ময়মনসিংহে গারো

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 8 Nov 2014, 02:40 PM
Updated : 8 Nov 2014, 02:40 PM

ময়মনসিংহে গারো । বৃহত্তর ময়মনসিংহের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা , টাঙ্গাইল ও শেরপুর জেলা সদর ও জেলার উপজেলার বনাঞ্চলে আদিবাসী গারোদের বসবাস। ওয়ার্ল্ড ভিশন, কারিতাস ও বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার কল্যাণে গারোরা এখন উচ্চ শিক্ষা নেবার সুযোগ পাচ্ছে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এখন তাদের পদচারনা । ভাল চাকরিও করছে তারা। এর পরও রয়েছে তাদের অভাব- অনটন। তাদের জীবন-যাত্রার মান বা অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়নি । তাদের জায়গা জমি নিয়ে নানান ঝামেলা । ময়মনসিংহে আদিবাসীদের নিয়ে প্রতি বছর সভা সমাবেশ হয়। তাদের সমস্যা সরকারের নিকট তুরে ধরেন। কিন্তু এর সমাধান হচ্ছে না বলে গারো আদিবাসীরা অভিযোগ করেন। জানা গেছে এমন অনেক আদিবাসী আছে,যারা বংশ পরম্পরায় এলাকায় বসবাস করে আসছেন। কিন্তু তাদের জমির দলিলপত্র নেই। আর এতেই হয়েছে যত ঝামেলা । এদের উচ্ছেদের জন্য কিছু সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি উঠে পড়ে লেগেছে। আদিবাসীদের মধ্যে অনেকে এখন ধারণা আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর কারণে বর্তমান আধুনিক জীবনের সাথে তাল মেলানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তারা এখন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়তে চায় ।

আদিবাসীদের অনেক ভূ-সম্পত্তি ইতিমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। তাদের ক্ষোভ ভূ-সম্পত্তি বেহাত হওয়ার অন্যতম কারণ পক্ষপাতমূলক মাতৃতান্ত্রিক সম্পত্তি প্রথা। এই প্রথার বিরুদ্ধে এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে আদালতে আদিবাসীরা মামলা করেছিল । সেই মামলায় যে রায় দিয়েছিল তা হলো, নিজের পরিশ্রমের দ্বারা উপার্জিত সম্পত্তির উপর গারো পুরুষদের অধিকার আছে । এক সময় গারোদের মধ্যে অবাধ যৌন সম্পর্ক এবং যুথ বিবাহ প্রচলিত ছিল । এছাড়া বহিরাক্রমণ এবং বন্য জীব-জন্তুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য নারী –পুরুষরা এক সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত করতো ।যুদ্ধকালীন সময়ে সন্তান ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব থাকতো বাড়ির বয়োজেষ্ঠ মহিলার উপর। আর এ থেকেই গারো সমাজে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। নারী পরম্পরায় গারোদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারিত হতে থাকে । সম্পত্তি শুধু মেয়েদের , পুরুষদের উত্তরাধিকার বলতে কিছুই নেই। তবে পরিবারের সকল কণ্যা সম্পত্তির অংশীদার হয় না । গৃহকর্তী বা তার মাচং (নিজ গোষ্ঠী) কর্তৃক নির্বাচিত একজন কণ্যাই সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে থাকেন। এ নির্বাচিতা কণ্যাকে গারো ভাষায় নকনা বলা হয়।

সাধারণতঃ পরিবারের কণিষ্ঠ কণ্যাকেই নকনা নির্বাচিত করা হয়। নকনার জন্য পিতার আপন ভাগ্নেকে জামাই হিসেবে আনা হয়। এই জামাইকে গারো ভাষায় নকরম বলা হয়। যদি পিতার ভাগ্নে না থাকে তবে পিতার মাচং থেকে অন্য কোন ছেলেকে এনে নকরম বানানো হয়। গারো সমাজের প্রচলিত প্রথা হচ্ছে , গৃহ কর্তা বা গৃহকর্তীর মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তি নকমা ও নকরমের অধিকারে চলে আসে। কিন্তু নকরমের শ্বাশুড়ী জীবিতাবস্থায় যদি শ্বশুর মারা যান তাহলে এই সম্পত্তি রক্ষার জন্য নকরমকে তার নিজ শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করতে হয়। এক্ষেত্রে নকনা জিরগিতি বা দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিগণিত হয় এবং নকমার মাই সংসারের কর্তী হিসেবে বা প্রধান স্ত্রীর ভূমিকা পালন করে থাকে । এখন গারো সমাজে শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে এই প্রথাটিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই আইন এখন গারো সমাজে প্রচলিত নেই । কালের আবর্তে গারোরা এখন তাদের গড়া আইন কিছুটা হলেও ভাঙ্গতে শুরু করেছে। শিক্ষা লাভের সাথে সাথে তারা পুরনো ঐতিহ্য পরিহার করতে শিখেছেন । এক সময় গারো বিবাহ গারোদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো কিন্তু এখন আর তা নেই । এখন তারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলছেন । বাঙ্গালীদের সাথেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন । অনেকে গারো নিজস্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রিষ্ট ধর্মে দিক্ষিত হচ্ছেন।