মুক্তাগাছার রাজবাড়ী

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 22 Oct 2014, 05:56 AM
Updated : 22 Oct 2014, 05:56 AM

জগৎ বিখ্যাত মুক্তাগাছার রাজবাড়ী । চলতি বছর সংস্কার হওয়ায় স্থানীয়রা বাড়ীটিকে আলোকসজ্জায় করেছেন আলোকিত । ঝলমলে আলোয় ফিরে এসেছে রাজবাড়ীর যৌবনের রূপ । পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা । রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র একশ' ত্রিশ কিলোমিটারের পথ মুক্তাগাছা । বৃটিশ আমলেরও আগে থেকে ইতিহাস পর্যালোচনায় বর্ণিত এবং লোককথায় আছে , মুক্তাগাছার পূর্বনাম বিনোদবাড়ী ছিল ঈশা খাঁর বাইশ পরগনান একটি পরগনা আলাপশাহীর অন্তর্গত । এ অঞ্চলে তিনটি পরগনা আলাপশাহী,হোসেন শাহী ও মোমেনশাহী। ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর এই পরগনার বন্দোবস্ত পান (১৭২৭ইং)শ্রী কৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী । এই শ্রীকৃষ্ণ কখনো মুক্তাগাছা আসেননি।১৭৭৯ইং সালে শ্রীকৃষ্ণ আচার্যের জেষ্ঠ পুত্র রাম রাম পিতার নামে জমিদারী বন্দোবস্ত এলাকা আলাপশাহী পরগনা ভ্রমনে আসেন । এক পর্যায়ে তিনি আয়মান নদী দিয়ে বিনোদবাড়ী গ্রামে উপস্থিত হন।গ্রামটি তার অত্যন্ত পছন্দ হয় । রামরাম যখন বিনোদবাড়ী আসেন তখন এটি ছিল কয়েকজন নিতান্ত গরীব লোকের অবস্থান ।নতুন ভূস্বামী উপস্থিত হলে তাকে দেখার জন্য সাধ্যমত উপহার উপঢৌকন নিয়ে গ্রামবাসীরা রামরামের কাছে উপস্থিত হন। নানা রকম উপহার সামগ্রীর মধ্যে মুক্তারাম নামক জনৈক কর্মকারের একটি গাছা 'পিলসুজ ' ছিল সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ও নির্মাণ শৈলিতে আকর্ষনীয় । রাম রাম প্রজাদের এই সংবর্ধনায় অত্যন্ত প্রীত হন এবং উক্ত প্রজাদের এই ঘটনাকে স্মৃতিবহ করে রাখার জন্য মুক্তারামের নামের এক অংশ মুক্তা এবং তার দেয়া গাছা একত্রে করে বিনোদবাড়ীর বদলে এই স্থানের নাম রাখেন মুক্তাগাছা ।
ইতিহাস : মুক্তাগাছা বলতে শুধু মন্ডা নয়। ষোলহিস্যা জমিদার দুর্দন্ড প্রতাপে মুক্তাগাছার জমিদারী পরিচালনা করেছেন। শিল্প-সাহিত্য,ক্রীড়া , সংস্কৃতি সেবায় মুক্তাগাছার রয়েছে বর্ণাঢ্য অতীত। আয়মান নদীর অনতিদূরে সারদা কিশোর রাস্তা ধরে হাটতে গেলে কখনো একশ হাতির মিছিল স্মৃতিতে প্রত্যক্ষ করেন প্রবীনজনেরা। রাজা জগৎ কিশোরের বাড়িতে কখনো কালের সাক্ষী নাট্য মন্দিরটিকে দেখতে পাওয়া যায় , যেখানে উদয় কুমার ,কাননবালা,নানু সাহাইয়া ,সরোদী আহম্মদ আলী খান, রাজপুরাতন বিখ্যাত নৃত্য শিল্পী মোহন প্রসাদ প্রমুখ বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন শিল্প ধ্যানে । ইতিহাসবিদ কেদার নাথ মজুমদার , কবি দিনেশ চরণ বসু, শ্রীশ চন্দ্র গুহ , শ্রী নাথ চন্দ্র, রুক্সিনী কান্ত ঠাকুর প্রমুখের সাথে মুক্তাগাছার যোগাযোগ ছিল নিবিড়। মহাশ্মশান খ্যাত কবি কায়কোবাদ মুক্তাগাছা পোষ্ট অফিসে চাকুরী কালীন সময়ে রচনা করেছিলেন অনেক কাব্যগ্রন্থ। বাংলা ১৩১৬ সালে গবেষক যোগেন্দ্র প্রসাদ দত্ত রচনা করেছিলেন জীবনীগ্রন্থ রাজা জগৎকিশোর।

অতীত : একসময় সব ছিল । হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। নাচঘর,পূজা মন্ডপ, পাইক পেয়াদা,বরকন্দাজ,লাঠিয়াল,প্রজা পীড়ন,প্রজাসেবাও। মুক্তাগাছার শিক্ষা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও পরিকল্পকও ছিলেন তারাই। মুক্তাগাছা আরকে হাই স্কুল, স্থাপিত ১৩০০বাংলা, নগেন্দ্র নারায়ন গার্লস হাই স্কুল (১৯০৭), আনন্দ মোহন কলেজ ময়মনসিংহ,যাদপপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা,মহাকালী পাঠশালা,বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুল ময়মনসিংহ, শান্তি নিকেতন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে তারা উল্লেখযোগ্য অংকের অর্থ সাহায্য করেছেন। ভূপেন্দ্র রঙ্গপিঠে সারা বছর ধরে নাটক মঞ্চস্থ হতো। বিসর্জন, ব্যপিকা বিদায়, রামের সুমতি, মানময়ী গার্লস স্কুল,সীতা,রমা,বিজয়া,কাশীনাথ,কারাগার,মীরকাশিম,চাঁদ সওদাগর আরও অনেক নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয়েছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গত বিদ্যাপীঠ মুক্তাগাছা এবং রাজা জগৎ কিশোর আচার্য চৌধুরী ছিলেন তার সঙ্গীত পিতা। স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস ভাওয়াল থেকে বিতাড়িত হলেও মুক্তাগাছা তাকে ঠাঁই দিতে কুন্ঠিত হয়নি।দশ হাজারেরও বেশী বইয়ে সমৃদ্ধ জীতেন্দ্র কিশোর লাইব্রেরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সেরা লাইব্রেরী ছিল,বিন্যাস,পরিচালনা ও সংগ্রহ গুরুত্বে। ১৯৬৫ সাল থেকে সেটি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন ও পরে বাংলা একাডেমি জীতেন্দ্র কিশোর সেল নামে সংরক্ষণ করছে।ত্রয়োদশী সন্মেলন ছিল মুক্তাগাছার প্রচীন সাহিত্য গোষ্ঠী। গোষ্ঠির পক্ষে ত্রয়োদশী নামে পত্রিকা বের করতেন কৃষ্ণ দাস , তাতে থাকতো রবীন্দ্র নাথের আশির্বাদ বাণী। মূলত এ সমিতির প্রচন্ড আগ্রহেই রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহ সফরে আসেন আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে (বর্তমানে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ)। বাংলা পত্রিকা প্রকাশের প্রয় সেই প্রথমিক সময়ে ১৮৭৫ সালে মুক্তাগাছা থেকে সুহৃদ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হত। বাংলা১২২৮ সালে ১ বৈশাখ পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। নির্মাল্য,ভাষ্কর প্রভৃতি পত্রিকাও সে সময়ে মুক্তাগাছার গৌরবের বিষয় ছিল। ফুটবল,ব্যাডমিন্টন,ক্রিকেট এমনকি মুক্তাগাছার আঞ্চলিক খেলা হুমগুটি খুব জাকজমকের সাথেই পালিত হত। সূযৃকান্ত শীল্ড ফুটবল, মহারাজা শীল্ড ফুটবল ছাড়াও প্রচলন করা হয়েছে লীলা দেবী শীল্ড ফুটবল। মুক্তাগাছার স্বনাম ধন্য জমিদার শশীকান্ত আচার্যের স্ত্রী শ্রীমতী লীলা দেবী ১০৪ ভড়ি রুপা দিয়ে শীল্ড রৈরি করিয়েছিলেন।১৯১৪সালে মুক্তাগাছায় প্রথম শুরু হওয়া এই প্রতিযোগীতা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া কোমলমতি শিশুদের জন্য উদ্দীপনা মূলক এই শীল্ডের খেলাটি পরিচালিত হয় এখনও।

ক্লান্ত সুর : মুক্তাগাছার সেই সব দিন আজ আর নেই। নাচঘর,পূজা মন্ডপ,গানের জলসায় আজ আর আলো জলে না । মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ী (আটানি বাড়ির ) সামনে দিয়ে রাতে হেটে গেলে গা ছমছম করে । যখন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বপ্নের মত ছিল , সেই সময়ও ডায়নামা চালিয়ে বিদ্যুৎ বানিয়ে জালানো হতো। রঙিন শার্সি আর ঘুঙুরের বোলে দোল খেতো নানা রঙের বিজলী।
জমিদারদের বাড়ীগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছিল । ইট পাথর কড়ি বর্গা দিন দিন লোপাট হচ্ছিলো ।শহীদ স্মৃতি সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠার কারণে মহারাজার বাড়িটি রক্ষা পেলেও তার উত্তর পাশেই জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরীর বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে ছিলো । এ বিশাল বাড়িটি দৃষ্টি নন্দন নির্শাণ শৈলীসহ তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল । গত এক বছরে রাজবাড়ীর চেহারা বদলে গেছে । বর্তমান সরকার রাজবাড়ীটি সংস্কার কাজ শুরু করে । ৭০ ভাগ কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে । এখন রাতের আলোয় আলোকিত রাজবাড়ী । পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। পুরনো শ্যাওলা , বট পাকুড়ের শিকর বাকড়,ঝোপ-জঙ্গল পরিস্কার করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মীরা। বিষ্ণু সাগর নামে মুক্তাগাছা শহরের মধ্যে আছে বিশাল এক জলজ নিসর্গ। এই বিষ্ণু সাগরের চারিদিকে মুক্তাগাছা নগরের গোড়া পত্তন করেছিলেন সামন্ত প্রভুরা । সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এটিও হতে পারে মুক্তাগাছার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। দরিচার আনি বাজারের পাশে কালবাড়ির ঐতিহ্যবাহী পুকুরটিও মজে যেতে বসেছে।এই পুকুরের উত্তর পাশে সুশীলা দেবীর(বিমলা)জোড় মন্দির।দু"শ বছর আগে অপরুপ কারুকাজে এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল।মন্দিরের বেদী থেকে পুকুরের ঘাট পর্যন্ত সংযোগ চাতালটিকে সবসময় উৎসবের আমেজ লেগে থাকতো।মুক্তাগাছায় বসবাসরত জমিদারদের শেষ প্রতিনিধি দেবাশীষ আচার্য চৌধুরী পরিবারসহ তিন কন্যা স্ত্রীসহ বসবাস করতেন । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের মূলবাড়ির (বর্তমানে২য় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প)সব খোয়া গেছে , পুড়ে গেছে, লুট হয়েছে। সাত ঘাটের পুকুর পাড়ে বাংলো বাড়ির মতো নান্দনিক যে বাড়ি ছিল আজ আর কিছু নেই। জলটং এর পাশে শামুক চাপা, কালো বকুল আর নাগ লিঙ্গম গাছ । জমিদার প্রথা উচ্ছেদের পর তাদের সবাই ভারতে চলে যান । রয়ে গেছে মুক্তাগাছার জমিদারদের রাজবাড়ী।