মিসরের নতুন নির্বাচিত সরকারঃ সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা।

মামুনুর রশীদ জাবি
Published : 27 June 2012, 03:55 AM
Updated : 27 June 2012, 03:55 AM

আরব বসন্তের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর এই প্রথম গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত নতুন সরকার পেল মিসরের জনগণ। আরব বসন্তের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে গণতন্ত্রের দাবীতে যে আন্দোলন হয় সেই আন্দোলনে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন মিসরের লৌহ মানব হিসেবে খ্যাত হোসনি মোবারক। হোসনি মোবারকের পতনের পর অন্তবর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সামরিক সুপ্রিম কাউন্সিল। সামরিক সুপ্রিম কাউন্সিলের অধীনে এ বছরের ২৪ ও ২৫ মে মিসরে প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি ২৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম ও ২৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়ে হোসনি মোবারক আমলের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক দ্বিতীয় হন। তবে দুজন প্রার্থীর কেউই ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৬ ও ১৭ জুন। এই নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির নেতা মোহাম্মদ মুরসি নিজের বিজয় দাবি করেন আবার অপর প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা আহমেদ শফিকও বিজয় দাবি করেন। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও কিছু কিছু ভোট কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ে ফলাফল প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন নির্বাচন কমিশন। ফলে মিসরের জনগণ সামরিক কাউন্সিলের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায় টের পেয়ে আবার তাহরির স্কয়ারে সমাবেত হতে থাকে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। এর পরই মোহাম্মদ মুরসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয় । এভাবে দীর্ঘ ৮৪ বছর পর মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরীয় জনগণের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় এবং মিশরের জনগণ পায় গণতন্ত্রের স্বাদ।
উল্লেখ্য যে, ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে হাসানুল বান্না ইখওয়ান – আল – মুসলিম বা মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্টা করেন। মিসরের ইসমাইলিয় নগরী ছিল তাদের প্রধান কেন্দ্র। হোসনি মোবারকের শাসন আমলে এ দলটি নিষিদ্ধ ছিল। মুসলিম ব্রাদারহুড কট্টর ইসলামপন্থী ও পাশ্চাত্যবিরোধী সংগঠন হিসেবে পরিচিত। ইসলামের বিধি নিষেধগুলো তারা কঠোরভাবে পালন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবে মোহাম্মদ মুরসি কিছুটা উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি ইসলাম আর গণতন্ত্রকে এক কাতারে দেখতে চান। যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি বিরাট অংশ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে সেক্ষেত্রে মুরসি মিসরকে ভবিষ্যতে কোন দিকে চালিত করবেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুরসির জয়কে আপাতদৃষ্টিতে মিসরের গণতান্ত্রিক যাত্রা বলে মনে হলেও আর্ন্তজাতিক বিশ্লেষকরা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে মুরসিকে সেনাবাহিনীর সাথে আপোষ-রফার পথ বেছে নিতে হবে। অর্থাৎ তিনি যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন মাথা নিচু করে থাকতে হবে। কেননা মিসরের সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ কিছুদিন আগে কতগুলো ডিক্রি জারি করেছেন। এসব ডিক্রিতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে। ডিক্রিতে বলা হয়েছে- সেনা বাজেট, সেনা নেতৃত্ব কিংবা যুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেননা। এমনকি খসড়া সংবিধান চূড়ান্ত করার আগে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের অনুমোদন নিতে হবে এবং তা তিন মাসের মধ্যে গণভোটে পাশ করাতে হবে। এমতাবস্থায় ধারনা করা হচ্ছে সেনা পরিষদ ও মুরসি মুখোমুখি অবস্থানে থাকবে নতুবা ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবে। এই ভাগাভাগিতে মুরসিকে অত্যন্ত দক্ষভাবে সেনাবাহিনীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। যেটা করতে পেরেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসপ তাইপ এরদোগান তার কারিশম্যাটিক বুদ্ধির মাধ্যমে।

কিন্তু মুরসি এক্ষেত্রে কতটা সফল হবেন সেটা নিয়ে অনেকটা সন্দেহ রয়েছে। কেননা সামরিক পরিষদের সাথে ব্রাদারহুডের সম্পর্ক খুব ভালো নয়। তার উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ব্রাদারহুডের নেতা মুরসিকে নিয়ে চাপা ভীতি কাজ করছে সামরিক পরিষদের নেতাদের মাঝে। কেননা এই সামরিক পরিষদের নেতারা সকলেই ছিল মোবারকের শাসনামলের। মোবারকের শাসনামলে ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীদের উপর অনেক নির্যাতন করা হয়েছে। তাই মুরসি ক্ষমতায় গেলে তাদের ওপর যাতে আইনের খড়গ চালাতে না পারেন সেজন্য তারা আগেই তার হাত পা বেঁধে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। হোসনি মোবারকের পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্টের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়ের প্রেক্ষিতে সামরিক পরিষদ পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়েছে, ভেঙ্গে দিয়েছে সাংবিধানিক পরিষদও। পার্লামেন্ট ও সাংবিধানিক পরিষদে ব্রাদারহুডের প্রাধান্য ছিল। পার্লামেন্ট ও সাংবিধানিক পরিষদ ভেঙ্গে যাওয়ায় আইন প্রণয়ন ও সংবিধান রচনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

সন্দেহ নেই নতুন প্রেসিডেন্ট মুরসিকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জন করা ও সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। দ্বিতীয়ত, আদালত কর্তৃক বাতিলকৃত পার্লামেন্টকে সচল করা অথবা নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তৃতীয়ত, নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ করা। চতুর্থত, ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিত করে দেশে স্থিতিশীলতা আনয়ণ করা। পঞ্চমত, দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে দেশটিতে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করা। ষষ্ঠ, ইসরাইলসহ পার্শ¦বর্তী বৈরী রাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ভারসাম্য বিধান করা। সপ্তম, দাতা দেশগুলোর আস্থা অর্জন করা এবং জনগণের জীবনমানের উন্নতি সাধন করা। অষ্টম, মোবারকের আমলে প্রশাসনে যে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বাহুল্য ছিল তা মূলোচ্ছেদ করা। নবম, যুব সমাজের জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মিসরে বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত করা।
মিসরে ইসলামপন্থী দল ব্রাদারহুডের শাখা ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি নির্বাচিত হওয়ায় মিসরের পররাষ্ট্রনীতি এখন কেমন হবে সেটা দেখার বিষয়। ইসরাইলের ব্যাপারে নতুন প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির কারণে সমগ্র আরব বিশ্বের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক ভালো নয়। ১৯৭৮ সালে মিশরের সাথে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও দু'দেশের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিলনা। মুরসি কট্টরপন্থী দল থেকে নির্বাচিত হওয়ায় এ সম্পর্ক আরো অবনতি হতে পারে। ব্রাদারহুডের নীতিনির্ধারকরা হামাসকে পুরোপুরি সমর্থন করে অথচ সেই হামাসকেই ইসরাইলিরা তাদের শত্রু বলে বিবেচনা করে। ইতিমধ্যে হামাসরা মিসরের প্রেসিডেন্ট ব্রাদারহুড থেকে নির্বাচিত হওয়ায় উল্লাস প্রকাশ করেছে। তাই ফিলিস্তিন প্রশ্নে ইসরাইলের সাথে মিসরের সম্পর্ক কেমন হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। আবার পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথেও ব্রাদারহুডের বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্রাদারহুডের আগ্রাসী নীতির ব্যাপারে পাশ্চাত্যরা সবসময়ই শংকিত থেকেছে। তাই পাশ্চাত্যের সমর্থন নিয়েই মোবারক সরকার তার শাসনামলে মিসরে ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে যখন সেই ব্রাদারহুডই ক্ষমতায় আসীন তখন পাশ্চাত্যরা মিসরের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেবে বা মিসরের ইসলামপন্থী সরকার পাশ্চাত্যদের সাথে তাদেরকে কিভাবে মানিয়ে নেবে সেটাও দেখার বিষয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ইসলামপন্থী দল নির্বাচিত হওয়ায় মিসরের সাথে ইরান, তুরস্ক, তিউনিসিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। সাথে সাথে ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্ডান, সিরিয়া ও লিবিয়ায় ব্রাদারহুডের প্রভাব বাড়তে থাকবে। অর্থ্যাৎ মিসরে ব্রাদারহুডের বিজয় সমগ্র অঞ্চলে তাদের প্রভাবকে আরও সংহত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই মুহুর্তে মুরসিকে মিসরে জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। মুরসি তার বক্তব্যে সেটি খুব গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। কেননা মিসর এখন একটি বিভক্ত সমাজ। একদিকে রয়েছে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা, অন্যদিকে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মোবারকের সমর্থকরা। তাই এই দুই চিন্তাধারার মানুষকে একত্রিত করে এক ও অভিন্ন মিসর গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে এবং মুরসিকে এক্ষেত্রে সুদৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে। অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে মিসরের জনগণ যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছে তা ধরে রাখতে হবে। আর কোন স্বৈরশাসক যেন গণতান্ত্রিক সরকারকে উচ্ছেদ করে তাদের অবস্থান সংহত না করতে পারে সেদিকে সরকার ও জনগণ উভয়কেই খেয়াল রাখতে হবে। মিশরের সামরিক পরিষদেরও উচিত হবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া। কেননা কোন স্বৈরশাসকই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পারেনি চিরজীবন। প্রত্যেক স্বৈরশাসকের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো, গাদ্দাফি, হোসনি মোবারকের পরিণতি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।