বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জঙ্গি ইস্যুতে পশ্চিমাদের দু‘মুখো নীতি

মাহবুবুল আলম
Published : 11 August 2016, 05:03 PM
Updated : 11 August 2016, 05:03 PM

১ জুলাই ২০১৬ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার  পর নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে  দ্বিমুখী নীতিও গ্রহণ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব।  নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের ব্রিটিশ কাউন্সিল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর আগে কার্গো পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল দেশটি। সম্প্রতি বাংলাদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোন দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস বন্ধ করেনি তারা। অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানের কাবুলে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় ৮০ মানুষ। কিন্তু সেখানে ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিসের সকল কার্যক্রম অব্যাহত আছে। ৮ আগস্ট ২০১৬ পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের কোয়েটা হাসপাতালে হামলায় প্রায় ৭৯ মানুষ মারা গেলেও সেখানের ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস বন্ধ করেনি ব্রিটিশ সরকার। পাকিস্তানের করাচী, লাহোর ও ইসলামাবাদে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অফিস রয়েছে। শুধু তাই নয় ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে জঙ্গী হামলায় সেসব দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোন প্রশ্ন না তুললেও কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রশ্ন তুলছে পশ্চিমারা। জঙ্গী হামলার শিকার বিভিন্ন দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল সাময়িক বন্ধ করা না হলেও শুধু ব্যতিক্রম ঘটছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এছাড়া জার্মানিতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও বিচ্ছিন্নভাবে জঙ্গী হামলা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাঞ্জাবের পাঠানকোটেও কিছুদিন আগে জঙ্গী হামলা হয়েছে। সেখানে নিহত হন ৮জন। তবে এই জঙ্গী হামলার পরে দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি সেখানের বিদেশী কূটনীতিকরা। এছাড়া ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে তাজ হোটেল হামলার পরেও সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কূটনীতিকরা প্রশ্ন তোলেননি। একইভাবে ফ্রান্সে তিন দফা জঙ্গী হামলার পরেও সেখানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি। তাই বাংলাদেশের ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস বন্ধের যৌক্তিকতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

নিরাপত্তা ইস্যু বিষয়ে এখন ব্যতিক্রম ঘটছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে রীতিমতো সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে পশ্চিমারা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যেন আগবাড়িয়ে সব কিছুই করতে চাইছে। কেননা, গুলশানে হামলার পরেই তড়িঘড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফর নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট জানিয়েছেন, নিরাপত্তা ইস্যু কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দখলের কোন ইচ্ছা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তারা শুধু বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চাইছেন। এটা যেন সেই  "ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাইনা"র প্রবাদের মতো। তা হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই ঘটনা ঘটলেও অন্যসব দেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরা নিরাপত্তা নিয়ে তারা কোন প্রশ্ন তুলছেন না কেন?

এর আগে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একের পর এগিয়ে যাচ্ছে দেখে প্রবৃদ্ধি অর্জনের বড় খাত পোশাক শিল্পের ওপর থেকে জিএসপি সুবিধা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নানা অজুহাতে কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে । বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দিতেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবেই অস্ট্রেলিয়ার পর যুক্তরাজ্যের তরফ থেকে ঢাকা-যুক্তরাজ্য সরাসরি কার্গো সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। জিএসপি ইস্যুটিকে দেশটি রাজনৈতিকভাবে নিয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ।  কেননা, বাংলাদেশকে শর্ত দেয়া হয়, জিএসপি পেতে হলে ১৬টি শর্ত পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ধীরে ধীরে সকল শর্তই পূরণ করে। এসব শর্ত পূরণে বাংলাদেশের প্রশংসাও করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবুও  জিএসপি সুবিধা পায়নি বাংলাদেশ।

জঙ্গিবাদ ইস্যুটি এখন আর শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা নয় এটি এখন বৈশ্বি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে জঙ্গী হামলার ঝুঁকি রয়েছে। কোন কোন দেশের দূতাবাসও উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে এসব হুমকি সত্ত্বেও সেখানে বিভিন্ন দূতাবাস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান। তখন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মিশনের কেউ ফিরে আসেননি। সে সময় ইসলামাবাদের কূটনৈতিক মিশনে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বাংলাদেশ। সে প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বাংলাদেশ মিশনে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়।

রাজধানী গুলশানে জঙ্গি হামলার পরে বেশ কয়েকটি ঢাকা মিশনের কর্মকর্তারা ছুটি নিয়ে দেশে  চলে গেছেন। তারা আর ঢাকায় ফিরবেন কি-না সেটা নিয়ে নিশ্চিত নয়। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ত্যাগ করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যু গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের বেশ কিছু সহকর্মী ইতোমধ্যেই তাদের পরিবারের সদস্যদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাকিরা এখনও অপেক্ষা করছে কী সিদ্ধান্ত আসে, সেটা দেখার জন্য। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর থেকে একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ঢাকায় এসেছেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই তিনি নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন কার্যক্রম শেষ করবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তা মূল্যায়ন কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে তাদের মিশনগুলো পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিক ও বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। সে কারণে বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল বিদেশী নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্বও বাংলাদেশ সরকারের। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার পরে বিদেশীদের নিরাপত্তায় সচেষ্ট বাংলাদেশ। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ইতোমধ্যে বিদেশীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে কূটনৈতিক জোনে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে সরকার। বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের কাছে ইতোমধ্যেই কয়েকটি সুপারিশ করেছেন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে কূটনৈতিক জোনে নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিদেশী ক্লাবে নিরাপত্তা প্রদান, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অফিসে নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অফিসে নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিমানবন্দরে চেক আউট ও চেক ইনের সময় বিদেশীদের নিরাপত্তা প্রদান ও ঢাকার বাইরে থাকা সকল বিদেশীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব সুপারিশ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে সরকার।

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো , বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গী হামলা হলেও সেসব দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশী কোন চাপ তৈরি হয়নি। শুধু ব্যতিক্রম বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এখানে বিদেশী কূটনীতিকরা যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সেটা অন্য দেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। বিদেশী কূটনীতিকরা এখানে দ্বিমুখী আচরণ করছেন বলেও তিনি মন্তব্য করে বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কোন কোন কুটনৈতিক।

রাজধানীর গুলশানে জঙ্গী হামলার প্রেক্ষিতে দেশের কোন ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়নি বলে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তার মতে জঙ্গী হামলা এখন বৈশ্বিক সমস্যা। সে কারণে একক কোন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর আমাদের মতো দেশের সচেতন মানুষও মনে করে এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে চাপে রাখার জন্য পশ্চিমাবিশ্বের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। এর সাথে সংযোগ আছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রেরও।

আমরাও মনে করি জঙ্গি সমস্যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে কোন বিষয় নয়। তবু পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে চাপে রাখার জন্য এ ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর একের পর এক চাপ শর্ত আরোপ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে। এর একটাই কারণ বাংলাদেশ যেন কিছুতেই মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে না পারে। কেননা, বাংলাদেশ মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত হলে তাদের অনেক সমীকরণই উল্টে যেতে পারে, তাই বাংলাদেশে আইএস আছে এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে এরা মরিয়া হয়ে ওঠেছে এবং জঙ্গি ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর বিভিন্ন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, যা তাদের দু'মুখো নীতিরই নামান্তর।