মুক্তাগাছায় হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত ১২ ছাত্রী: নববর্ষের আনন্দ ম্লান

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 13 April 2015, 06:41 PM
Updated : 13 April 2015, 06:41 PM

ছবি ক্যাপশনঃ মুক্তাগাছা (ময়মনসিংহ) : উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হিস্টিরিয়া আক্রান্ত ছাত্রী

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত ল্যাংড়া বাজার আলিম মাদ্রাসার ১২ জন ছাত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে । এতে তাদের নতুন বছরের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে । আজ সোমবার সকালে মাদ্রাসায় অবস্থানকালে তারা এরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন । আত্রান্তরা ৬ষ্ঠ ও ১০ শ্রেনীর ছাত্রী ।
মুক্তাগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত নার্স নুরুন্নাহার ও সেলিনা বেগম জানান, আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি সুমাইয়া (১৮), জেসমিন(১৪), সখিনা(১৩), রুমা(১৫), ইয়াসমিন (১৩),রেবেকা (১৫), শারমিন (১৩), তাসলিমা (১৩), আকলিমা (১৩), আকলিমা(১৪), রোখসানা (১৪) ও মিতুকে (১৫) চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে ।
আক্রান্তরা ২ ঘন্টা অন্তর অন্তর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন । সুস্থ হয়ে আবোল তাবোল বকছেন । আত্রান্তরা জানান , তাদের মাথাব্যাথা , গলাব্যাথা , বুক ব্যাথা করছে এবং প্রচন্ড ভয় লাগছে ।আক্রান্ত সবাই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি আছেন । মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নুরুল আমীন জানান, এর আগে বৃহস্পতিবার ৬ জন ছাত্রী এ রোগে অসুস্থ হয়ে পড়লে, প্রাথমিক চিকিৎসায় আরোগ্য হয়ে উঠেন ।

মুক্তাগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ জানান, হিস্টিরিয়া এটি একটি মানসিক রোগ । হলিফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ এর শিক্ষক ডা. ফারজানা চৌধুরী সূত্রে জানা যায়, হিস্টিরিয়া একটি মানসিক রোগ। অথচ আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে বা শহরে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কুসংস্কার, অপবিশ্বাস, অন্ধকারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা এ অসুখের সঠিক চিকিৎসা করায় না। তারা ঝাড়ফুঁক করায়। এ ধরনের অপচিকিৎসা করার ফলে সময়ের বিলম্ব হয় এবং রোগী আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। অপর দিকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে বিজ্ঞানসম্মত সুচিকিৎসার মাধ্যমে রোগী আবার সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে।

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন হিস্টিরিয়া বা মূর্ছা রোগের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা। ওষুধের পাশাপাশি নিØোক্ত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করেন চিকিৎসক। হিস্টিরিয়ার চিকিৎসাব্যবস্থাপনার একটি মূল অংশ হলো হিস্টিরিক্যাল নানা ধরনের উপসর্গ সম্পর্কে রোগীকে বারবার সাহস, আশ্বস্তকরণ ও সাজেশন বা পরামর্শ এবং অভিভাব্যতা ইত্যাদি দিয়ে উপসর্গগুলো দূর করা। রোগীর সাথে খোলামেলা আলাপ করে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, মানসিক কারণ থেকে দৃষ্ট এ রোগ শারীরিক কারণ থেকে নয়। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা সাইকোথেরাপির মাধ্যমে রোগীর সাথে কথা বলে তার মনের সঙ্ঘাত জেনে এবং তা দূর করার জন্য চেষ্টা করেন। পরে রোগী যাতে ওইজাতীয় সমস্যার মোকাবেলা সহজেই করতে পারে তার ব্যবস্থা করেন।

এব্রিয়েকশন বা ড্রাগ ইন্ডউজড হিপনোসিস (সম্মোহন)। এটি একটি মেডিক্যাল টার্ম। এই বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর মনের নির্জ্ঞান বা অচেতন স্তরে যেসব মানসিক সঙ্ঘাত বা দ্বন্দ্ব রয়েছে সেগুলো বেরিয়ে আসে। একটি বিশেষ ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীকে একধরনের তন্দ্রাচ্ছন্ন বা ঘুমিয়ে যায় এ রকম অবস্থায় নিয়ে যান। এ অবস্থায় মনের যে মানসবৃত্তি বিরাজ করে তাতে করে তার মনের অচেতন স্তরে দ্বন্দ্বগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এব্রিয়েকশন চলাকালীন মনোচিকিৎসক রোগীকে যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন রোগী সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় এগুলো রোগীর সচেতন মনে বিরাজ করে না। তাই সচেতনভাবে রোগী এগুলো ডাক্তারের কাছে প্রকাশ করতে পারে না। এই পদ্ধতির মাধ্যমে রোগী তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত বা আবেগগুলো প্রকাশ করে মনের ভার লাঘব করতে পারে।

মনোচিকিৎসক রোগীর রোগের উপসর্গ ও লক্ষণগুলো কী জন্য হচ্ছে তার ওপর ফোকাস করে চিকিৎসা চালিয়ে যান এবং স্বাভাবিক আচরণ করার জন্য রোগীকে বারবার সাহস জোগানো হয়। রোগিণী যদি বিবাহিতা হয়ে থাকে তবে অবশ্যই স্বামীকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দরকার হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ফ্যামিলি কাউন্সিলিং এবং পরে স্বামী-স্ত্রীর জন্য কাপল থেরাপির (দাম্পত্যজনিত একধরনের মনোচিকিৎসা) দরকার হতে পারে।

তাহলে বোঝা গেল যে, হিস্টিরিয়া একটি মানসিক রোগ এবং এর অত্যাধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা রয়েছে যা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা প্রয়োগ করে রোগীকে সুস্থ করে তোলেন। তাই হিস্টিরিয়া রোগকে পরীর আসর বা জিনের আসর প্রভৃতি ভ্রান্ত ধারণা এবং কুসংস্কার ত্যাগ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক চিকিৎসা নিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তোলা জরুরি।