বিশেষ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতার হোক ‘বিশেষ’ মূল্যায়ন

মল্লিকা রায়
Published : 22 Dec 2018, 10:41 AM
Updated : 22 Dec 2018, 10:41 AM

এমন কিছু কথা থাকে যা বলা অনেক বেশি জরুরি। বিশেষ শিশু বা স্পেশাল চাইল্ডদের কথা বলা ও জানাও তেমনি গুরুত্ব রাখে আমাদের জন্য।

গত ৩ ডিসেম্বর ছিল ২৭তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস এবং ২০তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। যদিও 'প্রতিবন্ধী' শব্দটি আমি লিখতে চাই না; এই শব্দটি বড় অপয়া। 'প্রতিবন্ধী' এমন একটি শব্দ যা মানুষের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করে;  একটি মানুষ থেকে অন্য মানুষকে আলাদা করে।

আমি জেনেছি উন্নত বিশ্বে  'ডিজেবল' (Disable)  শব্দটি এখন আর তেমন ব্যবহার হয় না। এর পরিবর্তে বলা হয় স্পেশাল চাইল্ড। কখনো কখনো বলা হয়  'গড গিফটেড'।

একটি শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিশুও কথা বলা শিখতে পারে, যদি সঠিক এবং সহায়ক প্রযুক্তিসহ পুনর্বাসন এবং প্রতিবিধানমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রবণ-বাক প্রতিবন্ধকতা দূর করা যায়।

আমার আত্মজকে 'ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট' প্রযুক্তির মাধ্যমে ২০০১ সালে সবাক করা সম্ভব হয়েছে। তখন এর কোনো ধারণাই ছিল না বাংলাদেশে। ছেলেকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে যখন ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের জন্য যাই তখন আমি ঈশ্বরের কাছে একটি 'ম্যাজিক' চেয়েছিলাম, যেন আমার ছেলের মতো যারা শ্রবণ প্রতিবন্ধী তারাও সবাক হতে পারে।

দেশে ফেরার পরে এমন অনেক বাবা-মায়ের কথা ভেবে 'বায়োনিক ইয়ার সোসাইটি অব বাংলাদেশ' সংগঠন গড়ে তুলি। অডিটরি ভারবাল থেরাপি এবং চিলন্ড্রেন বিহেবিয়ার ম্যানেজমেন্টের উপর প্রশিক্ষণ নেই  বিশ্বখ্যাত অডিটরি ভারবাল থেরাপিস্ট  জুডি সিমসার এবং এন্ড্রু কেন্ড্রিকের কাছ থেকে।

২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি এই সংগঠনের আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য। এই সেমিনারেই দেশে 'ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট' প্রোগ্রামের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরবর্তী ২-৩ বছরের মধ্যে প্রোগ্রামটি বাস্তবায়িত হয়। আর  এর মধ্যে দিয়েই আমার প্রার্থনার সেই  'ম্যাজিক' বাস্তবে দেখতে পেলাম দেশেও।

আমার ছেলে বাংলাদেশে প্রথম ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শিশু। তাকে সমাজের প্রচলিত শিক্ষার মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে আমাকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। সমাজে এমন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তাদের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সহায়তার প্রয়োজন হয়।

বিদেশে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হলেও বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে এ সম্পর্কে কোনো ধারনাই ছিল না। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য পাবলিক পরীক্ষায় প্রতি ঘন্টায় ১০ মিনিট অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে এমন বিশেষ শিক্ষার্থীদের লেখার মান ও  গতি আশানুরূপ নয়।

এই বাস্তবতার আলোকে আমার ছেলে শতদ্রু শতদল রায়ের খাতা বিশেষভাবে মূল্যায়নের আবেদন করি। এতে সাড়া দিয়ে  শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৫ সালে এসএসসি এবং ২০১৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ৫৬ জন পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রও আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়।

সহানুভূতি নয় বরং প্রকৃত দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করলে এমন বিশেষ শিশুদের মাঝে অনেক সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে। আমি এমন অনেক মায়ের কথা জানি, যাদের সমস্ত চেতনায় রয়েছে নিজের বিশেষ শিশুটির সাফল্যে উদ্ভাসিত মুখ দেখার আকাঙ্খা। এমন অনেক শিশু আছে যারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে চিরাচরিত ধারায় প্রচলিত শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে।

হয়ত অল্প সংখ্যা মা এই যুদ্ধে জয়ী হচ্ছেন, আর বাকিরা ঝরে পড়ছে কালের অতলে।

আমার সন্তান যদি ভিনদেশে গিয়ে তার বিশেষ চাহিদার ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের ৭৫ শতাংশ সময় বেশি পায় তাহলে আমাদের দেশের সন্তানেরা নিজ দেশে কেন এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে? যে ছেলেটি পা দিয়ে বা মুখ দিয়ে লিখছে সে কেন পাবে না নির্ধারিত সময়ের ৭৫ শতাংশ সময় বেশি?

এই বৈষম্য আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই এই লেখার মাধ্যমে প্রতিটি বোর্ডের বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, ভিসি, প্রোভিসি, শিক্ষক প্রতিনিধি এবং পরিচালনা পর্ষদের কাছে আন্তরিক আবেদন জানাচ্ছি, এই দেব শিশু ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্বাভাবিক অধিকার নিশ্চিতে সবাই এগিয়ে আসুন।