বাংলাদেশের রাজনীতি ও বামপন্থীদের অনগ্রসরতা

মামুনুর রশীদ জাবি
Published : 7 July 2012, 03:59 AM
Updated : 7 July 2012, 03:59 AM

দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পদ্ধতি ও শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মতাদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত রাজনৈতিক উদ্যোগ। সাধারণত এটি হলো কখনও কখনও চরম পন্থা অবলম্বনে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, আইনগত ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। বাম ভাবাদর্শিক রাজনৈতিক প্রবক্তার মধ্যে অন্যতম টমাস পেইন(১৭৩২-১৮০৯), ভলতেয়ার(১৬৪১-১৭৭৮), বেনথাম(১৭৪৮-১৮৩৪), কার্ল মার্কস(১৮১৮-১৮৮৩) প্রমুখ বিখ্যাত সব চিন্তাবিদগণ।

ভারতীয় উপমহাদেশে বাম রাজনীতি শুরু হয় বিশ শতকে বিশের দশকে। এম এন রায়ের (১৮৮৭-১৯৫৪) উদ্যোগে কিছু নির্বাসিত ভারতীয় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি(সি.পি.আই) গঠন করেন। চল্লিশের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।

বিশ ও ত্রিশের দশকে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর তরুণদের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী রুপ পরিগ্রহ করে এবং ব্রিটিশ নাগরিক ও পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এসব সন্ত্রাসবাদী সংঘর্ষে অনেক আটক হয় এবং অনেকে নিহত হয়। আটককৃতরা বন্দিদশায় কমিউনিস্ট পত্রপত্রিকা পাঠের সুযোগ লাভ করে এবং অনেকে কমিউনিস্ট দলে যোগদান করে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিও অধিকাংশ হিন্দু হওয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সরকারের দমনমুলক নীতির কারনে তারা সবায় ভারতে চলে যায়।

১৯৪৮ সালের ভারত বিভাগের পর বাস্তবতার পটভূমিতে পাকিস্তান পার্টিও একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠনের সীদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ। পাকিস্তানে এর কোন প্রভাব দেখা না গেলেও পূর্ব বাংলায় পার্টির দ্রুত বিকাশ ঘটে। ১৯৫০ সালে বাম রাজনৈতিকদের নিয়ে আব্দুল হামিদ খান ভাসানি ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ গঠন করেন। পার্টির কৃষকদের কৃষক ফ্রন্টের মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়। এদিকে ১৯৫১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে এক পর্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে পার্টির কর্মকান্ড স্থিমিত হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান নেতৃবৃন্দ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন দেয়। ১৯৫৪ সালে ৯২-ক ধারা জারি হলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়। ১৯৫৭ সালের দিকে পার্টির কর্মীরা আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় তাদেও কার্যক্রম অব্যহত রাখে। ১৯৬৬ সালে চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির ভেতরে অভ্যন্তরে মতানৈক্য দেখা দিলে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে ভাঙ্গন শুরু হয়। ফলে মণি সিংহের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী গ্রুপ এবং মোহাম্মদ তোহায়রি নেতৃতে¦ চীনপন্থী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৬ সালের '৬দফা আন্দোলনকে সমর্থন দেন। বাদে পুরো সময়টাই কৃষক সমিতি দমননীতির শিকার হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রূখে দাড়ানোর ইতিহাস অনেক রয়েছে। তবে নেতৃত্বের দুর্বলতার কারনে সংগঠনটি এসব বৈপ্লবিক চিন্তা চেতনার বাস্তব রুপ দিতে পারেন নাই।

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০ তম কংগ্রেসের মাধ্যমে ভারতীয় কমিউনিস্টদের একাংশ বিভক্ত হয়ে গেলে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতেও বিভক্তি দেখা যায়। দেবেন শিকদার , আবুল বাশার, আব্দূল মতিন, আলাউদ্দীন প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটি আলাদা দল গঠন করেন এবং আইয়ুব খানের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যত্থানে কমিউনিস্ট পার্টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরা(মস্কোপন্থীরা) ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থন দেন। এমনকি স্বক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মণি সিংহ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর পার্টির নতুন নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং পার্টির ইতিহাসে এই প্রথম প্রকাশ্যে নির্বিঘেœ দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ লাভ করে।

দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কত আশা কত উদ্দীপনা কিন্তু আসলে সেটার হিতে বিপরীত ঘটলো। পাকিস্তান আমলে ২৪ ধরে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার চরম পরিণতিতেই এসেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও রক্তের হলি খেলার ৯ মাস পর স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালে যে সংবিধান তৈরি হয়েছিল সেটা ছিল চমৎকার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংবিধান (দূর্বলতা, ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও)। কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত শ্রেনীর উদ্বৃত্ত দাপট ও সীমাহীন লুন্ঠনের কারণে গণতন্ত্র কখনোই রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এক ধরণের ফ্যাসীবাদী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ১৯৭৫ সালের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান এক ব্যক্তি ও এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন, যা বাকশাল নামে পরিচিত।

অবশ্য এ ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কয়েক মাসের মধ্যে নির্মম কিছু হত্যার মধ্যে দিয়ে এ ব্যবস্থার অবসান ঘটে। কিন্তু তারপর আবার অভ্যুদয় হলো সামরিক শাসনের দীর্ঘ পনের বছর। অর্থ্যাৎ 'মড়ার উপর খড়ার ঘাঁ' বলা যায়। যে বিপুল সম্ভাবনা ও বিশাল স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় তা এক চরম নৈরাশ্যকর পরিস্থিতিতে পরিণত হলো।

কত রক্ত, কত জীবন। কত মানুষের অপরীসীম ভারত্ব ও আত্মত্যাগ। আর সেই সঙ্গে স্বপ্ন, নতুন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কত রকমের স্বপ্ন। অনেক মানুষের স্বপ্ন সমাজতন্ত্রের, শোষণ মুক্তির । কিন্তু মানুষের বিবেককে বিপুল ভাবাবেগের দ্বারা তাড়িত হয়ে বাংলাদেশ বাস্তবে কোন পথে এগোচ্ছে সেটা দেখার সৌভাগ্য অনেকের হয়নি।

মহান সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে লাল সবুজের বাংলার অভ্যুদয় হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ বাম কমিউনিস্ট দল স্লোগান দিত ' শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধরো পূর্ববাংলা স্বাধীন কর'। এই জন্য মানসিক ও রাজনৈতিক প্রস্তুতি তাদের ছিল কিন্তু বাস্তবে ঘটলো তার উল্টোটা। কেননা কমিউনিস্টদের বড় অংশ অসম সাহসী যুদ্ধ করেছেন তবুও রাজনৈতিক নেতৃত্ব করেছিল আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ জনগণের আশা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে বিকল্প হিসেবে কমিউনিস্ট শক্তি দাঁড়াতে পারেনি।

স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে আওয়ামী নেতৃত্ব হারিয়ে কিছু তরুণ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করলো । এই দলটি ব্যাপকহারে তরুণদের মাঝে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। সেদিনকার জাসদ আর আজকের জাসদের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। জাসদ একটি র‌্যাডিকাল দল হিসেবে গড়ে উঠলেও দলের কোন সুবিন্যস্ত মতাদর্শ ছিল না। অনেক ত্যাগ তিতীক্ষার পরও পরবর্তীতে তাদের আদর্শগত অধঃপতন ঘটেছিল।

বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন ধারার কমিউনিস্ট দল থাকলেও তাদের মাঝে তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক দূর্বলতা এবং রাজনৈতিক বক্তব্য ও আচরণে কিছুটা পরিবর্তন সত্ত্বেও দুর্বলতা এখনো যথেষ্ট বিদ্যমান। প্রথমদিকে কমিউনিস্টদের এক অংশ আওয়ামী লীগের সাথে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি করেছে। আর অন্য একটি অংশ রুশ-ভারত বিরোধী তৎপরতায় ব্যস্ত ছিল। কমিউনিস্ট রাজনীতির শত দূর্বলতার মাঝেও কিছু সবলতাও ছিল।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে সরকারের চরম ব্যর্থতা, গণতন্ত্রের নামে বিশ্বাসহীনতা, সমাজতন্ত্রের নামে মিথ্যা পাঁয়তারা এবং সামরিক শাসনের পথ তৈরি করেছিল পুঁজিবাদের যৌক্তিকতা। জিয়াউর রহমানের স্বল্পকালীন শাসনকালে সামরিক শাসন স্বাভাবিক গণতন্ত্রের বিকাশে বাধা ছিল, বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন, আমলাতন্ত্রের অশুভ ছায়া এমনকি অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের ভড়ং বাদ দিয়ে পুঁজিবাদের আশ্রয় নেন।

বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এরশাদ পতনের পরিকল্পনা ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বাম শক্তি। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর বামশক্তি মনে হয় হারিয়ে গেছে। কেননা পরবর্তী দুই দশকে বাম শক্তির কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। তবে হতাশা নয় আশার কথা বলি, বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হুমকির মুখে। এই মুহূর্তে পুঁজিবাদী বিরোধী শক্তির ক্রমেই উত্থান শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে যে প্রধান দই বুর্জোয়া সরকার যে ব্যর্থ তার অহরহ প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। জনগণ এখন রাজনীতির জ্বরে অতিষ্ঠ কেবলমাত্র বিকল্প কোন রাজনীতিই পারে এই জ্বর সারিয়ে তুলতে। বিকল্প হিসেবে গণতান্ত্রিক বাম রাজনীতির যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেটা এমনি এমনি হয়ে যাবেনা। এর জন্য প্রয়োজন সর্বপ্রথম দেশপ্রেমিক জনগণের ঐক্য, গণতান্ত্রিক বাম শক্তির ঐক্য। প্রয়োজন বিকল্প সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির ঝান্ডা তুলে ধরা। তাহলেই সম্ভব সম্ভাবনাময়ীর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বাম শিবিরের আধিপত্য।