জাবি ভিসির কেন পদত্যাগ করা উচিত!

মাহতাব ইউ রিবন
Published : 1 May 2012, 02:59 PM
Updated : 1 May 2012, 02:59 PM

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা কাটছেই না। প্রায় চার মাস যাবত 'শিক্ষক সমাজ' ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষকদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়েছে ক্যাম্পাস। দীর্ঘ সেশনজটে পড়ার আশংকা করছে শিক্ষার্থীরা।

গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর শিক্ষক সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৩২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেন উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। নিয়োগকে গণনিয়োগ আখ্যায়িত করে প্রতিবাদ স্বরূপ মানববন্ধনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটে 'শিক্ষক সমাজ'র। এর কিছুদিন পরেই ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দলে ৯ জানুয়ারী নিহত হয় ইংরেজী বিভাগের মেধাবী ছাত্র সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদ। সকালে তার মৃত্যুর খবর ক্যম্পাসে পৌঁছলে পরে হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। বজ্রবৃষ্টির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা হত্যাকারীদের আজীবন বহিষ্কারের দাবিতে অবস্থান নেয় প্রশাসনিক ভবনের সামনে। অবরোধ করা হয় উপাচার্যকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত যখন কোনো কিছুতেই উপাচার্য যখন নিজ ক্ষমতাবলে চিহ্নিত হত্যাকারীদের আজীবন বহিষ্কারের ঘোষণা দিচ্ছিলেন না তখন ভিসি পন্থী ছাত্রলীগ বলে পরিচিতরা 'ভিসি তোমার ভয় নাই রাজপথ ছাড়ি নাই' শ্লোগান দিয়ে তালা ভেঙ্গে তাকে বের করে নিয়ে যায়। পরে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে। যৌথ আন্দোলনে ক্যাম্পাস যখন বিক্ষোভে আবারও উত্তাল তখন 'জুবায়ের হত্যার পরে কি করণীয়' এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতি ১০ জানুয়ারী সাধারণ সভা আহ্বান করে। সভায় সব শিক্ষক যখন দায়িত্বে অবহেলার জন্যে তৎকালীন প্রক্টরকে দুষছিলেন তখন উপাচার্যপন্থী শিক্ষকরা সভায় তালগোল পাকিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষদের সাথে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে । উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সভা পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত মূলতবি ঘোষণা করেন সভাপতি। প্রথমদিন সভায় সাংবাদিকরা উপস্থিত থাকলেও পরদিন তাদেরকে থাকতে দেয়া হয়নি। প্রথমদিনের চেয়েও খারাপের দিকে যাওয়ায় সভা শেষ ঘোষণা করে বের হতে গেলে প্রক্টর আরজু মিয়া নিজেই শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করে।

ক্ষোভে ফেটে পড়ে 'শিক্ষক সমাজ'। জোরালো হয় প্রক্টর এবং প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের বিষয়টি। পরে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন প্রক্টর। অপসারণ করা হয় প্রক্টরিয়াল বডি। জুবায়ের হত্যায় জড়িত সন্দেহে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয় ১৩ ছাত্রকে। থেমে যায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।

এরপরে 'শিক্ষক সমাজ' জুবায়ের হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, প্রশাসনের সন্ত্রাসে মদদ-দান বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এ মামুনকে লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার, সব শিক্ষার্থীর সহাবস্থান, বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত শিক্ষক এবং গণনিয়েগের ধারা বন্ধ, জীব-বৈচিত্র রক্ষা, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ ও ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী উপচার্য প্যানেলসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নির্বাচনের দাবিতে ৮ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। উপাচার্যও তাদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু পরে দাবি আদায় না হলে শিক্ষকরা অনশন, প্রশাসনিক ভবন অবরোধ, প্রতিবাদ সমাবেশ, ক্লাস বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। গত ১ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য ঘোষণা দেন ১২ হাজার শিক্ষার্থী চাইলে তিনি পদত্যাগ করবেন। উপচার্য ভাল করেই জানেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা ১২ হাজার ছাত্র-ছাত্রীরই শিক্ষক।

১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৩৮ বছরে ৩৪০ জন শিক্ষক নিয়োগ হলেও বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের সময়ে নিয়োগ পেয়েছেন ১৯৬ জন শিক্ষক। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের অনেকের বিরুদ্ধে ক্লাসে পড়াতে না পারার অভিযোগ রয়েছে। আবার সবাই নিয়োগ পেয়েছেন দলীয়, অঞ্চল কোটার ভিত্তিতে। নিয়োগ তালিকায় রয়েছে আসামি ও দেয়াল টপকে ভাইভা দেয়া প্রার্থী।
আবার আসি শিক্ষকদের ৮ দফা দাবি প্রসঙ্গে। এই দাবি গুলোতে এমন কি ছিল যে তা উপাচার্য মেনে নিতে পারলেন না। একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে এমন কোন দাবি আমরা দেখিনা যা মেনে নিলে উপাচার্যের কোনো সমস্যায় পড়তে হতো। কিন্তু তিনি শিক্ষকদের একটি দাবিও মেনে নিলেন না। তাই শিক্ষকরাও বাধ্য হয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে চলে আসেন।

গত ১০ মার্চ থেকে এই দাবিতে কার্যালয়ে উপাচার্যকে অবরোধের আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষকরা। ঐদিন থেকে উপাচার্য তার কার্যালয়ে আসতে পারছেন না। সবার প্রশ্ন তিনি কেন অফিসে আসছেন না? বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে চলছে? সর্বশেষ যখন সাংস্কৃতিক জোটের নেতা-কর্মীরা তাদের নায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করে ঠিক তখন আবারও ভিসি লীগের মাধ্যমে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মীদের হাত-পা ভেঙ্গে দিলেন। দেশে জরুরী অবস্থার মতো ক্যাম্পাসে মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা কেউ তা মানলেন না। প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন চলছে। এবার শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগ চাইলেন। কথা না রেখে উপাচার্য বললেন তিনি পদত্যাগ করবেন না। আন্দোলন উপাচার্যের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত চলবে। প্রশ্ন হলো উপাচার্য কি তার অপরাধ বুঝতে পেরেছেন? যদি বুঝতে না পারেন তাহলে তাকে মনে করিয়ে দেই তার আমলে দুইশ'র বেশী শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কথা, যাদের অধিকাংশ অযোগ্য শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত। এলাকা ভিত্তিক, আত্মীয় কোটায় নিয়োগ দেয়া। লেক পরিষ্কার করে মাছ চাষ করার কথা, হলুদ চাষ করার কথা, ক্যাম্পাসের পরিবেশ বিনষ্ট করে সবুজ গাছ কেটে ফেলা। শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষককে, ছাত্রের বিরুদ্ধে ছাত্রকে, কর্মচারীর বিরুদ্ধে কর্মচারীকে এমনকি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাংবাদিককে তিনি শত্রু হিসেবে লেলিয়ে দিয়েছেন। উপচার্য তার এসব হাজারও অপকর্ম যদি বুঝতে পারেন তাহলে তার অবশ্যই পদত্যাগ করা উচিত।