থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন ও বাঙালি সংস্কৃতির সংকট

মামুনুর রশীদ জাবি
Published : 28 Dec 2012, 06:47 PM
Updated : 28 Dec 2012, 06:47 PM

দেখতে দেখতে আমাদের জীবন স্রোত আরেকটি বর্ষে প্রবেশ করছে। জীবনের মহামূল্যবান আরেকটি বছর পেছনে ফেলে সমগ্র বিশ্ব বরণ করতে যাচ্ছে ইংরেজী বর্ষ -২০১৩। স্বাগত নববর্ষ ! মূলত সারাবিশ্বে বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন বার্ষিক ক্যালেন্ডার রয়েছে যা তাদের ইতিহাস ঐতিহ্যও ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন: মোঘল সম্রাট আকবর এ উপমহাদেশে চালু করেছিলেন ছয় ঋতুর প্রতিফলনসংবলিত বাংলা সন। বর্তমান বিশ্বে যতগুলো অব্দ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী দেশে চালু রয়েছে খ্রিষ্টাব্দ। ৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে দ্য উনিস উথের চালু করা এই অব্দ সারা বিশ্বে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত স্বীকৃত এবং গৃহিত। বিশ্বায়নের সুবাদে সারা বিশ্ব আজ এক সমীকরনে মিলিত হয়েছে । আন্তর্জাতিক কারণে এই ঢেউ বাঙালী সংস্কৃতিতেও মৃদু বাতাস বইছে। ইংরেজী বর্ষ জীবন চলার পথে অপরিহার্য হলেও সেটা উদযাপন বাঙালী সংস্কৃতিতে কতটা মূল্যবান এটা আমার জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন?

সংস্কৃতি বললে আমার হাতে আসে 'পিস্তল' এই কথাটি ছিল এডলফ হিটলারের বংশবদ সেনাপতি হ্যানস জোস্টের। সংস্কৃতি বলতে আমরা স্বাভাবিকভাবে বুঝি আজ অন্যরকম কিছু। যেটা আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির জন্য কতটা অপরিহার্য সেটা বিচার বিশ্লেষনের সময় হয়েছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুই দশক ধরে আমাদের দেশে এক উদ্ভট অনুষ্ঠান থার্টি ফাস্ট নাইট বা ইংরেজী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালিত হয়। অর্থাৎ রাত ১২ টার পর রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার চেচামেচি , পটকা ফোটানো, লেজার লাইট শো, অভিজাত এলাকার হোটেলগুলোতে মদসহ অন্যান্য পানীয় গ্রহণ করা হয়। এগুলো বাঙালী সংস্কৃতির জন্য কতটা ধারক ও বাহক সেটা আমরা একবারও চিন্তা করিনা। আমরা এই মাসেই ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ব মানচিত্রে মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছিলাম। সেই মানচিত্রের বুকে আশ্রয়ের ৪১ বছর পূর্তিতে আমরা আমাদের সেই বাংলা সংস্কৃতির মর্যাদা কতটুকু দিতে পেরেছি? অথচ এই থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপনের মাধ্যমে বাঙালীর যে নিজস্ব একটা সংস্কৃতি রয়েছে সেটা আজ আমরা ভুলতে বসেছি ।

বাঙালীর সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখ , পহেলা ফাল্গুন, নবান্ন উৎসব , চৈত্র সংক্রান্তি , পৌষ মেলা, জৈষ্ঠ্যের জামাই ষষ্টি , ভাদ্রমাসের পিঠা পার্বণ, ইত্যাদি। প্রাসঙ্গিক ভাবে বলতে হয় , বৈশাখ মাস হলো বাংলা নববর্ষের প্রথম বছর। এই মাস বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যর মাস, এই মাসে বাংলা সংস্কৃতির নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের সাথে বাঙালিরা পরিচিত হয় এবং সারাদেশে নতুন সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর রমনার বটমূলে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলা একাডেমী চত্ব্বর সরব হয় আবহমান বাংলার গানে ছন্দে ও সুরে। বিভাগীয় শহর গুলোতে, প্রতিটি জেলা, গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র বসে বৈশাখী মেলা। এসব মেলাতে বসে বাংলা কবিতার আসর , লোক সঙ্গীতের আসর এবং দেশী খেলাধূলার আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছাত্রীরা দেশীয় পশু পাখির নকশাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে রাজপথে বৈশাখী র‌্যালী করে যা বাংলা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ । তাছাড়া গ্রাম বাংলার কৃষক, মজুর, শ্রমিক ইত্যাদি সাজসজ্জা সম্বলিত গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে নতুন বউ প্রতীক সাজিয়ে এক বর্ণাঢ্য আয়োজন করে। পহেলা বৈশাখে ব্যাবসায়ীগণ তাদের পুরাতন দেনা পাওনার জন্য হালখাতা করে। চট্টগ্রামে এ উপলক্ষে কুস্তি বা বলী খেলার আয়োজন করা হয়। রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জে গম্ভীরা গানের আসর বসে। দিনাজপুরে নেকমদন মেলা অনুষ্ঠিত হয় , এই মেলায় বসে নকশী পিঠা , খিচুরি, পান্তাসহ ইলিশমাছ।

জৈষ্ঠ্যের জামাই ষষ্টিতে গ্রামের বধূরা তাদের শশুর বাড়িতে বিভিন্ন ফল নিয়ে যায়। আর জামাইকে এসব ফল-ফলাদি দিয়ে শশুর বাড়িতে বরণ করা হয়। পৌষ মাসে দেখা যায়, পিঠা মেলায় বিভিন্ন রকমের পিঠার সমারোহ যা বাঙালীর সংস্কৃতিকে প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করে তোলে।

পৃথিবীর প্রায় সব জাতি তাদের নববর্ষের প্রথম দিনটি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী পালন করে। জাতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যর সাথে এই বর্ষবরণ সমপৃক্ত। ইরান , গ্রীস, ইতালিসহ শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি অনুযায়ী বর্ষবরণকে স্বাগত জানানো হয়। শুধুমাত্র ইউরোপের কিছু দেশ আর আমেরিকা এই দিনটি কে জানুয়ারি মাসে 'নিউ ইয়ার্স ডে' হিসেবে পালন করে। নববর্ষ পালনের উদ্দেশ্য হল নতুন উৎসাহ , নতুন প্রেরণা, নতুন আশায় , নতুন স্বপ্নে জীবনকে শুরু করা যা নিজের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য, এবং পৃথিবীর জন্য বয়ে আনবে কল্যাণ।

বাঙালি সংস্কৃতি আর ইংরেজী সংস্কৃতির মধ্যে আমরা বিস্তর পার্থক্য দেখতে পায়। বাংলা সংস্কৃতি মানে বাংলাকে কিভাবে লালন করা যায়, কিভাবে এই সংস্কৃতিকে প্রত্যেকের জীবনের সাথে মিশিয়ে রাখা যায় সেটার চেতনা। আর ইংরেজী সংস্কৃতি অর্থাৎ থার্টি ফাস্ট নাইট যে উৎসবের মত করে উদযাপন করি , তার মানে অভিনব পদ্ধতিতে ইংরেজী বর্ষকে গ্রহন করি। নতুন সব আদিখ্যেতার মাধ্যমে থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপন আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিকে করে তুলেছে সংকটাপন্ন। কেননা এই রাতটি আমরা বাঙালীরা পালন করি বেহায়াপনা ও নগ্নতার মাধ্যমে। এর প্রমাণ গত দুই দশকে আমরা অনেক পেয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি উচ্চ বিদ্যাপিঠের ছাত্রদের দ্বারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নির্যাতিত হয়েছে। এছাড়াও দেশের শহরাঞ্চল সহ বিভিন্নস্থানে সংগঠিত ঘটনাগুলো পরদিন পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে। অথচ বাংলা নববর্ষকে একইভাবে উদযাপন ও বরন করার জন্য এতো নগ্নতা , বিশৃঙ্খলা সংগঠিত হয়না । আর থার্টি ফাস্ট নাইট আসলে সারাদেশে বেহায়াপনা , নগ্নতা ঠেকাতে প্রশাসনের তীক্ষ নজরদারি রাখা হয় অর্থাৎ এটা দ্বারা প্রশাসনের একপ্রকার হয়রানি করানোই বলা যায়। এই পর সংস্কৃতি চর্চায় বাঙালী শৃংখলার চেয়ে বেশী বিশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। তাই অকপটে বলা যায় বাঙালি সংস্কৃতি শান্তির প্রতীক। আর ইংরেজী আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক বা বিপরীতমুখী। বিশ্বায়নের ফলে আজ আমরা আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা হারিয়ে অন্য সংস্কৃতির পরচর্চায় লিপ্ত আছি। আমাদের কে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা- সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব নিতে হবে। কেননা বাঙালি সংস্কৃতি আজ ভয়াবহ ক্রান্তি কাল অতিক্রম করছে।

আমাদের বাঙালি চেতনা ও তাৎপর্য্য আমাদের গ্রাম বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্যপূর্ণ উৎসবের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। এবং সকলেই আশা করে এসকল সংস্কৃতি দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। শহর, গ্রাম, গঞ্জ থেকে মারামারি হানাহানি নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস নির্মূল হবে এবং সুখ শান্তি সমৃদ্ধিতে দেশ ভরপুর হয়ে উঠবে। বিশ্বকবির সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রুপসী বাংলা, কাজী নজরুলের বাংলাদেশে আমরা হব গর্বিত নাগরিক। এ চাওয়াতো সকলের প্রাণের চাওয়া। আমরা ফিরে যায় আমাদের শেকড়ে। আমরা আমাদের শেকড়কে হয়তো অবহেলা করতে পারি কিন্তু ভুলতে পারিনা। শেকড় আমাদের পূর্ব পুরুষ শেকড় আমাদের অস্তিত্ব। আর এ জন্যই জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, " হিন্দু মুসলিম যেমন সত্য তার চেয়ে অধিক সত্য আমরা বাঙালি। সুতরাং বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিকশিত করার দায়িত্ব আমাদের। পরসংস্কৃতি চর্চায় লিপ্ত না থেকে নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চায় লিপ্ত থেকে সংকট থেকে উত্তরণ ই আমাদের পদযাত্রাকে সাফল্যমণ্ডিত করবে।

সধসঁহযরংঃ৩৯@মসধরষ.পড়স
লেখক পরিচিতি
চতুর্থ বর্ষ, ইতিহাস বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মোবা. ০১৯৪০৩৫৬৭১১