আমেরিকার নির্বাচনের ইতিহাসে ফলাফল মেনে না নেয়ার বিক্ষোভ সত্যি নজীরবিহীন

মাহবুবুল আলম
Published : 11 Nov 2016, 01:29 AM
Updated : 11 Nov 2016, 01:29 AM

সদ্যসমাপ্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গণমাধ্যমের জরিপ ও বিশেষজ্ঞদের সকল হিসাব-নিকাশ  ভুল প্রমাণ করে ভোটে বিপুল বিজয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শেষ পর্যন্ত একজন অনভিজ্ঞ রাজনীতিক ও ধনকুবেরকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিল মার্কিনীরা। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্ট হলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার বর্তমান বয়স ৭০ বৎসর। ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করবেন তা ভাবেনি কেউ। মার্কিন প্রশাসনের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা হিলারিকেই এগিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন সারা পৃথিবীর মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় কোন প্রার্থীর জয়ের জন্য ৫৩৮ ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে দরকার ছিল ২৭০ ভোট। কিন্তু মোট ২৯০ ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন পান ২১৮ ইলেক্টোরাল ভোট। তার বিজয়ী সারা বিশ্ব আজ বিষ্মিত ও স্তম্বিত।

সবজেয়ে বিষ্ময়ের বিষয় হলো আমেরিকার কোন নির্বাচনের ইতিহাসে ফলাফল মেনে না নেয়ার ঘটনা কোনদিন না ঘটলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকার বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী এসব শহরের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। অনেক শহরের বাসিন্দাই তাদের ক্ষুদ্ধ মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। কয়েক হাজার মানুষ নিউইয়র্কে ট্রাম্প টাওয়ারের সামনে অবস্থান নিয়ে অভিবাসন, সমকামী অধিকার বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির বিরোধিতা করছেন। এ সময় পুলিশ সেখানে কড়া অবস্থান নেয়। পোর্টল্যান্ড, ওরেগনের মতো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভকারীরা আমেরিকার পতাকা পুড়িয়েছে। এ সময় তারা একটি আন্তঃরাজ্য মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। বুধবার ফলাফল নিশ্চিত হওয়ার কিছু পরেই ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে আর অকল্যান্ড শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে শ্লোগান দেন, 'আমার প্রেসিডেন্ট নয়"। পশ্চিম উপকূলের আরো কয়েকটি শহর আর শিকাগোতে ছোট আকারের বিক্ষোভ হয়েছে। এসব বিক্ষোভে অংশ নেয়াদের বেশিরভাগই ছিলেন শিক্ষার্থী আর তরুণ ভোটাররা। সূত্র : বিবিসি বাংলা ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর সিয়াটলে বিক্ষোভের কাছে গুলিতে পাঁচজন আহত হয়েছে। রয়টার্স রয়টার্সের সূত্রমতে বুধবার রাতে ডাউন টাউনে বাক বিতণ্ডার পর এক ব্যক্তি গুলি শুরু করে। আহত পাঁচজনের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানানো জানা গেছে। কাঙ্খিত ভোটের ফল মেনে নিতে না পারায় বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভে নামে হাজারো মানুষ। তাদের মিছিলে স্লোগান শোনা যায়, 'ট্রাম্প আমার প্রেসিডেন্ট নয়'।

শুধু তা ই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার জনগণ সত্যি সত্যিই দেশটি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা এখন বিবেচনা করছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল অঙ্গরাজ্য ক্যালির্ফোনিয়ায় স্বাধীনতার দাবি উঠেছে। টুইটারে ক্যালিফোর্নিয়ার বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলার পাশাপাশি স্টেট রাজধানী স্যাক্রোমেন্টেতে সমাবেশেরও ডাক দেওয়া হয়েছে। 'ইয়েস ক্যালিফোর্নিয়া ইনডিপেনডেন্স ক্যাম্পেইন' নামে একটি গোষ্ঠী বুধবার থেকেই জোরেশোরে এ প্রচার শুরু করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের হয়ে যাওয়ার এ প্রক্রিয়া পরিচিতি পেয়েছে 'ক্লেক্সিট' নামে। সন্দেহ নেই এ বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া 'ব্রেক্সিটে'র নাম অনুসরণ করেই এই নামকরণ। এই গোষ্ঠী ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য বেশ আগে থেকেই প্রচারণা চালিয়ে আসছে।

ইয়েস ক্যালিফোর্নিয়া গোষ্ঠীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনীতির অঞ্চল ক্যালিফোর্নিয়া অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ফ্রান্সের চেয়ে শক্তিশালী। এর জনসংখ্যা পোল্যান্ডের চেয়ে বেশি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অন্য ৪৯টি অঙ্গরাজ্যের সঙ্গেই নয়, বিভিন্ন বিবেচনায় যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে ক্যালিফোর্নিয়া।' বিবৃতিতে আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মূল্যবোধ আছে যেগুলোর সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার বিরোধ আছে। এভাবে থাকার অর্থ হলো আমরা অন্য রাজ্যগুলোর জন্য অব্যাহতভাবে আমাদের ক্ষতি করে যাব, আমাদের শিশুদের অকল্যাণ বয়ে আনব। এখানে উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫৫টি ইলেকটোরাল ভোটের ক্যালিফোর্নিয়ায় জয় পেয়েছেন ট্রাম্পের কাছে পরাজিত ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে আরও জানা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক অভিবাসী কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। দেশ দুটিতে তারা স্থায়ী বসবাসের ভিসাও খুঁজছেন।  ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর হাজার হাজার মার্কিনি কানাডা সরকারের অভিবাসন বিষয়ক ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করেন। একইসঙ্গে অনেক মানুষ এ চেষ্টায় সাইটটি বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে নিউজিল্যান্ড সরকারের অভিবাসন বিষয়ক ওয়েবসাইটেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিজিট উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। নিউজিল্যান্ড সরকারের অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাস ও শিক্ষা সংক্রান্ত ভিসা প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করেন। গত দুই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই ক্যাটাগরির ভিসা আবেদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। তারা বলছেন, ১ থেকে ৯ নভেম্বরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক হাজার ৫৯৩ জন নিউজিল্যান্ডে স্থায়ী বসবাস ও শিক্ষা ভিসার আবেদন করেছেন। অন্য সময় এক মাসে যে সংখ্যক আবেদন পড়ে, গত সাত দিনে তার চেয়ে ৫০ শতাংশ আবেদন বেশি পড়েছে। একইভাবে কানাডায় পাড়ি জমাতেও অনেক আমেরিকান অভিবাসী, দূতাবাসের ওয়েভসাইটে ভিজিট করছে।

আমাদের দেশে অনেক সময় নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ার অনেক নজীর থাকলেও আমেরিকার ইতিহাসে এমন ঘটনার কোন উদাহরণ নেই। কিন্তু মজার ব্যপার হচ্ছে, সব স্পেক্যুলেশন ও প্রেডিকটেশন ভুল প্রমাণ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচনের ফল মেনে না নিয়ে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটলো। এ বিক্ষোভ কোন বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ নয়, বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী এসব শহরের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। অনেক শহরের বাসিন্দাই তাদের ক্ষুদ্ধ মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। এখন দেখার বিষয় ডোনাল্প ট্রাম কি বলেন!