্ত্রাসীরা কখনও ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বন্ধু নয়। এরা সুস্পষ্ট শত্রু। এদের ব্যপারে সতর্ক থাকা সবার কর্তব্য।

৩ নং প্রশ্ন : ইসলামে জেহাদ আর সন্ত্রাস কি একই জিনিস?

উত্তর : জিহাদ ও সন্ত্রাস একই জিনিস নয়। জিহাদ হলো ইসলামের অন্যতম একটা নির্দেশ পক্ষান্তরে সন্ত্রাস হলো হারাম এবং অবৈধ। জিহাদ হলো নিজের এবং পরিবেশে ও সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা এবং সর্বকালীন কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া।

৪ নং প্রশ্ন : সন্ত্রাসসৃষ্টির পথ কি বেহেশত লাভের পথ না জাহান্নামের পথ?

উত্তর : সন্ত্রাস ও আতঙ্কসৃষ্টি করা যেহেতু হারাম এবং নিষিদ্ধ সুতরাং তা কখনও বেহেশত পাওয়ার পথ হতে পারে না। এ তো জাহান্নামের পথ। যারা বেহেশত লাভের জন্য বর্তমানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তাদের যদি বেহেশত লাভ করতে হয় তবে সন্ত্রাসবাদের মতো জাহান্নামের পথ থেকে অবিলম্বে তওবা করে শান্তি ও হেদায়েতের পথে ফিরে আসতে হবে।

৫ নং প্রশ্ন : আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর মৃত্যু কি শহীদী মৃত্যু বলে গণ্য হবে?

উত্তর : আত্মহত্যা ও আত্মঘাত ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। নিজেকে মানববোমা বানিয়ে উড়িয়ে দেয়া কখনও বৈধ নয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে জিহাদে শরীক এক ব্যক্তি যুদ্ধে আহত হয়ে আত্মহত্যা করলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জাহান্নামী বলে ঘোষণা দেন।

৬ নং প্রশ্ন : ইসলামের দৃষ্টিতে গণহত্যা কি বৈধ?

উত্তর : ইসলামে নিরপরাধ মানুষের গণহারে হত্যা বৈধ নয়। এমন কি সন্দেহের বশবর্তী হয়েও কাউকে হত্যা করা নিষেধ।

৭ নং প্রশ্ন : শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যাকা- ইসলাম কি সমর্থন করে?

উত্তর : শিশু, নারী, বৃদ্ধ, দুর্বল, যারা যুদ্ধে শরীক নয়, সেই ধরনের মানুষকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও তা জায়েয নয়। কিতাল বা স্বশস্ত্রযুদ্ধের উদ্দেশ্যে যখন মুসলিম দল বের হতো, তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ করে এই বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করতেন।

৮ নং প্রশ্ন : ইবাদতরত মানুষকে হত্যা করা কি ধরনের অপরাধ?

উত্তর : যেকোনো অবস্থায় খুন করা অপরাধ। ইবাদত বা উপসনারত কাউকে হত্যা করা সবচে জঘন্য এবং মারাত্মক অপরাধ।

৯ নং প্রশ্ন : অমুসলিমদের উপাসনালয় যথা গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদিতে

হামলা করা কি বৈধ?

উত্তর : মুসলিম সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমকে যদি কেউ হত্যা করে সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না।  অমুসলিমগণের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম ও অবৈধ। এটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

১০ নং প্রশ্ন : সন্ত্রাসী ও আতঙ্কবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইসলামের

দৃষ্টিতে সকলের কর্তব্য কি না?

উত্তর : মুনকারাত অর্থাৎ অন্যায় ও দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সবার কর্তব্য। বর্তমানে সন্ত্রাস ও আতংকবাদ সারা পৃথিবীতে ইসলাম ও মুসলিমদের বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে, বদনাম করছে। এসব দুষ্কর্ম ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মারাত্মক শয়তানী ষড়যন্ত্র বই কিছুই নয়। সুতরাং এর বিরুদ্ধে শক্তি সামর্থের আলোকে সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সকলের জন্য জরুরি ধর্মীয় কর্তব্য। চুপ করে থাকার অবকাশ নেই।

বাংলা ট্রিবিউন এ ফতোয়ার বিরুদ্ধে জঙ্গীগোষ্ঠী বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে  বিভিন্ন নেতীবাচক প্রচারনা একটি খবর ছেপেছে। বাংলা ট্রিবিউন বলেছে, দেশের লক্ষাধিক আলেমের অংশগ্রহণে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির উদ্যোগ মোটেও পছন্দ হয়নি জঙ্গিদের। এর বিরোধিতা করে অপপ্রচারের নামার অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে। উগ্রপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তিতুমীর মিডিয়া থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হছে একটি ভিডিও। সেখানে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে দেওয়া ফতোয়াকে 'জিহাদের' বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। জঙ্গি কার্যক্রমকে 'মুসলিম তরুণদের জিহাদি জাগরণ' উল্লেখ করে এই কার্যক্রম বন্ধ করতে 'দরবারী আলেমদের জিহাদবিরোধী ফতোয়া আসছে' বলে ওই ভিডিওতে বলা হচ্ছে। এই ভিডিওটিতে ফতোয়া সংগ্রহ কমিটির প্রধান ও শোলাকিয়া ঈদগার খতিব ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়। ভিডিওটিতে শাইখ তামিম আল আদনানী নামের এক ব্যক্তির কণ্ঠে সম্ভাব্য এ ফতোয়াকে জিহাদবিরোধী উল্লেখ করে এ কার্যক্রমে অংশ না নিতে আলেমদের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে।

তবে জঙ্গীগোষ্ঠীর এমন নেতীবাচক প্রচারনার পরও ফতোয়ার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের অনেক আলেম-উলামা বক্তব্য ও সমর্থন জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন,'ইসলাম কাউকে বিনা বিচারে হত্যা সমর্থন করে না। সন্ত্রাসী প্রক্রিয়া ইসলামে নেই। আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সকল কার্যক্রম সমর্থন করি। যারা ধর্মের নামে খুন করছে তারা ধর্মের ক্ষতি করছে।' ফতোয়ার উদ্যোগকে স্বাগত  জানিয়েছেন সিলেট কাজির বাজারের জামেয়া মাদানিয়া মাদ্রাসার প্রধান মুফতি শায়খুল হাদিস শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, এটা খুব ভালো উদ্যোগ। এতে করে পরিষ্কার হবে, দেশের আলেমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে মসজিদ-মাদ্রাসার সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে আর কোনও অপপ্রচারের সুযোগ থাকবে না। পাশাপাশি দেশের কোনও মানুষকে ভুল বুঝিয়ে জঙ্গিবাদের পক্ষে নেওয়ার পথও বন্ধ হবে।'

রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষিকা সাকেরা মাহমুদ বলেছেন,  ইসলাম রক্ষার নামে কোনও সন্ত্রাসী কাজকে আমরা সমর্থন করি না, ইসলামে সন্ত্রাসের কোনও জায়গা নেই, ইসলাম শান্তির ধর্ম। এ কারণে এই ফতোয়ার পক্ষে আমাদের অবস্থান। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা ভালো উদ্যোগ।আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছি। সাকেরা মাহমুদ আরও বলেন, ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে জঙ্গিবাদবিরোধী এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছি। যে জঙ্গিবাদের তৎপরতা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, এর সঙ্গে আইএস কিংবা যে ভাষাতেই বলা হোক না কেন, এগুলোর কোনোটাই কোরআন হাদিস সমর্থন করে না। বরং কোরআন হাদিসে জঙ্গিবাদের কোনও স্থান নেই। তিনি অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, গুপ্তহত্যা, যেখানে সেখানে মানুষকে মেরে ফেলা আমাদের ধর্মে নেই। কেউ একজন হয়তো দোষ করেছে, কিন্তু তাই বলে আইন  নিজের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য ইসলাম কাউকেই অনুমতি দেয়নি। তার জন্য সরকারের কাছে প্রতিবাদ করতে হবে এবং সঠিক বিচারের জন্য আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে।

সাকেরা মাহমুদের সঙ্গে একমত পোষণ করলেন আরেক শিক্ষিকা জয়নাব আক্তার, শিক্ষার্থী হুমায়রা সিদ্দিকা, হালিমাতুস সাদি এবং তামান্না আফরিন। স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদ্রাসার আলেমা তানজিলা আফরিন, উম্মে হাফছা, আমেনা, কুলসুম রিমা, খাদিজাতুল কুবরা, তানজিম তাসফিয়া দিনা, আনিকা আহাদ, ফাতেমা খাতুনসহ রয়েছেন প্রায় ১০০ জনের মতো আলেমা। সবাই বললেন,আমরা জেনে বুঝে এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছি। কারণ, ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনও স্থান নেই।এই কারণেই আমাদের মাদ্রাসার সব নারীরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

জাতীয় মহিলা মাদ্রাসার আরেক শিক্ষিকা জয়নাব আক্তার বলেন, যে ব্যক্তি  ইসলাম সম্পর্কে জানেন, তিনি বলতে পারবেন, ইসলাম, ইসলামি আইন, ইসলামি শাসনতন্ত্র এসব কিছু জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। কোনও সুস্থ বিবেক এগুলোকে সমর্থন করে না। জয়নাব আক্তার বলেন, কে বা কারা এগুলো করছে আমরা জানি না। ইসলাম রক্ষার নামে রাস্তা অবরোধ, লাঠি মিছিল, গাড়ি ভাঙচুর মানুষ মারা,ইসলাম এগুলো সমর্থণ না। রাসুল (স.) এর যুগ থেকে সাহাবীদের আমলেও কোথাও এরকম ঘটনা ঘটে নাই। এটা সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়া,বর্বরকাজ। শিক্ষার্থী তামান্না আফরিন বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আইএস  দায় স্বীকার করছে, কিন্তু তারা আদৌ আইএস  কিনা সেটা আমরা জানি না। আর আইএস  যদি দায় স্বীকার করেই থাকে তাহলে আমার প্রশ্ন, আইএস কারা, কাদের সৃষ্টি এই আইএস, দলটা কাদের। আমরা আইএসের কার্যক্রম যা দেখছি তার সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। আইএস জায়গায় জায়গায় গুপ্তহত্যা করছে-ইসলাম কী তাদের এই অনুমতি দিয়েছে বলে প্রশ্ন করেন তিনি। আমাদের কাছে এটা খুবই স্পষ্ট যে, এটা ইসরায়েলের বানানো সংগঠন।আমরা একমাত্র কোরআন হাদিস দিয়ে তাদের কাজ জাস্টিফাই করবো, কিন্তু সেখানে বিস্তর ফারাক।এজন্য আমরা আইএসকেও সমর্থন করি না বলেন তামান্না।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে আলেম-উলামারা বলেন ৩০ খন্ডের ফতোয়া ও দস্তখতসমূহ গ্রন্থবদ্ধ করা হয়েছে, আমাদের পরিকল্পনা হলো একটি কপি জাতিসংঘকে, একটি ওআইসিকে আরেকটি মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং আরেকটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তে অর্পণ করব। ইতোমধ্যেই এই ফতোয়ার একটা ইংরেজী, আরেকটা আরবি ভার্সনও প্রস্তুত করা হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের এই ব্যাখ্যা অবশ্যই বিরাট অবদান রাখবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । এ ধরনের বিরাট কাজ আজ পর্যন্ত পৃথিবীর আর কোথাও কখনও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। গিনেস বুকের রেকর্ডস বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে।' জানা গেছে আলেমের স্বাক্ষর করা এই ফতোয়ার অনুলিপি দেশের সব মসজিদে রাখা হবে। সেই সঙ্গে ফতোয়াটি পাঠানো হচ্ছে মক্কার কাবা শরিফের ইমাম এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ ও ওআইসি'র নেতাদের।

শেষ করতে চাই এই বলেই যে, উগ্রজঙ্গীবাদীরা মূলত ইসলাম ও মুসলিমদেরই শত্রু নয়, মানবতারও শত্রু। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, আফ্রিকার দেশসমূহ কিভাবে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তা আজ কারও অজানা নেই। এই জঙ্গীবাদীদের আস্ফালনের কারণে লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই  এদের তাদের চৈতন্যের বিভ্রম ও মগজ ধোলাই দূর করে দেশকে এই অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এদের দমন করা সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক এই তিন শক্তির সম্মিলিত উদ্যোগই কেবল দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে যুক্ত এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস।