বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা: ‘সমন্বিত পদ্ধতি’র বিকল্প

চন্দ্র নাথ
Published : 7 Jan 2012, 06:00 PM
Updated : 23 Feb 2020, 02:50 PM

গত কয়েকদিন শুধু নয়, গত কয়েক বছর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা আলাদা  আলাদা করে না নিয়ে সমন্বিত ভাবে বা গ্রুপ ভিত্তিতে গুচ্ছভাবে সমন্বিত করে নিলেই নাকি সব সমস্যা সমাধান হবে। কী করলে যে কী হবে সেটা নিয়ে অনেক অনেক মতামত।

বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে গত নভেম্বর, ২০১৯ এর শুরু থেকে আমার মনে হতে লাগলো যে, এই সমস্যার একটা সমাধান আমি খুঁজে বের করবো। এই লেখায় আমি একটা প্রস্তাবনা দিতে চাই বিভিন্ন ধরনের পয়েন্ট মাথায় রেখে। এর নাম রেখেছি ইনস্টিটিউশনাল বোর্ড কানেক্ট (সংক্ষেপে আইবি কানেক্ট) ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি। কয়েকটি ক্রমে আমি প্রথমে বর্তমান সমস্যা, প্রস্তাবিত সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতির সমস্যা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বতন্ত্র কিছু ভাবনা, এবং পরিশেষে নতুন প্রস্তাবটা দিতে চাই। আশা করি এটা বোধগম্য হবে অনেকেরই, প্রয়োজনে আলোচনা সাপেক্ষে পরিমার্জন করা যেতে পারে।

ক. বর্তমান মূল সমস্যা:
১) যাতায়াত ও ব্যবস্থাপনা: প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কারণে আগ্রহী সব শিক্ষার্থীকে দেশের অনেকগুলো ক্যাম্পাসে যাতায়াত এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। ভর্তি পরীক্ষার সেশনে প্রায় দুই মাসের মধ্যে ৩০/৪০ কর্মদিবসে দেশের প্রায় ৪৫+ ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ধরে নিচ্ছি, একজন গড় মানের বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ারিং সহ জেনারেল বিজ্ঞান/সমাজ/বাণিজ্য নিয়ে ৮-১০ টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবে। তাহলে প্রস্তুতি, যাতায়াত, দেশের অন্য প্রান্তে কোনও জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করা খুবই ক্লান্তিকর। বলাবাহুল্য নিজের শহর বা জেলার বাইরে অন্য কোনো ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলে যাতায়ত বাবদ প্রায় দুই দিন চলে যাওয়ার কথা। অনেকেরই আগ্রহে ভাটা পড়ে। একজন ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার প্রস্তুতি নিবে কিভাবে?

২)  ব্যয়: ৭-৮ টা ভর্তি পরীক্ষার জন্য ফর্ম কেনা, যাতায়াত ভাড়া, থাকা-খাওয়া, ইত্যাদি মিলে অনেক খরচ। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেকের জন্য এটা অনেক বড় একটা ইস্যু। যে পরিবারে, বিশেষ করে গ্রামের একজন শ্রমিক বা দিনমজুর এর আয় যেখানে মাত্র ৩-৮ হাজার টাকা, সেখানে সেই পরিবারের একজন শিক্ষার্থীর পিছনে একটা ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা বাবদ ২-৩ হাজার টাকা জোগানো অনেক কষ্টের ব্যাপার। একটা ভর্তির চান্স নিশ্চিত করার জন্য ৫ টা ক্যাম্পাসে পরীক্ষা দিতে গেলে তো সেই পরিবার পথে বসার মত অবস্থা হয়ে যায়! এখানে অনেকেই ড্রপ-আউট হয়।

৩) নিরাপত্তা: অনেক শিক্ষার্থীর, বিশেষ করে মেয়েদেরকে তো নিজের শহরের বাইরে ভর্তি পরীক্ষা দিতেই আগ্রহী হয় না অনেক পরিবার। সে ক্ষেত্রে অনেক মেয়েই ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

৪) শারীরিক সুস্থতা ও দুর্ঘটনা: অনেক দূরে গিয়ে টানা একের পর এক পরীক্ষা দিতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে যায়। আবার অনেক শিক্ষার্থী বন্ধু-বান্ধবের সাথে বা একা ভ্রমণ করে পরীক্ষা দিতে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা বা কোনো অভিভাবককে যেতে হয়, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। এত অল্প বয়সে বাড়ি/বাসা থেকে একা ছাড়া বেশ বিপজ্জনক। যাত্রাকালীন দুর্ভোগ (যেমন, জ্যাম), অনেক দূরে নতুন একটা জায়গায় অচেনা পরিবেশে যাওয়া, ইত্যাদি অনেক বড় সমস্যা। অনেক অস্বচ্ছল পরিবারই এতে অনাগ্রহী হয়ে উঠে। তাই শিক্ষার্থীর ইচ্ছে থাকলেও পরীক্ষা দেয়া হয় না। তাছাড়া পরীক্ষা দিতে গিয়ে যাত্রাপথে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে এমন রেকর্ডও আছে।

আমি একটা টিম নিয়ে 'মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটা অলাভজনক সংগঠন চালাই গত কয়েক বছর ধরে। মূলত শিক্ষা সহায়তা নিয়েই আমাদের কাজ। অনেকগুলো প্রজেক্ট এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়/মেডিকেল ভর্তিচ্ছুদের বৃত্তির মাধ্যমে ফর্ম কেনা, যাত্রা খরচ দেওয়া, এবং চান্স পেলে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া একটা বড় কাজ, যেটা প্রায় ৩-৪ মাস আমাদের ব্যস্ত রাখে। ভর্তিচ্ছুদের আবেদনে দেওয়া তথ্য এবং সেগুলো যাচাই করে দেখা গেছে, ৫-১০ টা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য মাথাপিছু বাজেট লাগে প্রায় ১০-২৫ হাজার টাকা। অনেক খেটে খাওয়া, দিন মজুরি করে আয় করা, অথবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা অনেক পরিবারের আয় যেখানে মাত্র ২-৭ হাজার টাকা, সেখানে এত টাকা ব্যয় করে সেই পরিবারগুলো তাদের ছেলে-মেয়ে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ভর্তি পরীক্ষাতে অংশগ্রহণ করাতে চান না। একটা সময় (১৯৯৭ ব্যাচ, ১৯৯৮ সালের ভর্তি পরীক্ষা) আমি নিজেও এই সমস্যায় পড়েছিলাম। ঘর থেকে দেওয়া টাকা দিয়ে শুধু দুই জায়গা থেকে (বুয়েট এবং বর্তমান চুয়েট) ফর্ম কিনেছি। টাকার অভাবে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফর্ম কিনতে পারি নি। তাই এই দুর্ভোগ যে কি সেটা আমি জানি। ইতিমধ্যে প্রায় সবাই উপলব্ধিও করেছে যে, এই সমস্যাটা প্রকট।

খ. প্রস্তাবিত সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি ও নতুন সমস্যা:
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সরকারের ভাবনা ও উদ্বেগ লক্ষ্য করে, এবং সমস্যার সমাধানে তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সাথে বারবার বৈঠকে বসেছেন। বেশ কয়েকদিনের উপর্যুপরি বৈঠক করে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক ভাবে 'রাজি' করিয়েছে বললেন, যদিও এখনো বিষয়টা ফাইনাল হয় নি। তারা একটা সমাধান প্রস্তাব দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সিদ্ধান্ত সময় দিয়েছে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ১২ই ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী (https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1723388.bdnews), ওই প্রস্তাবে হয়েছে,

>> বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আগে যেভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে, তার প্রতি 'সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই' ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা হবে।

>> বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে 'অভিজ্ঞ এবং জ্যেষ্ঠ' শিক্ষকদের নিয়ে কলা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শাখার জন্য পৃথক পৃথক তিনটি কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা কমিটি গঠন করা হবে।

>> উচ্চ মাধ্যমিক ফল প্রকাশের পরপরই কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির নির্ধারিত তারিখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করবে। তিন শাখায় তিন দিন আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে।

>> প্রত্যেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকবে। ছাত্র-ছাত্রীরা অভিন্ন প্রশ্নে তাদের পছন্দ অনুযায়ী কেন্দ্রে পরীক্ষা দেবে।

>> কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি তাদের সামর্থ্যের (পরীক্ষা নেওয়ার) অতিরিক্ত আবেদন জমা পড়ে, তাহলে মেধাক্রম অনুযায়ী নিকটতম অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

>> কেন্দ্রিয় এই ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের একটি স্কোর তৈরি করে দেবে কেন্দ্রিয় ভর্তি কমিটি।

>> পরে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় আলাদাভাবে ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। সেখানে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শর্ত যোগ করতে পারবে।

>> বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন করে আর পরীক্ষা নিতে পারবে না। কেন্দ্রিয় পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোর বিবেচনা করেই তাদের শিক্ষার্থী ভর্তি করতে হবে।

>> তবে স্থাপত্য, চারুকলা ও সংগীতের মত বিশেষায়িত বিভাগগুলো তাদের প্রয়োজনমত ব্যবহারিক পরীক্ষা নিতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার স্কোর যুক্ত করে মেধাতালিকা তৈরি করতে হবে।

এই প্রস্তাবনায় অনেক নতুন সমস্যা ও সংকটের সৃষ্টি হবে এটা পুরোপুরি নিশ্চিত বলা যায়। বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য – এই তিন বিভাগে তিন দিনে মাত্র তিনটা পরীক্ষা। মানে একটা বিভাগে পরীক্ষা হবে মাত্র এক দিন। আচ্ছা, সমস্যাগুলো কেমন হতে পারে?

# একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষার দিন বা এর আগের দিন অসুখে পড়েছে। সুতরাং তার জন্য পাবলিক ইউনিভার্সিটির দুয়ার চিরতরে বন্ধ!

# সে পরীক্ষায় আসার আগে একটা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হল। পরিণতি একই!

# ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী নেয়ার জন্য যে মেধা যাচাই পরীক্ষা হয়, সেই স্ট্যান্ডার্ডে বর্তমানে শুধু বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট পরীক্ষা নেয়। এই স্ট্যান্ডার্ড এখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয় নাই। কোনো প্রশ্নের সমাধান শিক্ষার্থীকে বুঝে উত্তর দিতে হয়। অনেক প্রস্তুতি নিয়েও দেশের সামনের সারির অনেক শিক্ষার্থী সেখানে পাশ মার্ক তুলতে পারে না। এখন সমস্যা হলো এই পদ্ধতিতে প্রায় লাখ বা তার উপর শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেয়া হলে সেখানে শূন্যের কাছাকাছি নম্বর যে অনেকেই পাবে সেটা নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা না। বিশেষ করে যখন অনেক ভার্সিটিতে সাধারণ এমসিকিউ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়, সেখানেও শুধু টিক মার্ক দিয়ে অনেকেই পাশ করতে পারে না! এখন লিখিত পরীক্ষা নিতে গেলেও বিপদ, আবার এমসিকিউ এর মাধ্যমে নিতে গেলেও ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে অনেক অযোগ্য শিক্ষার্থী চান্স পেয়ে যাবে। সেই ক্ষতি কেউ কখনো পোষাতে পারবে না।

# ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিগুলো অনেক যাচাই বাছাই করে অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেয়। একটা মাত্র ক্যাম্পাসে অল্প সংখ্যক প্রার্থী পরীক্ষা দেয় বলে সেই পরীক্ষা হয় অনেক নিয়ন্ত্রিত ও উচ্চমান সম্পন্ন। অন্যদিকে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির মত দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান প্রতি ইউনিটেই প্রায় লাখ খানেক শিক্ষার্থীকে একটা মাত্র ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দিতে গিয়ে অনেক সমস্যা সম্মুখীন হয়। প্রশ্ন ফাঁস হওয়া, অন্যের হয়ে নকল শিক্ষার্থীর পরীক্ষা দেওয়া, ইত্যাদি অনেক ইস্যু নিয়ে খবর আসে। শুধু একটা ইউনিভার্সিটিই যেখানে একটা ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা নিতে এত হিমশিম খায়, সেখানে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষা নেয়া কত বড় একটা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার, সেটা তো এমনিতেই যে কারো মাথায় আসার কথা।

# কার নেতৃত্বে এই পরীক্ষার সমন্বয় হবে? শিক্ষা বোর্ডগুলো যেখানে প্রতিটা পাবলিক পরীক্ষা নিতে হিমশিম খায়, অনেক জায়গায় নকলের মহোৎসব হয় (যেগুলো পত্রিকা বা মিডিয়ায় ভিডিওসহ আসে), সেখানে ভর্তি পরীক্ষার মত এত বড় ঝুঁকি নেওয়া কতখানি যুক্তি সঙ্গত?

# যেহেতু লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দেয়, তাই একই স্কোর পাওয়া শিক্ষার্থী কয়েক শত বা হাজার করেও হতে পারে। সেখানে থেকে কয়েকটা ইউনিভার্সিটির একই বিষয়ে ভর্তির জন্য (ধরে নিলাম ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি যেখানে প্রায় সবাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চায়) নির্দিষ্ট আসন সংখ্যার বিপরীতে বাছাই হবে কেমন করে? অথবা ওই বিষয় যে ভার্সিটিগুলোতে আছে, সেখানে সব মিলিয়ে ২,০০০ আসনের বিপরীতে একই স্কোর পাওয়া তিন হাজার শিক্ষার্থীর ভর্তি কেমন করে হবে? এটা কি একটা ডিজাস্টার নয়?

আরো অনেক অনেক সমস্যা তো আছেই, যেগুলো নিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটিগুলোতে কাজ করেন তারাসহ অন্য অনেকেই এমনিতেই বুঝতে পারবেন।
——————————–

গ) আমার প্রস্তাবনা – ইন্সটিটিউশনাল বোর্ড কানেক্ট (আইবি কানেক্ট) ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি

আগের দুই সেকশনে উল্লেখিত পয়েন্টগুলো এক সাথে বিবেচনা করে আমি আমার প্রস্তাবনা নিচে দিলাম। নিজেকে যে কোনো বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে ভেবে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে পারেন। আমি নিজেও কয়েকটা উদাহরণ দিব। চলুন, দেখে নিই প্রস্তাবনায় কী কী আছে-

১) ইন্সটিটিউশনাল বোর্ড কানেক্ট (আইবি কানেক্ট) ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি হলো, প্রতিটা ইনস্টিটিউট তার নিজের স্বতন্ত্র ধারা বা স্বকীয়তা বজায় রেখে অন্য কয়েকটা ইনস্টিটিউটের কলাবোরেশন সাহায্য নিয়ে পুরো প্রক্রিয়া সমন্বয় বা নিয়ন্ত্রণ করে কোনো একটা প্রজেক্ট সম্পন্ন করা। নাম থেকেই ধারণা করা যায় যে, এটা একটা শিক্ষাবোর্ড সিস্টেম বা প্রজেক্ট লিডারশিপ এর মতো, যেখানে একটা ইনস্টিটিউট লিডারশিপ নিবে  সেই ইন্সটিটিউটের 'ভর্তি পরীক্ষা' নামের প্রজেক্টটা সফলভাবে শেষ করার জন্য। ইনস্টিটিউশনাল কানেকশান এর মাধ্যমে একটা বোর্ড গঠনের মত প্রক্রিয়ার কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে ইন্সটিটিউশনাল বোর্ড কানেক্ট (আইবি কানেক্ট) ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি।

আমি ম্যানুফেকচারিং নিয়ে গবেষণা করি, প্রোডাক্ট বা পণ্য উৎপাদন করা হয় মেশিন এর মাধ্যমে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে 'মেশিন টুলস কানেক্ট' সংক্ষেপে MTConnect নামে একটা সফটওয়্যার আছে, যেটা অনেকগুলো মেশিনে তথ্য আদান-প্রদান করে অনেকগুলো প্রসেস বা প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে প্রতিটা প্রোডাক্ট বা পণ্য বানাতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতিতে ক্লাউডে থাকা একই প্ল্যান্টের অনেকগুলো মেশিন অথবা নেটওয়ার্কের ভিতর বিশ্বের যে কোনো অবস্থানে থাকা মেশিনগুলো কানেক্ট হতে পারে প্রোডাক্ট ডিজাইন এবং কোয়ালিটি তথ্য আদান-প্রদান এর জন্য। এই আদলেই ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি করার কথাটা মাথায় আসলো। এখানে একটা ইনস্টিটিউট নিজের স্ট্যান্ডার্ডে ভর্তি করার জন্য এককভাবে পরীক্ষা নিতে পারে, অথবা নিজের লাইনে, যেমন, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, বা জেনারেল সাবজেক্ট নিয়ে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মধ্যে ক্লাস্টার ফর্মও করতে পারে। ক্লাস্টার বা গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় আবারো একাধিক সমস্যা হয়ে যেতে পারে, যেহেতু পরীক্ষা মাত্র একবার দেয়া যাবে। যা হোক, একক লিডারশিপে স্বতন্ত্রভাবে এই ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার প্রক্রিয়াটা বিস্তারিত নিচে তুলে ধরছি।

ক. পুরো দেশে এখন প্রায় ৫০ টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আমি নিচে একটা লিস্ট দিয়েছি উইকিপিডিয়া থেকে নিয়ে, যেখানে ২০২০ পর্যন্ত আপডেইট আছে। এর সাথে পুরো দেশের মানচিত্রও দিয়েছি। লিস্ট এবং মানচিত্রের রেফারেন্সে বুঝে যাওয়ার কথা, আমি এখানে ৯ টা জোনে ভাগ করেছি যাতায়াতের সুবিধার কথা বিবেচনা করে। প্রতিটা জোনেই ৩টি বা তার অধিক ইউনিভার্সিটি আছে।

খ. যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা নিবে, সেই প্রতিষ্ঠান হবে একটা বোর্ড বা লিডার। সেই প্রতিষ্ঠান যেই জোনের, সেই জোনের বাইরে অন্য ৮ জোন থেকে একটা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে পারে তার নিজের করা প্রশ্ন দিয়ে নিজের ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য (কোন জোন থেকে বড় জোড় দুইটি নেয়া যেতে পারে, অথবা কোনো জোন বাদও যেতে পারে)। অন্য ৮ জোনের ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বা তার চেয়ে কম/বেশি) এক্ষেত্রে ইন্সটিটিউশনাল বোর্ড বা লিডার এর নিয়মাবলী মেনে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কাজে সাহায্য করবে। ইন্সটিটিউশনাল বোর্ড বা লিডার তার সেট করে দেয়া মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করার জন্য নিজের ইন্সটিটিউটের এক বা একাধিক সিনিয়র ফ্যাকাল্টি (যারা আগে ভর্তি কমিটিতে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন) ওই ৮ টা ইন্সটিটিউটে পাঠাতে পারেন। এর সাথে যেই জোনে পরীক্ষা হবে সেই জোনের বা তৃতীয় একটা জোনের এক বা একাধিক ইন্সটিটিউট এক্সটার্নাল এক্সামিনার হিসেবে পর্যবেক্ষণ করবেন। বাইরে থেকে যাওয়া কমপক্ষে এই দুই জন (নিজের এবং অন্য জোন এর ফ্যাকাল্টি) পুরো পরীক্ষার সময় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবেন এবং পরীক্ষা শেষে একটা করে রিপোর্ট দিবেন যেখানে একটা চেক লিস্ট এবং পর্যবেক্ষক/পরীক্ষক এর অভিজ্ঞতা ও মতামত থাকবে।

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র শুধু পরীক্ষার দিন সকাল বেলা প্রিন্ট করা হবে ওই দুই বা ততোধিক পর্যবেক্ষক/পরীক্ষক এর সামনে।

পরীক্ষা শেষে খাতাগুলো তৎক্ষণাৎ সিলগালা করে ইন্সটিটিউশনাল বোর্ড বা লিডার এর কাছে সেই দিনের/রাতের মধ্যেই পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

সম্ভাবনা ও সুবিধা-অসুবিধা   

পরীক্ষার সংখ্যা ও বন্টন ব্যবস্থা কেমন হবে?

উইকি অনুসারে বর্তমানে ছোট-বড় ইউনিভার্সিটি সংখ্যা ৫০। কোনো কোনো ইউনিভার্সিটিতে ৬ টি ইউনিটের পরীক্ষা হয় (যেমন, হাজী দানেশ বিপ্রবি), আবার কোনোটাতে হয় মাত্র একটি (যেমন, ৪ টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ৫ টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)। এখন গড়ে ৩ টি করে ধরলে মোট আনুমানিক পরীক্ষা নিতে হবে ১৫০ টি। সেক্ষেত্রে যে জোনে সবচেয়ে কম ইউনিভার্সিটি আছে (যেমন, রংপুর এবং বরিশাল), তাদের নিজেদের সহ অন্য ইনস্টিটিউটের লিডারশিপে পরীক্ষা নিতে হবে গড়ে ৫০টি করে। অন্যদিকে, ঢাকায় ৯ টি প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে গড়ে মাত্র ১৬/১৭টি করে পরীক্ষা নিতে হবে।

কিন্তু ঘাবড়াবার কিছুই নাই। ধরে নিলাম, রংপুরের বেগম রোকেয়া ইউনিভার্সিটির নিজেদের সহ মোট পরীক্ষা নিতে হবে ৫০টি। কিন্তু সেগুলো বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য – এই ৩ বিভাগে ভাগ করার কারণে প্রতিটা বিভাগের অধীনে পরীক্ষা পড়বে গড়ে ১৬-১৭ টি করে। এই ১৬-১৭ টি পরীক্ষার জন্য আবার টানা ১৬ দিন বরাদ্দ রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতি সপ্তাহে ৩ দিনে ৬ টি করে (সকা্লে ১টি, বিকালে ২ টি) পরীক্ষা নিলে বড় জোর ৩ সপ্তাহ লাগবে সবগুলো পরীক্ষা নিতে। যেহেতু একই জোনের ইউনিভার্সিটিগুলো অনেকটা কাছাকাছি, বড়জোর ঘণ্টার দূরত্ব পার্থক্য, তাই কোনো গ্রুপের কোনো পরীক্ষার্থী যদি ১০-১৫ টা পরীক্ষাও দেয় (যেমন বিজ্ঞান গ্রুপের কিছু প্রার্থী অন্যান্য বিভাগেও পরীক্ষা দেয়), এই ৩ সপ্তাহের মধ্যে সেগুলো দিতে পারবে, সাথে যথেষ্ঠ পরিমাণ বিশ্রাম পাবে ও নতুন পরীক্ষার প্রস্তুতি পাবে।

তার বিপরীতে বর্তমান অবস্থায় পরীক্ষা হয় প্রায় ২-৩ মাস ধরে, দেশের এক কোণা থেকে অন্য কোণায় দৌড়াতে হয় পরীক্ষার্থীদের, অনেকেই ৭-৮ পরীক্ষাও দিতে পারে না। আর অন্যান্য ভয়াবহ সমস্যাগুলো তো এই লেখায় বলেছি, সবাই সেটা জানেও।

প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে টানা সপ্তাহ পরীক্ষা নেয়া কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব?

হ্যাঁ, সম্ভব। কারণ, এখানে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, সবচেয়ে বড় শহরগুলো, যেমন ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ভর্তি পরীক্ষার্থীর অবস্থা তুলনামূলক বেশি, আবার সেখানে ইউনিভার্সিটির সংখ্যাও বেশি। তাই সেখানে টানা ৩ সপ্তাহ পরীক্ষা নিতে হবে না। আর পরীক্ষার ঘণত্বও কম হবে। যেমন, ঢাকায় ৯ টা ইউনিভার্সিটি আছে, কিন্তু পরীক্ষা সেই ১৫০ টিই। সেক্ষেত্রে প্রতি ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা পড়তে পারে তিন সপ্তাহে ১৫-১৬ টা। এক্ষেত্রে, প্রতি সপ্তাহে একটা ইউনিভার্সিটির দায়িত্ব ৫-৬ টা পরীক্ষা নেয়া, যেটা খুব সহজভাবে আয়োজন করা যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা রংপুর বা বরিশাল জোনের তুলনায় অনেক বেশি হবে। তারপরেও দেশের ৯ টি জোনে ভাগ হয়ে যাবার কারণে পরীক্ষা অনেক নিয়ন্ত্রিত হবে। পরীক্ষা ৩ সপ্তাহের জায়গায় ৪ সপ্তাহেও নেয়া যেতে পারে।

তো, রংপুর বা বরিশালে কিভাবে ১৫১৬ টা নেয়া হবে প্রতি সপ্তাহে?

সেটার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। একটা ইউনিভার্সিটি, ধরে নিলাম মাঝারি সাইজের ভর্তি পরীক্ষার্থী, যেমন চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি। ওদের জন্য রংপুর থেকে পরীক্ষা দেয়ার আগ্রহী প্রার্থী প্রতি বিভাগে নিশ্চয়ই হাজার হাজার হবে না। কয়েকশত পরীক্ষার্থীকে ২-৩ টা রুমেই ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যায় খুব নিয়ন্ত্রিত ভাবে। এতে ওই ইউনিভার্সিটির অন্যান্য নিয়মিত ক্লাশ নেয়াতেও বিঘ্ন ঘটবে না। ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের উপরও তেমন চাপ পড়বে না। আবার বিভিন্ন ধরনের সংকট, যেমন পরিবহন, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি নিয়েও সংকটে পড়তে হবে না। অনেক ক্ষেত্রে ভার্সিটির স্বাভাবিক পরিবেশটাও বজায় থাকবে।

ফর্ম মূল্য কি একই থাকা উচিত?
প্রতিটি পরীক্ষায় নিজেদের ইউনিভার্সিটির থেকে একই গ্রুপের (যেমন বিজ্ঞান, অথবা প্রকৌশল গ্রুপের ক্ষেত্রে সিভিল বা ইলেক্ট্রিক্যাল, ইত্যাদি) ২-৩ জন ফ্যাকাল্টিকে বাকী ৮ জোনের এক বা একাধিক জোনে পাঠানো বাবদ কিছু অতিরিক্ত খরচ হবে। আবার অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে প্রায় একই সময়ে কলাবোরেশনের কারণেও এক্সটার্নাল পর্যবেক্ষক হিসেবে পাঠনোর কারণে একটা খরচ হবে। কিন্তু সেটা ছাত্রছাত্রীদের যে পরিমাণ খরচ হয় দূর-দূরান্তের বিভিন্ন শহরে যাতায়াত করার জন্য, তার তুলনায় কিছুই না। অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নেয়ার জন্য ফর্ম বাবদ ৫-১০% ফি বেশি নেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ১০টা ইউনিভার্সিটি মিলে একজন শিক্ষার্থীর একটা ফর্ম এর মূল্য অতিরিক্ত যাবে, যেটা তাদের বাঁচানো খরচ এর তুলনায় তেমন কিছুই না।

পরীক্ষার্থীর সুবিধাসমূহ কেমন?
এদিকে সপ্তাহে ৩ দিনে ২টি করে মোট ৫-৬টি পরীক্ষা নেয়া মানে এই নয় যে পরীক্ষার্থীদের উপর চাপ পড়বে। কারণ, এখানে বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য, এই তিন বিভাগ আছে। একজন পরীক্ষার্থী যদি ১০-১৫ টি পরীক্ষা দেয়, সেগুলোকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ভাগ করে দিলে্‌ প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষা হবে সর্বোচ্চ ৫টি। যেহেতু সিলেবাস মোটামুটি একই, যদিও প্রশ্নপত্রের ধরণ ভিন্ন, পরীক্ষার্থীরা ১০-১৫ টির মধ্যে কয়েকটাতে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। আবারও উল্লেখ করছি, যেহেতু তাদের যাত্রা এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় খুব একটা সংকট হবে না, তাই প্রস্তুতিতে তেমন চাপ পড়বে না।

এদিকে নিজেদের বাড়ি থেকেও অনেক পরীক্ষার্থীই পরীক্ষার দিন এসে আবার ফিরে যেতে পারে, কারণ পরের পরীক্ষা অন্তত ১-২ দিন পরে হওয়ার কথা। আর যাত্রা, ও থাকা-খাওয়া সহ অন্যান্য খরচ অনেক কমে যাওয়ায় পরীক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি ইউনিভার্সিটির ফর্ম কেনার সুযোগ পাবে, আর দিনে এসে পরীক্ষা দিয়ে সেই দিনেই নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাবার নিশ্চয়তা থাকার কারণে অনেক মেয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে নিচে কয়েকটা উদাহরণ দিব।

উদাহরণ- ১

ধরে নিলাম একজন বিজ্ঞানের ছাত্র ভর্তি পরীক্ষার্থী। বাড়ি চট্টগ্রামের এক কোণায়, যেমন টেকনাফ বা কক্সবাজারে। সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আগ্রহী যে কোন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, একই সাথে ব্যাক আপ হিসেবে সুযোগ নিতে চায় কৃষিতে, অথবা জেনারেল ইউনিভার্সিটিতে (যেমন ঢাবি, রাবি) ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিজ্ঞানের কোনো একটা সাবজেক্ট, অথবা ঢাবির আইন বা বিবিএ। এখন তার কয়টা পরীক্ষা দিতে হবে?

উত্তর: উপরের হিসেবে সে ৫টা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫টা, ৩টা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩টা, ঢাবির ২ ইউনিট থেকে ২টা, এবং রাবির ২ ইউনিটের ২টা – অর্থাৎ মোট ১২টা পরীক্ষা দিবে। প্রকৌশল লাইনে পড়ার প্রস্তুতি নিলে নিশ্চয়ই এই ১২ টা থেকে কোনো একটা পেয়ে যাবে!

সে সব পরীক্ষা দিবে চট্টগ্রাম থেকে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষা দিবে চুয়েটে; ঢাবি এবং রাবির পরীক্ষা দিবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর কৃষি ইউনিভার্সিটিগুলোর পরীক্ষা দিবে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী ও প্রাণীবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবগুলোই চট্টগ্রাম শহরে, যা ঢাকা বা রাজশাহীর চেয়েও অনেক বেশি চেনা এই শহর তার জন্য, যেতে পারবে স্বাচ্ছন্দ্যে। কাছের কেউ নিয়ে যেতে হয়তো দ্বিধা করবে না যদি তার বাবা-মা নিরক্ষর এবং শহরের কিছু নাও চেনেন। এই জায়গায় প্রার্থী মেয়ে হলেও যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা ঢাকা, রাজশাহীর তুলনায় অনেক বেশি সহজ। এমনকি একই দিনে এসে পরীক্ষা দিয়ে আবার ফিরে যাওয়া যাবে। যেহেতু ৩-৪ সপ্তাহে পরীক্ষা হবে, তাই তেমন কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই এই ১২ টা পরীক্ষা দেয়া খুব সম্ভব।

এর বিপরীতে সে যদি এই ১২ টা ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা দিতে যেত, তাহলে কী রকম হতো ব্যাপারটা? এই ১২ টা পরীক্ষার জন্য প্রায় দুই মাস দিন লম্বা লম্বা যাত্রা এবং থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা। আর গ্রামের একটা মেয়ে হলে তো এতগুলো পরীক্ষা দেয়া অনেকটা কাল্পনিক ব্যাপার!

এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার। প্রকৌশল বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক জোট বা গুচ্ছ করে একটা করে পরীক্ষা নিলেও হয়, তবে সেখানে শিক্ষার্থীর অপশন কমে যাবে, কারণ একই লাইনে পরীক্ষা মাত্র একটি। সেটা যদি একান্তই নিতে হয় পরীক্ষার সংখ্যা কমানোর জন্য তাও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার চেয়ে ঢের ভালো (যেটা এখন আংশিক ভাবে হচ্ছে শুধু নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্র করে কিন্তু জোন করে হচ্ছে না, যেমন ৩ টা কৃষি ভার্সিটির ৩ টা কেন্দ্র, অথবা প্রকৌশল ভার্সিটির জন্য সিলেটের কোন প্রার্থীকে বুয়েটে এসে পরীক্ষা দিতে হতে পারে)।

উদাহরণ- ২

একজন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, বাড়ি বরগুনা। বিজ্ঞান, কলা বা বাণিজ্য বিভাগে ঢাবি, জাবি, চবি, খুবি, শাবিপ্রবি, বরিশাল জোনের ৩টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব- এই ৮ টা ভার্সিটির যে কোনো একটাতে পড়লেই হবে। কেমনভাবে হবে তার পরীক্ষাগুলো?

উত্তর: সে বরিশাল এর তিনটা ইউনিভার্সিটিতেই পরীক্ষা দিবে। উল্লেখিত ৩-৪ সপ্তাহে এই ৮ টা ভার্সিটির পরীক্ষা নিশ্চয়ই নিজের বাড়ি থেকে যাওয়া-আসা করেই দেয়া সম্ভব। এখানে একমুখী যাত্রা সময় ২-৪ ঘণ্টার উপরে লাগার কথা নয়।

উদাহরণ- ৩ একজন শিক্ষার্থী মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগের (গড় রেজাল্ট ভালো), বাড়ি সিলেট। সে নিজের এলাকার শাবিপ্রবি সহ জাবি, জবি, রাবি, খুবি, চবি, কুমিল্লা ভার্সিটি, রবীন্দ্র ভার্সিটি, বেগম রোকেয়া ভার্সিটি – এই ৮ টি বা ধরে নিলাম ১০ টা ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে চায়। কিন্তু তার নিজের জেলায় মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগে শুধু শাবিপ্রবি-ই আছে। সে নিশ্চয়ই আগের দুইটা উদাহরণ এর মত সিলেটের ৪ টা ভার্সিটিতে গিয়ে এই ১০টা পরীক্ষা ৩-৪ সপ্তাহে দিয়ে আসতে পারবে।

উদাহরণ -৪ একজন খারাপ রেজাল্টধারী, বাড়ি কুড়িগ্রামে। কিন্তু কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়ার ব্যাপারে সে আশাবাদী। সে কমপক্ষে ৮-১০ টা ভার্সিটির ফর্ম কিনে রংপুরে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতে পারতো, যেটা আগের সিস্টেমে তো অনেকটা অসম্ভব।

আবার ইউজিসি-র নতুন প্রস্তাবনা অনুসারে মাত্র একটা পরীক্ষা দিতে পারার কারণে তার সম্ভাবনা অনেকটাই তো ক্ষীণ হয়ে যাবে, তাই না?

আরো অনেক উদাহরণ টানা যেতে পারে। সেগুলো খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে এই প্রস্তাবনা পরিমার্জিত করা যেতে পারে।

এই ইনস্টিটিউশনাল বোর্ড কানেক্ট এডমিশন (আই বি কানেক্ট) টেস্ট মডেলটার পরীক্ষা এবং সময় বিন্যাস একটা সফটওয়্যার এলগরিদম দিয়ে খুব সহজে কম্পিউটারের সাহায্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। এরপর পরীক্ষামূলক ভাবে সেটা প্রয়োগ করে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রতি বছর আপডেট করা যেতে পারে।

সারা বাংলাদেশে নিম্নের ৯ টি জোনের ভাগ করা যায় (ছবি সহ)

জোন১: ঢাকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বুয়েট

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বুটেক্স

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

————————————————————————

জোন২: ময়মনসিংহ

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোণা

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাংগাইল

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জ

———————————————————————

জোন৩: চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চুয়েট

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও প্রাণী বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়

রাংগামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

———————————————————————–

জোন: কুমিল্লা

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

লক্ষ্মীপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

———————————————————————–

জোন৫: সিলেট

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

———————————————————————-

জোন৬: রাজশাহী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রুয়েট

বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

———————————————————————–

জোন৭: খুলনা

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

কুয়েট

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

———————————————————————–

জোন৮: বরিশাল

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালঞ্জ

———————————————————————–

জোন৯: রংপুর

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন এন্ড এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়, লালমনিরহাট

———————————————————————–