ময়মনসিংহে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 11 July 2015, 09:35 AM
Updated : 11 July 2015, 09:35 AM


ময়মনসিংহে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন । নারী ও শিশু সবার আগে, বিপদে-দুর্যোগে প্রাধান্য পাবে। সর্বজনীন প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য পরিবার পরিকল্পনা'। এই প্রতিপাদ্য স্লোগানে সমগ্র বিশ্বে এবং সারাবাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস । আজ আজ ১১ জুলাই, বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ময়মনসিংহে আজ শনিবার ময়মনসিংহ জেলা পরিবার পরিকল্পনার উদ্যোগে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালী জুবলীঘাট পৌর মার্কেট হতে জেলা পরিষদ পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়। এরপর জেলা পরিষদ জব্বার মিলনায়তনে বিশ্ব জন সংখ্যা দিবসে বিস্তারিত আলোচনা ও পুরষ্কার বিতরণ করেন প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী।

বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা সিভিল সার্জন ডা:এ.কে.এম মুস্তুফা কামাল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ বাছীর উদ্দিন, ডা: মোঃ আব্দুর রব, M.O (C.C) জেলা পরিবার পরিকল্পনা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক বি.এম.এ ময়মনসিংহ, ইমপ্ল্যানন প্রদ্ধতি দ্বারা সারা বাংলাদেশে প্রথম ঢাকা বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার প্রাপ্ত মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র ময়মনসিংহ ডা: রোকসানা করিম, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কাজী মাহফুজুল করিম, মেডিকেল অফিসার ডা: শামীমা আনিস (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) সদর ময়মনসিংহ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বে করেন উপ-পরিচালক জেলা পরিবার পরিকল্পনা ময়মনসিংহ ডা: বিরাগ আনন্দ নাথ । অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ের এনজিও কর্মকর্তা সহ উপস্থিত ছিলেন।

জানা যায়,১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই পৃথিবীর জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে উন্নীত হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করা হয়। এক জরিপে দেখা গেছে যে, বর্তমানে জন্মগ্রহণকারী ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৯৭ জন জন্মগ্রহণ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, যারা এমনিতেই অধিক জনসংখ্যার দেশে।

বর্তমানে জনসংখ্যার মধ্যে ৩০০ কোটির বয়স ২৫ বছরের কম। যারা মোট জনসংখ্যার ৪৩% এবং এদের ৬০% বাস করে অনুন্নত দেশগুলোতে। ১৮০৪ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। জনসংখ্যা ২০০ কোটি হতে সময় লেগেছিল ১২৩ বছর। ধারণা করা হচ্ছে সামনের ১০০ কোটি বাড়তে সময় লাগবে ১১ বছর।

বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। ২০৫০ সালে তা বেড়ে প্রায় ২২ কোটিতে দাঁড়াবে। নারী ও শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে রয়েছে। দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী এ হুমকির মুখে বসবাস করছে। একদিকে বিশাল জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা মাথায় নিয়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে বসবাস করছে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে তাদের সামনে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি আজ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আয়তনের হিসেব করলে এই ছোট্ট দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাস তা ভাবাই কঠিন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, গত ৪০ বছরে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুন। বহুল জনসংখ্যার এই পরিস্থিতিতে দেশে যে সামগ্রীক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা মহাদুর্গতির চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। ভয়ের ব্যাপার এতোটা ছিল না, যদি বর্ধিত জনসংখ্যাকে বর্ধিত জনশক্তিতে রূপান্তরের একটা যথাযথ সুপরিকল্পিত উদ্যোগ থাকতো দেশ কর্ণধারদের। অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বর্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অন্যসব ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রটিতেও আমাদের তেমন কোনো সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই, নেই তেমন কোন মাথাব্যথা। ফলে কোন এক সময়ে দেশের জনসংখ্যা অসহনীয় হয়ে উঠবে। মালথাসের ভবিষ্যৎদ্বাণী সত্য হবে, নির্মমভাবে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার কারণে আঘাত হানবে প্রকৃতি। অনাগত এ রকম ভয়াল পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আসলে আমরা কতটা ভাবছি ? দেশের নীতি-নির্ধারকদের কি এ নিয়ে আছে কোন উৎকণ্ঠা ? এদেশে বিশ বছর আগেও জন্মের হার এ রকম ছিল না। মাঝখানের সময়টুকুতে এ হার নেমে আসার কিঞ্চিৎ অগ্রগতিটি পূর্ববর্তী সময়ের প্রচার-প্রপাগান্ডার ফলই বলা যায়।

১৭৯৮ সালে ইংরেজ অর্থনীতিবিদ এবং জনসংখ্যাতাত্বিক থমাস ম্যালথাস তার বিখ্যাত বই An Essay on the Principle of Population প্রকাশ করেন যেখানে তিনি বলেন জনসংখ্যা বৃদ্ধি একসময় খাদ্যশস্য উৎপাদনের হারকে ছাড়িয়ে যাবে। এর যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে থাকে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্য উৎপাদনের হার বাড়ে গানিতিক হারে। ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে যে তখন তারা সমস্ত খাদ্য শেষ করে ফেলবে এবং কোন উদ্ধৃত্ত থাকবে না যদি জনসংখ্যার বৃদ্ধি দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ কিংবা অন্য কোন উপায়ে রোধ না করা হয়। ম্যালথাসের তত্বের পক্ষের এবং বিপক্ষের সবাই একটা জিনিষ অন্ততঃ মেনে নিয়েছেন যা হলো জনসংখ্যার চাপ এবং অ-পূরণযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ফলে সৃষ্ঠ পরিবেশগত সমস্যার সমাধান যদি আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সমাধান করতে না পারি তবে তা আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং অপ্রিয় উপায়ে হলেও নিজে নিজেই সমাধান হয়ে যাবে, যেমনটি ম্যালথাস বলেছেন সেভাবে। পরিবেশগত সমস্যা প্রায়ই মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি করে যা আমাদের দেশে কোর্ট কিংবা গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে মীমাংসিত হয়, আবার কখনও কখনও তা হানহানিতে রুপান্তরিত হয়। জ্যারেড ডায়ামন্ড তার Collapse বইতে দেখিয়েছেন ৯৪ সালের রুয়ান্ডার গনহত্যা শুধুমাত্র হুটু এবং টুটসিদের মধ্যে সা¤প্রদায়িক ঘৃণার বহিঃপ্রকাশই ছিলো না, এর সাথে আরও অনেকগুলো কারন জড়িত ছিলো, যেমন অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং ভূমির স্বল্পতা । অসংখ্য কৃষক পরিবার একটি নির্দিষ্ট পরিমান ভূমিকে ক্রমাগতভাবে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করতে করতে এমন একটি পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো যা কিনা আর একটি কৃষক পরিবারের ঠিকে থাকার পক্ষে যথেষ্ঠ ছিলো না। ডায়ামন্ড তার বইতে দেখিয়েছেন ম্যালথাসের তত্বের সবচাইতে খারাপ অবস্থা কিভাবে বাস্তবে পরিনত হতে পারে।

তবে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে একমাত্র পরিবেশ বা জনসংখ্যার কারণেই কোন দেশ বা সভ্যতা অতীতে ব্যর্থ হয়েছে এমন কোন উদাহরণ জানা নেই। সবসময়ই এর সাথে অন্যান্য আরও কিছু কারণ জড়িত থাকে। জ্যারেড ডায়ামন্ডের মতে একটি দেশ বা সভ্যতার ব্যর্থ হওয়ার পেছেনে ৫টি কারন কাজ করতে পারে। এই পাঁচটি কারণের মধ্যে ৪টি কারণই কোন একটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ন হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কারনগুলো হলোঃ পরিবেশের ক্ষতিসাধন, জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রতিবেশী হিসাবে শত্রু দেশের অবস্থান, বাণিজ্য সহায়ক প্রতিবেশী বন্ধু দেশ। তবে পঞ্চম কারণটি প্রতিটি দেশের জন্যে অতি অবশ্যই খুবই গুরত্বপূর্ন একটি কারণ আর সেটি হলোঃ একটি দেশ তার পরিবেশের সমস্যা সমাধানে যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে থাকে সেগুলো।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে, আন্তর্জাতিক অভিবাসন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের নাগরিকদের হারাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত জনংখ্যার কারণে যেহেতু এই দেশগুলো তাদের নাগরিকদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়-এমনকি অনেক সময় মৌলিক চাহিদাও পূরণ করতে পারে না সেহেতু বহু মানুষ উন্নত দেশগুলোর দিকে পা বাড়ায়।

অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্যও জনসংখ্যার তীব্র চাপ দায়ী। ১৯৬০ সালের দিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাত্র ২২ শতাংশ নগরে বসবাস করতো। ১৯৯০ সালে এসে তা ৩৪ শতাংশে উন্নীত হয়। ধারণা করা চচ্ছে ২০১৫ সালে তা ৪৮ শতাংশে রূপ নেবে। চাহিদার তুলনায় বেশি নগরায়ন হলে কি হয়? তখন এক দিকে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পায়, বনাঞ্চল উজাড় হয়, অন্যদিকে খাদ্য, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন সুবিধা, গণপরিবহন, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা-সুবিধার চাহিদা বাড়তে থাকে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, বিশেষ করে এর রাজধানী ঢাকা একটি আদর্শ উদাহরণ।

জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতির ফলে, জীবনযাত্রার মান এবং পরিবেশ কোনোটিই বজায় রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কেননা তখন রাষ্ট্র বিপুল জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খায়। সবচেয়ে বড় কথা, বেশি জনসংখ্যা মানে, রাষ্ট্রের আয় ও সম্পদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগ্নাংশ হওয়া। যেমন, আমাদের ক্ষেত্রে-গ্যাসসম্পদ। প্রয়োজনের তুলনায় মানুষ বেশি বলেই পর্যাপ্ত জ্বালানী থাকা সত্ত্বেও তা অপ্রতুল মনে হচ্ছে। আর জ্বালানীর অভাব বলেই আমরা গাছ কেটে বন উজাড় করছি। এই বাস্তব উদারণটি থেকেও আমরা বুঝতে পারি, জনসংখ্যা সমস্যা একা আসে না।

সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, অতিরিক্ত জনসংখ্যা খাদ্যসঙ্কট তৈরি করে। একটি তথ্য দিলে বিষয়টি ভয়াবহতা বুঝা যাবে, ব্রিটেন ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফ্যাম গত বছরের (২০১১) ৩১ মে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে পৃথিবীর ৯শ ২৫ মিলিয়ন মানুষ (অর্থাৎ প্রতি ৭ জনের একজন) চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য পাচ্ছে না । 'গ্রোইং এ বেটার ফিউচার : ফুড জাস্টিস ইন এ রিসোর্স-কনস্ট্র্যাইন্ড ওয়ার্ল্ড' শিরোনামের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতির, এর অন্যতম কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জাতিসংঘ বলছে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯ বিলিয়নে ঠেকবে, তখন এই বিপুল সংখ্যক মানুষের চাহিদা পূরণে ৭০ শতাংশ বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে হবে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষকে যদি স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চিয়তা দেয়া যায়, তাহলে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ কমে। কৃষকদের বেশি সন্তান থাকার কারণ, সে মনে করে বেশি সন্তান মানেই বেশি শ্রমিক, বেশি ফসল। আর পুত্র সন্তানের আশায় বার বার সন্তান গ্রহণ তো রয়েছেই। আর বাল্য বিবাহ এবং পরিবার পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের অভাবেও পরিবার বড় হচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা উপরের দিকে উঠছে, সর্বোপরি বিশ্বজনসংখ্যা বোমার রূপ ধারণ করছে।

২০১১ সালের মে মাসের শুরুতে জাতিসংঘ বিশ্ব জনসংখ্যা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে, আগামী ৯০ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ১ হাজার কোটি ১০ লাখ। আর এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হবে ৯ শ ৩০ লাখ। সংস্থাটির ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের করা 'দ্য পপুলেশন প্রস্পেক্ট : দ্য ২০১০ রিভিশন' প্রতিবেদনে বিশেষ করে ৫৮টি দেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যেগুলো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে। যে সব দেশের জন্ম হার কম সে দেশগুলোতে পৃথিবীর জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। ৪০ শতাংশ মানুষ মধ্যম জন্ম হারের দেশগুলোতে এবং বাকি ১৮ শতাংশ মানুষ বেশি জন্ম হারের দেশে বসবাস করে। জন্ম হার বেশি এমন ৩৯টিই দেশে আফ্রিকা মহাদেশে, ৯টি এশিয়ায় ৬টি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশে এবং ৪টি লাতিন আমেরিকায় অবস্থিত। আইসল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড বাদে ইউরোপের সবগুলো দেশের জন্ম হার কম। এশিয়ার ৫১টি দেশের মধ্যে ১৯টি দেশ, আমেরিকা মহাদেশের ৩৯টির মধ্যে ১৪টি দেশ, আফ্রিকার ৫৫টির মধ্যে মাত্র ২টি এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশে মাত্র একটি দেশের জন্ম হার কম। চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া জাপান, ভিয়েতনাম, জার্মানি, ইরান, থাইল্যান্ড ও ফ্রান্স-এই দেশগুলোর ৭৫ শতাংশ জনসংখ্যাই কম জন্ম হারের দেশগুলোতে বাস করে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, মেক্সিকো ও মিসর-এই দেশগুলোর তিন-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা মধ্যম জন্ম হারের দেশগুলোতে বসবাস করে। পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ফিলিপিনস, ইথিওপিয়া, কঙ্গো, তানজানিয়া, সুদান, কেনিয়া, উগান্ডা, ইরাক, আফগানিস্তান, ঘানা, ইয়েমেন, মোজাম্বিক ও মাদাগাস্কার-এই দেশগুলোর ৭৫ শতাংশ জনসংখ্যা বেশি জন্ম হারের দেশগুলোতে থাকে। ২০১১ ও ২১০০ সনের মধ্যে কম বেশি জন্ম হারের দেশগুলোর জনসংখ্যা তিন গুণ হবে (১শ কোটি ২০ লাখ থেকে ৪শ কোটি ২০ লাখ)। একই সময় মধ্যম জন্ম হারের দেশগুলোর জনসংখ্যা ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে (২শ কোটি ৮০ লাখ থেকে ৩শ ৫০ লাখ) এবং যে দেশগুলোর জন্ম হার কম সেগুলোর জনসংখ্যায় ২০ শতাংশ যোগ হবে (২শ ৯০ লাখ থেকে ২শ ৪০ লাখ)। কম জন্ম হারের দেশগুলোর জনসংখ্যা ২০৩০ সালে ৩শ কোটি ১০ লাখ এবং ২০৬৫ সালে মধ্যম জন্ম হারের দেশগুলোর জনসংখ্যা ৩শ ৮০ লাখে উন্নীত হবে। কম জন্ম হারের দেশগুলোর মধ্যে চীনের জনসংখ্যা ২০৩০ সালে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাবে। তখন দেশটির জনসংখ্যা ১শ কোটি ৪০ লাখে পৌছাবে। মধ্যম জন্ম হারের দেশ হিসাবে ভারতের জনসংখ্যা ২০৬০ সালে ১শ কোটি ৭০ লাখে পৌছাবে। গড় আয়ুর হিসাব দিতে গিয়ে জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০০৫-২০১০ সালে উচ্চ জন্ম হারের দেশগুলোর মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৬ বছর, ২০৪৫-২০৫০ সালে তা বেড়ে ৬৯ বছর এবং ২০৯৫-২১০০ সালে ৭৭ হবে। মধ্যম জন্ম হারের দেশগুলোর মানুষের গড় আয়ু ২০০৫-২০১০ সালে ছিল ৬৮ বছর, ২০৪৫-২০৫০-এ হবে ৭৭ বছর এবং ২০৯৫-২১০০ সালে হবে ৮২ বছর। নিম্নমুখী জন্ম হারের দেশগুলোর মানুষের গড় আয়ু ২০০৫-২০১০ সালে ছিল ৭৪ বছর, ২০৪৫-২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৯৫-২১০০ সালে হবে ৮৬ বছর। বর্তমানে নিম্ন জন্ম হারের দেশগুলোর ১১ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বছর বা তারও বেশি এবং ৩৪ শতাংশের বয়স ২৫-এর মধ্যে। ২০৫০ সালে এ দেশগুলোর ২৬ শতাংশের বয়স হবে ৬৫ বা তারও বেশি এবং ২৪ শতাংশের বয়স হবে ২৫-এর মধ্যে। ২১০০ সালে এই ২৫-এর সংখ্যা ২৭ শতাংশ এবং ৬৫ বা তারও বেশির সংখ্যা ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ২০১০ সালে উচ্চ জন্ম হারের দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশের বয়স ছিল ২৫-এর মধ্যে। ২০৫০ সালে তা কমে ৪৮ শতাংশ এবং ২১০০ সালে ৩৫ শতাশং হবে। ২০১০-এ ৬৫ বা তারও বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ, ২০৫০ সালে তা দ্বিগুণ হবে এবং ২১০০ মাসে বেড়ে ১৬ শতাংশ হবে।

জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ জানিয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৭শ ৩০ কোটি ২১ লাখ ৮৬ হাজার, ২০২০ সালে ৭শ ৬৭ কোটি ৪৮ লাখ ৩৩ হাজার, ২০২৫ সালে ৮শ ১ কোটি ১৫ লাখ ৩৩ হাজার, ২০৩০ সালে ৮শ ৩০ কোটি ৮৮ লাখ ৯৫ হাজার, ২০৩৫ সালে ৮শ ৫৭ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার, ২০৪০ সালে ৮শ ৮০ কোটি ১১ লাখ ৯৬ হাজার, ২০৪৫ সালে ৮শ ৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৪৪ হাজার এবং ২০৫০ সালে বিশ্বজনসংখ্যা ৯শ ১৪ কোটি ৯৯ লাখ ৮৪ হাজারে গিয়ে ঠেকবে।

আমাদের সংবিধানের ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করতে সফল হচ্ছে না। এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ মাত্রতিরিক্ত জনসংখ্যা। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার জনসংখ্যা ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি হাতে নেয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য (২০০১) মতে, সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩ শতাংশ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ২০০০ সালের মধ্যে তা ১.৪৭ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। ২০০৪ সালের জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে। বলা হয়েছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস করতে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা, শিশু স্বাস্থ্যসেবা ও প্রজনন সেবা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনযাত্রার মানকে আরো উন্নত করা জরুরি। এর লক্ষ্যমাত্রা আজো অর্জিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জবাবদিহিতা, দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন এবং যুগোপযোগী পদ্ধতি। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও এনজিওগুলোকেও কার্যকর এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা এর বিশাল জনগোষ্ঠী, যা তার ভৌগোলিক আয়তন ও প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় কল্পনাতীত বিশাল। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সরকারের গৃহীত না মুখি উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, সেই সঙ্গে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের রাজধানী ঢাকা শহর।

অত্যাধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে সমাজে বাড়ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বাসস্থান সংকট, খাদ্য সমস্যা, অপরাধ, সন্ত্রাস, দুনীর্তি, অপুষ্ঠি, পতিতাবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, মাদকাসক্তি, নিরাপত্তাহীনতাসহ আরো নানাবিধ সমস্যা।

মূলত: মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা হচ্ছে অনেক জটিল সমস্যা কারণ যা জীবন যাত্রার মান কমিয়ে দেয়। জনসংখ্যার উচ্চ প্রবৃদ্ধি উন্নয়ণশীল দেশের সীমিত সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং প্রকারন্তে তাদের সমস্যা আরো বাড়ায়।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ উন্নয়ণশীল দেশসমূহের একটি প্রধান উন্নয়ণ কৌশল। শিক্ষা, সচেতনতার অভাব, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি নিষেধ এসব দেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রধান বাঁধা, এসব কারণে সচেতনতা বৃদ্ধি কিংবা স¤প্রসারণ সর্বত্রই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সাফল্য পায়নি। ফলে ওই সব দেশে দারিদ্র্য বিমোচন করা খুবই কঠিন হয়ে পরেছে।

আমরা দেখতে পাই, বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীন জনসংখ্যার সমস্যা নিয়ে যেখানে তারা এখন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, যদিও আয়তনের দিক থেকে ভারত আমাদের দেশের চাইতে বিশগুন এবং চীন ষাটগুন বড়, সেখানে আমরা জনসংখ্যা নিয়তন্ত্রের জন্য কঠোর পদপে গ্রহণ না করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি এবং গৃহীত উন্নয়ণ মূলক কর্মকান্ডের সফল বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছি। দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য না দিয়ে আমরা অন্যান্য উন্নয়ণমূলক কর্মকান্ডের উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, এর ফলে আমরা যতই উন্নয়ণ করছি জনসংখ্যার অধিক চাপে সেইসব উন্নয়ণ মলিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশ থেকে বেকারত্ব, দারিদ্র্য বিমোচনের করার কাজও কঠিন হয়ে পরছে। ফলে সমাজে বাড়তে নানাবিধ সামাজিক অপকর্ম।

বর্তমানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রের ক্ষেত্রে গণচীনে যে কঠোর আইন রয়েছে তারচেয়েও আমাদের দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে সরকারকে আরো অধিক কঠোর হতে হবে, বর্তমানে জনসংখ্যার এই ভয়াবহতার হাত থেকে রা পাওয়ার জন্য। যদিও আমাদের দেশের প্রায় সকলের জানা, দেশের সিংহভাগ সমস্যার মূলেই রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা।

মূলত: এই জনসংখ্যা নিয়তন্ত্রের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণই আমাদের দেশের জন্য হতে পারত সরকারের অন্যান্য গৃহীত উন্নয়ণমূলক কর্মকান্ডের চাইতে কল্যাণকর পদক্ষেপ। তাই বর্তমান সময়ে পরিবার পরিকল্পনার যে কর্মসূচি আমাদের দেশে চালু আছে তা আরো ব্যাপকতর করার পাশাপাশি এদেশের জনগণকে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ণে এবং পরিকল্পিত ছোট পরিবার রাখতে কঠোর আইনের বেড়াজালে আবন্ধ করতে হবে।
একটি পরিবারে সর্বোচ্চ দুই সন্তানের অধিক সন্তান নিলে সেই পরিবারকে প্রয়োজনে নাগরিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে মূলত যে কারণ গুলি জরিত সেই কারণ গুলি অতি দ্রুত সনাক্ত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করতে হবে।

যেমন: নিররতা দূরীকরণ, ধর্মীয় গোড়ামি রোধ, বাল্যবিবাহ রোধ, মহিলাদের অধিক কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করণ, সঠিক জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন, অনাকাঙ্গিত গর্ভধারণের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের আইনগত বাধা দূর, যে সকল ধর্মীয় ও সামাজিক নেতারা জন্মনিয়তন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের আরো অধিক সচেতন করে তোলা, জন্ম নিরোধক বিভিন্ন পদ্ধতি দারিদ্র্য জনগণের কাছে সহজলভ্য করা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সমস্যা গুলি অতিদ্রুত দূর করতে হবে।
আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত ছোট পরিবার সৃষ্টির মাধ্যমেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূণ্যের কোঠায় আনা সম্ভব। তাই এই দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কল্পে সরকার, সংশ্লিষ্ট মহলসহ জনগণ সকলকে আরো অধিক সচেতন হতে হবে, পাশাপাশি অধিক জনসংখ্যা রোধে কল্পে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর পরেও যদি সরকার তথা জনগণ এই আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে তবে এদেশের জনগণ চরম ভাবে বিপর্যস্ত হবে, সেইসঙ্গে দেশের যাবতীয় কার্যক্রম এক সময় স্থবির হয়ে পরবে।

তাই সরকার তথা সকল দেশবাসীকে যতদ্রুত সম্ভব জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ঘরে ঘরে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং দেশে বিরাজমান সিংহভাগ সমস্যা সমাধানে জন্মনিয়তন্ত্রের ব্যাপারে সকলকে ঐক্যবোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অধিক জনসংখ্যার কুফল সম্মদ্ধে জনগণকে অবহিত করতে হবে, অধিক প্রচারণা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, জনসচেতনতা গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারেরকে জনসংখ্যা রোধকল্পে দ্রুত কঠোর আইন প্রণয়ণ করতে হবে, যাতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে জনগণ এক প্রকার বাধ্য হয়।

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতপূর্ণ দেশ হওয়াতে বিষয়টি এখানে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনো সেটা উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার ১.৩৯ শতাংশ এবং এ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৫০ সালে জনসংখ্যা ২২ কোটি ২৫ লাখে পৌঁছবে।