তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বদলাতে পারে স্বাস্থ্যসেবার মান

মোঃ মাহবুবুল হুদা
Published : 7 Sept 2017, 02:28 AM
Updated : 7 Sept 2017, 02:28 AM

ঘটনাচক্র

সাজিদ সাহেবের বয়স ৫৫ বছর। তিনি ঢাকায় একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ২ মাস আগে কাজ করার সময় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়ে বাম হাতে প্রচণ্ড আঘাত পান। সেই আঘাতের চিকিৎসার জন্য তিনি একজন হাড়-জোড় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পারেন যে তাঁর হাতটি কনুইয়ের নীচে ভেঙ্গে গেছে এবং তিনি ভদ্রলোকের হাতটি দক্ষ হাতে ভাল ভাবে প্লাস্টার করে দেন। ভাঙ্গা হাতের ব্যথা প্রশমনের জন্য ডাক্তার সাহেব অন্যান্য ঔষধের সঙ্গে উচ্চ মাত্রার ব্যথা নাশক ঔষধ লিখে দেন। সাজিদ সাহেবও ১ মাস সেই ঔষধ সেবন করেন। কিন্তু তারপরই ঘটে বিপত্তি।

হঠাৎ করেই একদিন তিনি কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন এবং একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে যান। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারেন যে ভদ্রলোকের কিডনিতে জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে, আর সেটা হয়েছে ১ মাস ধরে উচ্চ মাত্রার ব্যথা নাশক ঔষধ সেবনের জন্য। ডাক্তার সাহেব এই কথা যখন সাজিদ সাহেবকে জানালেন, তখনই তাঁর ৫ বছর আগে কিডনি বিশেষজ্ঞের সাবধান বাণী মনে পড়ে গেল।

৫ বছর আগে তিনি কোমরের ব্যথার কারণেই একবার কিডনি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছিলেন এবং তখনই ডাক্তার সাহেব তাঁকে ভবিষ্যতে সাবধানে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেনবিশেষ করে ঔষধ সেবনের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন না করলে তাঁর কিডনির মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে বলে সাবধান করেছিলেন। কিন্তু ৫ বছর পর তিনি সেই সাবধান বাণী ভুলে গিয়েছিলেন এবং তাঁর রোগের ইতিহাস হিসেবে পুরাতন প্রেসক্রিপশন সংরক্ষণে না থাকায় হাড়-জোড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে জানাননি। এর ফলে সাজিদ সাহেব নিজের অজান্তেই নিজের শরীরের অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছেন।

(এখানে সাজিদ সাহেব একটি কাল্পনিক চরিত্র, তবে উল্লেখিত ঘটনা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। বিশেষ করে স্বল্প শিক্ষিত সহজ সরল মানুষের ক্ষেত্রে।)

সম্ভাবনা ১

কিন্তু যদি অভিন্ন ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাজিদ সাহেবের প্রেসক্রিপশন প্রস্তুত করা হত তাহলে হাড়-জোড় ডাক্তার সাজিদ সাহেবের আইডি প্রেসক্রিপশন সফটওয়্যার এ প্রবেশ করানো মাত্রই তাঁর চিকিৎসার সম্পূর্ণ ইতিহাস স্বয়ংক্রিয় ভাবে স্ক্রিনে ফুটে উঠত। সে ক্ষেত্রে ডাক্তার সাহেব নিজে থেকেই জানতে পারতেন যে, এই রোগীর কিডনিতে সমস্যা রয়েছে। সুতরাং তাঁকে ব্যথা নাশক ঔষধ দেয়ার ব্যপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।   

ঘটনাচক্র ২

করিম চাচা গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন ডাক্তার দেখাবেন বলে। চাচা শহরে বসবাসরত তার ভাতিজাকে বিরক্ত করবেন না বলে সাইন বোর্ড দেখে সরাসরি একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন। ডাক্তার সাহেব তাকে রক্তের কয়েক প্রকার পরীক্ষা করানোর জন্য পরামর্শ দিলেন। চাচা ডাক্তার সাহেবের চেম্বারের পাশেই একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে গেলেন। রিপোর্ট হাতে নিয়েই ডাক্তার সাহেব গেলেন রেগে। তিনি বললেন, "আপনি তো অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করিয়েছেন এবং ওদের রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা কোনটাই আমার কাছে নেই।" এই বলে তিনি অনুমোদিত কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আবার পরীক্ষাগুলো করিয়ে আনতে বললেন। কিন্তু করিম চাচার কাছে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় কোন প্রকার ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই সে দিন তাকে গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল।

এরপর দ্বিতীয়বার শহরে এসে চিকিৎসা করানোর জন্য টাকা জোগাড় করতে তার অনেক সময় লেগে যায় এবং ততদিনে তার সমস্যা ভয়ংকর আকার ধারণ করে।

(এখানেও করিম চাচা চরিত্রটি কাল্পনিক।)

সম্ভাবনা ২

তবে যদি এমন হতো, ডাক্তার সাহেব করিম চাচার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপদেশ সহ প্রেসক্রিপশনটি হাতে না লিখে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রস্তুত করতেন, আর ডায়াগনস্টিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে কেবল মাত্র অনুমোদিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলি সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অনুমতি পেত ও সেই ডাক্তারের নিকট সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ভাবে পৌঁছে দিত তাহলে করিম চাচাকে মানহীন অননুমোদিত কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার কোন ভাবে প্রতারিত করতে পারত না। এমন কি এ ধরনের কোন অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান সহজে ধরা পরার ভয়ে ব্যবসা করার সুযোগই পেত না। 

ঘটনাচক্র ৩

আবির সাহেব তার মুমূর্ষু সন্তানের জরুরী ঔষধ আনার জন্য তাড়াহুড়া করে ফার্মেসীতে গেলেন। বিক্রেতা প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ দিলেন। তাড়া থাকায় আবির সাহেব কোন কিছু মিলিয়ে না নিয়েই ঔষধ নিয়ে চলে এলেন এবং সন্তানকে খাইয়ে দিলেন। কিন্তু ঔষধ সেবনের আধা ঘণ্টার মধ্যেই তার সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায় যে, ভুল ঔষধের কারণে সন্তানটির মৃত্যু হয়। না, ডাক্তার সাহেব কোন ভুল প্রেসক্রিপশন করেন নি, ভুল করেছে সেই ফার্মেসীর বিক্রেতা। সে প্রেসক্রিপশন বুঝতে না পেরে অন্য ঔষধ দিয়ে দিয়েছে যা ঐ রোগীর জন্য ছিল প্রাণঘাতী। কিন্তু কোন প্রমাণ না থাকার কারণে সেই বিক্রেতা তার মারাত্মক ভুলটি অস্বীকার করে এবং শাস্তি পাওয়া থেকে বেঁচে যায়।

(এখানে আবির সাহেবের চরিত্রটিও কাল্পনিক)

সম্ভাবনা ৩

এ ক্ষেত্রেও যদি অনুমোদিত সকল ফার্মেসীগুলিকে সেই কেন্দ্রীয় ও সমন্বিত ডিজিটাল ব্যবস্থার আওতায় এনে তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হত তাহলে আবির সাহেবের সন্তানের প্রেসক্রিপশন তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই তা ফার্মেসীর কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে জমা হয়ে যেত এবং দেশের সকল অনুমোদিত ফার্মেসীগুলি সেই রোগীর ব্যক্তিগত আইডি'র বিপরীতে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের দেয়া ঔষধের নাম, মাত্রা, ধরণ ইত্যাদি হুবহু তাদের স্ক্রিনে স্বয়ংক্রিয় ভাবে দেখতে পেত এবং যে ফার্মেসী ঔষধগুলি বিক্রি করত সেই তথ্য স্বয়ংক্রিয় ভাবে কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে জমা হয়ে যেত  সেই ক্ষেত্রে হয়তো আবির সাহেবের সন্তানকে অকালে মৃত্যু বরণ করতে হত না কিংবা দুর্ঘটনা পরবর্তী দায়ী ব্যক্তিকে সহজেই সনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা যেত।

.

বর্তমান অগ্রগতি

পর্যায়ক্রমে সকল ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রেও নানান তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ডিজি হেলথ এর রয়েছে এমআইএস নামক ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থা।

তবে এমআইএস এ এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ভাবে সকল নাগরিকের জন্য বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ সংক্রান্ত এমন কোন জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই, যার মাধ্যমে কোন রোগী একটি মাত্র ব্যক্তিগত আইডি ব্যবহার করেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট কিংবা ফার্মেসী থেকে ঔষধ সংগ্রহ করতে পারেন এবং একই সঙ্গে তাঁর চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন, রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট ও ক্রয়কৃত ঔষধের সকল হালনাগাদ তথ্য কেন্দ্রীয় ভাবে সংরক্ষণ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে ঐ রোগীর যে কোন চিকিৎসার জন্য সহজলভ্য হয়   

সমস্যার সমাধানে আমার প্রস্তাবনা

সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এই খাতে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে এবং জাতীয় ভাবে এই খাতে কর্মরত সরকারি বা বেসরকারি সকল পেশাজীবী ও প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবেঅর্থাৎ,

ক) বাংলাদেশের সকল ডাক্তারদের জন্য রোগীর ব্যবস্থাপত্র তৈরি ও সংরক্ষনে অভিন্ন সফটওয়্যার প্রস্তুত ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।

খ)  সকল  সরকারী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জন্যও রোগী স্বাস্থ্য সেবার জন্য অভিন্ন সফটওয়্যার প্রস্তুত ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা

গ)  অনুমোদিত সকল রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে অভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।

ঘ)  অনুমোদিত সকল ফার্মেসী সমুহে অভিন্ন সফটওয়্যার প্রস্তুত ও তা ব্যবহারের মাধ্যমে ঔষধ বিক্রয় বাধ্যতামূলক করা।

) সকল ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের ঔষধ বিপণন ব্যবস্থার জন্য একটি অভিন্ন সফটওয়্যার প্রস্তুত ও তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।

উপরোক্ত সকল অভিন্ন সফটওয়্যার সমূহকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত করে সমন্বিত করা, যেন যে কোন অবস্থান থেকেই একজন রোগীর তথ্য সংশ্লিষ্ট ডাক্তার বা প্রতিষ্ঠান (হাসপাতাল/ক্লিনিক/ডায়াগনস্টিক সেন্টার/ফার্মেসী) খুব সহজেই তাৎক্ষণিক ভাবে জানতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারেন।

সুতরাং, স্বাস্থ্য সেবা খাতে বৈধ সংশ্লিষ্ট সকলের সুরক্ষা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং একই সঙ্গে অবৈধ চিকিৎসক সহ অবৈধ প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ব বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জাতীয় পর্যায়ে "অভিন্ন ও কেন্দ্রীয় সফটওয়্যার এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার  উন্নয়ন ও তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করণ" প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরী। তাহলেই যথা সময়ে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জন করা যাবে।

এ ছাড়াও অভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে, স্বাস্থ্য সেবা খাতের কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে সরাসরি সংগৃহীত তথ্য সমূহের অভিন্ন বিন্যাস ও গুণগত মান এই খাতে গবেষণারত সকল গবেষকের জন্য সহজলভ্য ও সহজবোধ্য হবে এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

এই সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলে ব্যবস্থাপত্র বিহীন ঔষধ বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করা সহজ হবে, যা করার কথা সরকারও ঘোষনা করেছে।

সুতরাং এরকম একটি জন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাননীয় ডিজি মহোদয়, মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি