ময়মনসিংহে পদদলিত মৃত্যু – আইনশৃংখলা বাহিনীর অংশগ্রহণ চাই

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 10 July 2015, 02:02 PM
Updated : 10 July 2015, 02:02 PM

ময়মনসিংহে পদদলিত নিহত : হোক শেষ মৃত্যু । আমাদের দেশে পদদলিত মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয় । প্রায় প্রতিবছরই জাকাতে পদদলিত মৃত্যুর ঘটনা আমাদের মর্মাহত করে ।ঘটনায় জাকাতদানকারীসহ ৮ জনকে আটক করা হয়েছে । গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি । শুধু জাকাতেই নয় । চলতি বছর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় সনাতন সম্প্রদায়ের পুণ্যস্থান লাঙ্গলবন্দে মহাঅষ্টমীর পুণ্যস্নানের সময় পদদলিত হয়ে সাত নারীসহ ১০ জন পুণ্যার্থী মারা গেলেন ।এঘটনাতেও তদন্ত কমিটি হয়েছে । অনাকাঙ্খিত এ সমস্ত ঘটনা আমরা চাই না । আমরা চাই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক ।

ময়মনসিংহে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়,একটি জর্দা কারখানা থেকে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে আজ শুক্রবার পদপৃষ্ট হয়ে ২৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানাগেছে। এ ঘটনায় আহত অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় কোতুয়ালী মডেল থানা পুলিশ কারখানা মালিকসহ আট কর্মচারীকে আটক করেছে। নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশ সদর দফতর থেকে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলামকে এ কমিটির প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে হয়েছে।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, এপিবিএনের কমান্ডেন্ট মোস্তফা কামাল এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডি অ্যান্ড পিএস বিভাগের এএসপি আফজাল হোসেন। কমিটিকে আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার এএসপি আব্দুর রহিম।

শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে শহরের নূরানী জর্দা কারখানায় এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। যাদের মরদেহ মর্গে রাখা হয়েছে, পদপদলিত হয়ে নিহতরা হলেন- হালিমা বেগম (৪৫) স্বামী হায়দর আলী আকুয়া, নাজমা বেগম (৫০) স্বামী জালাল উদ্দিন, আকুয়া মোড়লপাড়া, ফাতেমা(৬০) স্বামী আঃ ছালাম আকুয়া মোড়লপাড়া, জোহরা খাতুন(৫৫) স্বামী ইসমাইল, সাং আকুয়া মোড়লপাড়া, রেজিয়া আক্তার (৪০) স্বামী আঃ মজিদ, সাং গাঠগোলা বাজার, ফাতেমা বেগম (৪২) স্বামী রবি হোসেন, আকুয়া দক্ষিণ পাড়া, সুফিয়া বেগম (৬০) স্বামী লাল মিয়া সাং চর ঈশ্বরদিয়া, খোদেজা বেগম(৫৫), স্বামী আঃ সালেক থানাঘাট বালুর চর, সিদ্দিক (১২) পিতা সিরাজুল ইসলাম থানাঘাট বালুর চর, লামিয়া (৫) পিতা কৃষ্ণা মিয়া থানাঘাট বালুর চর, সখিনা (৪০) স্বামী কৃষ্ণা মিয়া, থানাঘাট বালুর চর, সামু বেগম (৬০), স্বামী আব্দুল বারেক, থানাঘাট বালুর চর, ফজিলা বেগম (৭৫) স্বামী মাহতাব উদ্দিন কাচারী ঘাট, হাজেরা বেগম (৭০) স্বামী লালু মিয়া, পাটগুদাম বিহারী ক্যাম্প, রুবিয়া আক্তার (১২) পিতা- রতন মিয়া, ঢোলাদিয়া, রহিমা বেগম (৫৫) স্বামী শামসুল হক, আকুয়া দরগা পাড়া, আঙ্গুরী বেগম (৩৫) স্বামী শফিকুল ইসলাম, কালিবাড়ি গোদারাঘাট, সাহারন বেগম (৪০) স্বামী আরজু মিয়া সাং- বালিপাড়া, ত্রিশাল, মেঘনা বসাক(৪০), বসাক পট্রি, রুপালী (৪০) অতুলচক্রবর্তী রোড, সুধারণী সরকার ( ৫৫) ধোপাখোলা ময়মনসিংহ শহর। এ ছাড়াও অজ্ঞাত আরো ১ জন মহিলা। তাদের মধ্যে শহরের থানা ঘাটে ব্রহ্মপূত্র নদের সাথে বাস্তহারা ক্যাম্পের একই পরিবারের শামিমা বেগম (৬০), তার মেয়ে সখিনা(৩৫) ও নাতি লামিয়া (৬)। বাকি নাম- ঠিকানা তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। মৃতের সংখ্যা বৃদ্বি পাচ্ছে।

থানা পুলিশ ও পোস্টমের্টেমের ভয়ে পদপদলিত মৃত্যুর পর নিহতদের লাশ ঘটনাস্থল থেকে এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গেইট থেকেই ময়না তদন্ত ছাড়াই তাদের স্বজনরা বাড়িতে নিয়ে গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।

এ ঘটনায় ২০ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে হেনা (৫৪) ময়না (৭০) ও রাসেলসহ (২৫) ৩জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। স্থানীয় সূত্র জানায়, নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক মো. শামীম প্রতি বছরই জাকাত দেন। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সেহরির পর পরই জাকাতের কাপড় বিতরণের উদ্দেশ্যে জর্দা কারখানার গেট খোলা হয়। এ সময় কয়েক হাজার নারী-পুরুষ এক সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে গেটের ভেতর ঢুকতে চাইলে শতাধিক মানুষ পদপৃষ্ট হন। এতে ৩০ জন নিহত ও আরো অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ আহত হন। নিহতদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। এদিকে, নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের কান্নায় ভারি হচ্ছে পরিবেশ।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর জর্দা কারখানার মালিক মো. শামীমসহ তার আট কর্মচারীকে আটক করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। হাসপাতাল মর্গ থেকে পুলিশ ১৫ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে। মালিক শামীম সহ আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।

এলাকাবাসী জানায়, ময়মনসিংহে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে শিশু কিশোর ও নারীসহ ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৫০জন। আহতদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের অবস্থা আশংকাজনক। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। আহত অন্য ব্যক্তিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে যে যার মতো বাড়ি চলে গেছে। শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী রোডের নূরানী জর্দা কারখানায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩ কার্যদিবসে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের পুলিশ অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে পিবিআই এর পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল ও সিকিউরিটি সেলের একজন পুলিশ সুপারকে সদস্য করে ৩ সদ্য বিশিস্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়াও ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু আহমেদ আল মামুন কে প্রধান করে পুলিশ ৩ সদস্য বিশিষ্ট অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মইনূল হক জানান, শুক্রবার ভোরে নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম তালুকদারের নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদপদলিত হয়ে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত অর্ধ শতাধিক লোক। লোকজনের তুলনায় জায়গা কম হওয়ায় এ ধরনের দূর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হচ্ছে। তার পরও ঘটনার তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঘটনার পর পরই পুলিশ নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিকসহ ৮জনকে আটক করেছে। আটককৃতরা হলেন, মালিক মোহাম্মদ শামীম (৬৫) ও তার পূত্র হেদায়েত তালুকদার (৩০), ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ইকবাল হোসেন (৩৫), ইকবাল (৪০), আরমান হোসেন (৩৫), আলমগীর হোসেন (৩৪), আরশাদুল ইসলাম (৩২), ড্রাইভার পারভেজ (৩৫) ও কর্মচারী আঃ হামিদ (৩৬)। কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম জানান, নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে পদদলিত মৃত এ পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরে রাখা হয়েছে। ময়না তদন্ত শেষে মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।
এ ঘটনার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী, পুলিশ সুপার মইনুল হক দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী জানান, সঠিক পরিচয় নির্ণয়ের পর প্রত্যেক মৃত ব্যক্তি ও আহতদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথা সম্ভব আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হবে।

গ্রেফতারকৃত জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম জানান, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ৬০০জনকে জাকাতের কাপড় দেয়ার জন্য কার্ড প্রদান করা হয়ে ছিল। তিনি এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা দুঃখ প্রকাশ করে জানান , এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।

প্রত্যক্ষদর্শী থানাঘাট এলাকার কৃষ্ণা মিয়ার ছেলে ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্র শরিয়তুল সুপ্ত জানায়, সে তার নানী, মা ও বোন নিয়ে ভোর চারটার দিকে জাকাতের কাপড়ের জন্য নুরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে যায়। এ সময় অনেক লোক ফ্যাক্টরি গেইটের সামনে ভীড় করছিল। ফ্যাক্টরি গেইটটি ছিল হালকা ও দুর্বল। ভিতর থেকে বাশঁ দিয়ে ঠেকা দিয়ে রাখছিল। জাকাত প্রত্যাশীরা গেইট খোলার জন্য ধাক্কা দিলে ফ্যাক্টরির লোকজন গেইট খুলেনি।

এমতাবস্থায় শতশত মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে গেইট ভেঙ্গে যায়। এপর হুড়াহুড়ি করে ফ্যাক্টরিতে প্রবেশের সময় পায়ের নীচে চাপা পরে অনেক লোক মারা যায়। সে কোন মতে বেঁচে গিয়ে ফ্যাক্টরি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তার মা, নানী ও বোনকে খুঁজতে থাকে। খোঁজাখোঁজির পর তার নানী, মা ও বোনের লাশ দেখতে পায়। প্রত্যক্ষদশীরা জানান, ভোরে গেইট খোলার সাথে সাথে শতশত জাকাত প্রত্যাশীরা হুমকি খেয়ে পড়ে পদদলিত হয়ে মারা যান।

আমরা চাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জাকাতের কাপড় বিতরণ করা হোক । শুধু ময়মনসিংহে নয়, সারাদেশে যে সমস্ত স্থানে জাকাতগ্রহণকারিদের ঘন উপস্থিতি সেখানে চাই আইনশৃংখলা বাহিনীর অংশগ্রহন । তবেই রোধকরা সম্ভব পদদলিত হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ।