মুক্তাগাছায় মন্দির

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 27 Sept 2014, 04:38 AM
Updated : 27 Sept 2014, 04:38 AM

মুক্তাগাছায় মন্দির। আগে যেখানে সকাল-সন্ধ্যা কাসার ঘন্টা, ঢাকের বাড়ি, করতালের ঝুনঝুন শব্দ শোনা যেত, এখন সেখানে শুধু চাম বাদুরের ডাক শোনা যায় । অযত্ন আর অবহেলায় প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ৮টি মন্দির। সোয়াশ"বছরের প্রাচীন পৌর শহরে ১৫টি মন্দির রয়েছে। বাষাটি ইউনিয়নের জগন্নাথবাড়িতে ১টি মন্দির। তন্মধ্যে ১৭শ" শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে ৭টি , বাকি ৯টি ১৮শ"এবং১৯শ" শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়। ১৭শ" শতাব্দীতে নির্মিত মন্দিরগুলো হচ্ছে জমিদার বাড়ির ভেতরের রাজেশ্বরী মন্দির, জমিদার বাড়ি সংলগ্ন ২টি শিব ও ৩টি শিবমন্দির (পাশাপাশি), লক্ষ্মীখোলার শিবমন্দির, কালিবাড়ির ১টি জোড়া শিবকালী মন্দির (পাশাপাশি) এবং জগন্নাথবাড়ি মন্দির। এই ৮টি মন্দিরের অবস্থা আজ বড়ই করুণ। ৪টি মন্দিরের যাবতীয় কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগেই। এগুলো বেদখল করে গৃহ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে । বাকি ৪টি মন্দির বিলুপ্ত হবার পথে । এককালে হিন্দু জমিদার শাসিত অঞ্চল ছিল মুক্তাগাছা । ১৭০৪ সালে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চোধুরী নবাব মুর্শিদকুলি খার অনুগ্রহ লাভ করে মুক্তাগাছায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং জমিদারি শাসন চালু করেন । নির্মাণ করেন বাসভবন ও মন্দির । শ্রীকৃষ্ণ ও তার পরবর্তী বংশধররা পর্যায়ক্রমে ভারত থেকে দক্ষ শ্রমিক এনে এ সমস্ত মন্দির তৈরি করেন বলে লোকমুখে শোনা যায়। ১৯৫৬ সালে সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল করলে জমিদারদের প্রায় সবাই ভারতে চলে যান । এরপর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত লুটপাট হয় মন্দিরের বিগ্রহ, দামি সরঞ্জামাদি এবং জমিদার বাড়ির মালামাল । ১টি মন্দির কিছুদিন আগ পর্যন্ত জমিদারদের শেষ বংশধর দেবাশীষ আচার্য দেখাশোনা করতেন । তার মৃত্যুর পর এটিও নীরব । বাকি ৪টি মন্দির পরিচালনা ও সংরক্ষণ করছেন স্থ্ানীয় হিন্দুরা। তন্মধ্যে কালীবাড়ির কালী শিব (পাশাপাশি দুটি) মন্দিরের অবস্থা বড়ই করুণ। মন্দির দুটির দেয়ালে এখনো প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের কারুকাজ ফুটে আছে। মন্দিরের চারদিকে আগে কারুকাজ মন্ডিত দেয়াল ছিল । জগন্নাথ বাড়ির মন্দিরটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে ।

যুগল শিব কালী মন্দির

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মহারানী বিমলা দেবীর স্মৃতি বিজড়িত স্বর্ণকুন্ডশোভিত কারুকার্যমন্ডিত আনন্দময়ী যুগল কালী ও শিবমন্দির আজ ধ্বংসের পথে। বিগত এক দশকে ঘটে যাওয়া কয়েক দফার ভূমিকম্পে পেছনের দিকে হেলে পড়েছে মন্দির দুটি । বড় বড় অংশ নিয়ে খসে পড়ছে মন্দিরের প্লাস্টার। এতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পূজা অর্চনা করছেন পূজারী ও ভক্তবৃন্দ । জানা যায়, ১৮২০ সালে মন্দির দু'টি স্থাপন করা হয়। একই মাপের মন্দির দুটির উচ্চতা প্রায় ১শ' ফুট । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মন্দিরের মূল্যবান মালামাল লুণ্ঠিত হয়ে যায়। ভাংচুর করা হয় বহু মূল্যবান পাথরের তৈরি বিগ্রহ। বর্তমানে জীর্ণশীর্ণ যুগল মন্দির বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। পেছনের দিকে হেলে পড়া মন্দির দু'টি থেকে খসে পড়ছে কারুকাজ ও খণ্ড-বিখণ্ড অংশ। সংস্কারের অভাবে বর্ষাকালে ভেতরে পানি পড়ে। এতে পূজায় বিঘ্ন ঘটে। অভিযোগে প্রকাশ, এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল মন্দিরের জমি-জমা ও পুকুর আত্মসাত্ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে ।

জানা যায়, জমিদার রঘুনন্দনের স্ত্রী মহারানী বিমলা দেবী যুগল এই মন্দির ছাড়াও ১৮১২ সালে নিজ জমিদারির অন্তর্গত ময়মনসিংহের ত্রিশালের বালিপাড়া গ্রামে প্রজাদের জলকষ্ট নিবারণের জন্য একটি বড় দীঘি এবং শ্বশুরের নামে রঘুনেশ্বর শিবমন্দির স্থাপন করেন । ১৮২০ সালে মুক্তাগাছায় নিজ নামে বিমলেশ্বর শিবমন্দির স্থাপন করেন। এগুলোও আজ ধ্বংসের পথে। এলাকাবাসী জানান, উপরোক্ত স্থাপনা সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হলে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হবে ।#

পাথরের শিব মন্দির
মুক্তাগাছায় পুরাকীর্তির ইট -সুরকির গাঁধুনির বহু স্থাপনা লক্ষ টুকরোয় ভেঙ্গে গেলেও টিকে আছে পাথরের তৈরি শিব মন্দির । মুক্তাগাছা শহরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের সামনে জমিদারদের স্থাপিত পাথরের মন্দিরটি পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে । জানা যায় , ভারতের পাটনার বাসিন্দা প্রখ্যাত স্থাপত্য শিল্পী ময়েজ উদ্দিন বাংলা ১২শ'৭০ সালে দেয়ালের নকশা , গম্বুজের লতাপাতা, খিলানের কাজ করে তৈরির মাধ্যমে গড়ে তুলেন দৃষ্টিনন্দন এই মন্দিরটি । মুক্তাগাছার রাজা জগৎ কিশোর আচার্য চৌধুরী মন্দির নির্মানার্থে ময়েজ উদ্দিনকে প্রচুর উপঢৌকন প্রদান করেন । সরকারের প্রতœতত্ব বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষন এলাকাবাসী জানান, যে কোন নির্মাণ শৈলিই যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণ করা না হলে শক্ত পাথড়ের ভিতও দুর্বল হয়ে পড়ে ।


জগন্নাথ বাড়ির শিব মন্দির।

মুক্তাগাছা উপজেলার বাঁশাটি ইউনিয়নের জগন্নাথবাড়িতে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন শিব মন্দিরটি অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসের পথে । জানা যায়, জগন্নাথ ছিলেন এই অঞ্চলের ক্ষমতাধর ভূস্বামী। তারই নামে এলাকাটির নামকরণ হয় জগন্নাথবাড়ি। জগন্নাথ স্থানীয় হিন্দু অধিবাসীদের ধর্ম কর্মে মনোযোগী হতে নির্মাণ করেন স্বর্ণকুন্ডশোভিত কারুকার্যমন্ডিত এই শিব মন্দির। ময়মনসিংহ-ফুলবাড়িয়া সড়কের পাশে নির্মিত মন্দিরটিতে আজ হয় না অর্চনা।

বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় ইট সুরকি খসে যাচ্ছে । মন্দিরটিকে বট পাকুড় গাছ আঁকড়ে ধরেছে। মন্দিরের ভেতর সাপ আর চামবাদুর বাসা বেঁধেছে । ক্রমশ এটি দেবে যাচ্ছে। স্থানীয় একজন প্রবীণ জানান, একসময় মন্দিরটি ঢাক ঢোল আর করতালের শব্দে মুখরিত থাকত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মন্দির প্রতিষ্ঠাতা জগন্নাথের বংশধররা ভারতে চলে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় মন্দিরের কার্যক্রম। মন্দিরটি সংরক্ষণের দাবী এলাকাবাসীর।