প্যারেটো প্রিন্সিপাল, বৈষম্য, বিশ্ব জুড়ে আন্দোলনের সূত্রপাত এবং ভবিষ্যত কোনদিকে…

মামুন ম. আজিজ
Published : 16 Oct 2011, 10:10 AM
Updated : 16 Oct 2011, 10:10 AM

একাডেমিক লেখাপড়ার কত তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্ত আজ ভুলেই গেছি। অল্প স্বল্প যা মনের ক্ষুদ্র উপসাগরে মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন সূদূরের দিগন্তে যাত্রা করে ভেসে ভেসে সেই সব স্মৃতিপূর্ণ জ্ঞানের একটি হলো- প্যারেটো প্রিন্সিপাল কিংবা প্যারেটো নীতি। আশৈশব এই নীতিরই মূল বিষয়টির বহিঃপ্রকাশ অবলোকন করে চলেছি। সে প্রকাশ সমাজে, রাষ্ট্রে, রাজনীতিতে, শিল্প-সংস্কৃতি, খেলার মাঠে , সাহিত্য জগতে…কম বেশী হারে প্রায় সকল ক্ষেত্রে এবং বিশেষকরে অথর্নীতির ক্ষেত্রে দেখা যায় খুব স্পষ্ট ভাবে।

কি সেই প্যারেটো নীতি– না জানার দলও কিন্তু আসলে ঠিকই জানেন। এই নীতির আরেক নাম ৮০-২০ রুল। ভদ্রভাবে বিশ্লেষণ করলে সংক্ষিপ্ত রূপটি হলো -….for many events, roughly 80% of the effects come from 20% of the causes। মানে – ২০ ভাগ কারনে ৮০ ভাগ প্রভাবের উদ্ভব। ..কঠিন হয়ে গেলো? এত কঠিন্ নয়..মূল বিষয় খুব সমাজ ঘনিষ্ঠ। ৮০ ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত থাকে ২০ ভাগ লোকের কাছে। ঠিক তেমনি ৮০ ভাগ লোকের কাছে থাকে মাত্র ২০ ভাগ সম্পদ। এই হলো মূল কথা।

১৯০৬ সালে ইটালীর একজন অথর্নীতিবীদ ভিলফ্রেডো প্যারেটো লক্ষ্য করেন যে সেই সময় ইটালীর ৮০ শতাংশ জমি মাত্র ২০ শতাংশ মানুষের দখলে। সমসাময়িক অন্যান্য দেশে দিকে লক্ষ্য করেও তিনি সমরূপ ফল পান। সেই থেকে তিনি তার ৮০-২০ রুল ব্যাখ্যা করেন। এর আরও অনেক ব্যাখ্যা, প্রয়োজনীয়তা , ফল আছে অথর্নীতিতে ,সে সব জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এই ব্লগ লেখার মূলত উদ্দেশ্য নয়।

১৯০৬ সালের দিকে এই আমাদের উপ-মহাদেশে বা অবিভক্ত ভারতেও জমিদারী প্রথা ছিল। সেখানেও হিসেব করলে দেখা যাবে ৮০-২০ রুলের ব্যত্যয়তো ঘটেনি বরং ৯০-১০ ও হয়ে উঠেছিল হয়তো। সকল জমির মালিক ভূ-স্বামী, জমিদার , শাসক বা শোষকরাই ছিল কেবল। আর সব ছিল ভূমিহীন। ..

সেসইসব কাল শেষ হয়ে গেছে কবেই। রাজতন্ত্র, জমিদারী প্রথা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে আর মানুষ সভ্যতার চরম গহ্বরে নিজেকে প্রবেশ করাতে পারার সুতীব্র আকর্ষনে নতুন নতুন প্রথা আর ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটিয়েছে। গনতন্ত্র , পুঁজিবাদ সেইসব উদ্ভাবনের টিকে যাওয়া বর্তমান।

অথচ প্যারেটো নীতির ব্যতয় ঘটেনি। যার কারেন আজও বিশ্বের মোট অর্থ সম্পদের সিংহভাগ গুটিকয়েকের হাতে আর অধীকাংশ মানব জাতি নিঃস্ব প্রায়। ফলে সেই বহুকালের সেই মানব সভ্যতার অমোঘ বাস্তবতা- সেইবৈষম্য আর দূরই হলো না। বরং শিল্প আগ্রাসন, রাজনৈতিক আগ্রাসন, বিশ্বে ক্ষমতার অসাম্যতা, যুদ্ধ বিগ্রহ, ধর্মীয় ভ্রান্তি ও গোঁড়ামি আর উগ্রবাদ… এসকল নানান কারনে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। ….

কিন্তু এ কি মানবজাতির এবং মানব সভ্যতার ধ্বংসের আগ পর্যন্ত টিকে থাকা বাস্তবতা হয়েই রবে? যুগ বদলাবে,পদ্ধিতি ও নীতি বদলাবে কিন্তু ৮০-২০ রুল কি বদলাবে না? ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় এইরূপে যে তা বদলায়নি কখনও পূর্ণ রূপে। আর তাই বুঝি গত ১৫ই অক্টোবর পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়াজুড়ে।

ওয়াকুপাই ওয়ালষ্ট্রীট বা ওয়ালষ্ট্রীট দখল কর এই নামে নিউয়র্ক থেকে শুরু হয় আন্দোলন।

http://www.youtube.com/watch?v=KTlFXCBxQgw
ওয়াকুপাই ওয়ালষ্ট্রীট এর একটি ভিডিও চিত্র

'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো' আন্দোলনের আদলেই বিশ্বের ৮২টি দেশের ৯৫১টি শহরে বিক্ষোভ হয়েছে শনিবার ১৫ই অক্টোবর। টাইম ম্যাগাজিনের এক খবরের বরাতে আমরা জানতে পারি-

What happens in New York, doesn't stay in New York. As Occupy Wall Street enters its fourth week, its power is resonating throughout Asia and Europe. Other key financial capitals, from Hong Kong to London, are joining the fray.


এই আন্দোলনকারীদের প্লাকার্ডে লেখা থেকে দেখা যায় ৮০ ভাগ না বরং
বৈষ্যম্যের স্বীকার ৯৯% বলেই তারা মানছে।

বিভিন্ন দেশের সরকারও বসে নেই। পাল্টা অ্যকশনে দেখা যাচ্ছে শাসকপক্ষদের। বিডিনিউজ২৪.কম এর এক নিউজে দেখা যায়–

এ আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র নিউইয়র্কে প্রায় ৫ হাজার মানুষ টাইম স্কোয়ারে জড়ো হয়ে জানিয়েছে তাদের অভিযোগ আর দাবির কথা। এ সময় অন্তত ৭০জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রোমে বিক্ষোভরতদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে।


শ্রেণীবৈষম্যের বিরুদ্ধে কানাডার রাজপথে জনতা
শীর্ষক বাংলানিউজ২৪.কম এর প্রকাশিত সংবাদের কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করলে জানা যায়–

বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট দখলের জের এখন কানাডায়। এরই মধ্যে দেশটির বিভিন্ন শহর দখলে নেমেছে সাধারন জনতা। 'অকোপাই টরন্টো' বা টরন্টো দখল নামে অভিহিত এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণকারী কয়েক হাজার জনতা সকাল থেকেই জড়ো হতে থাকে কানাডার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র টরন্টোর বে স্ট্রিট এলাকায় এবং পরে তারা আশ্রয় নেয় নিকটস্থ জেমস পার্কে।

টরন্টো দখল তৎপরতায় অংশগ্রহণকারীরা ধনিক কর্পোরেটের আচরণ, ৯/১১ সংক্রান্ত সরকারি ভাষ্য এবং টরন্টোর বিতর্কিত উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকে। তাদের শোগানের মুখ্য বিষয় ছিল- 'আমরাই ৯৯ শতাংশ', ১ শতাংশ ধনিক শ্রেণী পৃথিবীর সম্পদ হরণ করে আমাদের প্রতিপন্ন করছে'।
………….একইভাবে শনিবারের এই 'শহর দখল' তৎপরতার প্রতিফলন ঘটেছে কানাডার বেশ কয়েকটি প্রধান শহরে। উলেখযোগ্য শহরগুলো হচ্ছে – ক্যালগেরি, মন্ট্রিয়ল, ভ্যাঙ্কুভার, হেলিফেক্স, ফ্রেডরিক্টন, মঙ্কটন, গুয়েল্ফ, উইন্ডসর, কিংস্টন, লন্ডন, নানাইমো, কোর্টনি, ডাঙ্কান, কেলোনা, কেম্পলুপস, নেলসন, লেথব্রিজ, রেজাইনা, উইনিপেগ এবং রাজধানী অটোয়ায়। তবে তাদের মাঝে 'টরন্টো দখল'ই ছিলো সবচেয়ে বড় ঘটনা।

শ্রেণীবৈষম্যের বিরুদ্ধে কানাডার রাজপথে জনতা

আপাতদৃষ্টিতে, বর্তমান বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এই শহর দখল অভিযানকে অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে জেগে ওঠা 'আরব বসন্ত' বা 'আরব ¯প্রীং'য়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে টরন্টোর সংগঠকরা তাদের এই কার্যক্রমকে 'জনতার আন্দোলন' নাম দিয়েছেন।

আরব বসন্ত, ওয়ালষ্ট্রীট ওয়াকুপাই, জনতার আন্দোলন, সাম্প্রতীক লন্ডনের সহিংসতা….এসবই মূলত কি সেই বৈষম্যের ছাইচাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই নয়?

৮০-২০ রুলের খড়গ কোপানলে উন্নত বিশ্বের চেয়ে উন্নয়নশীল ও অনুনন্ত দেশের বা তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের জীবনই বেশী পড়ে। কারন এসব দেশে দূর্নীতি কড়াল থাবা মেলে ব্যাপকভাবে প্রসারিত, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি খুব একটা ভালো পর্যায়ে প্রায়শই চোখে পড়ে না, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি । উন্নত বিশ্বের বৈষম্যের স্বীকার জনগণ যদি ৯৯% হয় তবে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বের অবস্থা আরও ভয়াবহ হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি?

তৃতীয়বিশ্বের উন্নয়শীল আমাদের বাংলাদেশের অথর্নীতিও বর্তমানে খুব নাজুক এবং অনেকদিন ধরেই এমনটা চলছে। আজকের দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের আজকের সংকটের মুখে অর্থনীতি শীর্ষক এক খবর থেকে এই অর্থনৈতিক মন্দার কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

একই সাথে বাংলাদেশের শেয়ার বাজারেও প্রচন্ড এক বিরূপতা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ডিএসইর সামনে 'আমরণ' অনশন কর্মসূচীও দিতে বাধ্য হচ্ছে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীগণ। তারাও ধীরে ধীরে ইউনাইটেড হতে শিখছে। গড়ে উঠেছ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ।

সারাবিশ্বে এখন মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। বৈষম্যের মাত্রা বাড়তে বাড়তে সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আরও ঠেকছে। হয়তো সারাবিশ্বের সেই ৮০ ভাগ (থিউরেটিক্যালী, বাস্তবে হয়তো আরও বেশী ) লোক ধীরে ধীরে একত্রিত হতে যাচ্ছে । তাদের আন্দোলন কি আসলেই বাকী ২০ ভাগ (থিউরেটিক্যালী, বাস্তবে হয়তো আরও কম) এর বিরুদ্ধে নাকি অন্য কিছু, না কি আন্দোলন সিস্টেমের বিরুদ্ধে?

এর পরিণতি কি বিশ্বের মাঝে নতুন কোন আলোড়নের সূচনা করবে? দেখা যাক , এখনও প্যারেটো নীতির সেই ৮০ ভাগের অধিকাংশ আমরা তো মূলত উত্তম দর্শকই বটে।