ময়মনসিংহে প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিকে মর্মান্তিক কর্মকাণ্ড

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 31 May 2016, 06:18 PM
Updated : 31 May 2016, 06:18 PM

ময়মনসিংহে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলিতে বিষ্ময়কর ও মর্মান্তিক কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে ছোট ছোট কক্ষে অতিরিক্ত ফি আদায় ভূল চিকিসায় রোগীর মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটলেও খুব বেশি কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়না ।

অভিযোগ রয়েছে, ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা এসমস্ত প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক পরিচালনাকারীদের হাত অনেক লম্বা হওয়ায় উল্টো ঝামেলায় জড়ানোর ভয়ে দুর্নীতি -অনিয়ম, চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা আর রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে ।

অভিযোগে প্রকাশ, সৃষ্টিকর্তার পরেই: মানুষের প্রাণ ও সুস্থতা নিয়ে চিকিৎসকের কাজ। চিকিৎসকদের সঙ্গে সমাজের আর কোনো পেশাজীবী গোষ্ঠীরই তুলনা চলে না। চিকিৎসকের ঘুম নেই, খাওয়ার সময় নেই, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য সময় নেই। কারণ মানুষের জীবন বাঁচানো এসবের চেয়ে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসব জেনে-বুঝেই একজন মেধাবী শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি চিকিৎসক হবেন। মানুষের এই ধারণা ও প্রত্যাশা কী মাত্রায় আঘাত পেলে চিকিৎসকদের সম্পর্কে অমানুষ, গরিবের রক্তচোষা, কসাই, ডাকাত ইত্যাদি শব্দ তারা ব্যবহার করতে পারে এই জিজ্ঞাসা প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চিকিৎসকদের মনে জাগে না ।

প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসার মান এবং চিকিৎসা ব্যায়ের ব্যাপারে জনমনে প্রশ্ন আছে। উন্নত চিকিৎসাসেবার প্রতিশ্রুতিতে রোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। উন্নত চিকিৎসাসেবার প্রত্যয়ে গড়ে তোলা প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক তাদের লক্ষ্য ভুলে এখন চিকিৎসালয়কে ষোলআনা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কার্যত সাইনবোর্ড সর্বস্ব, চিকিৎসাসেবা বলতে সেখানে তেমন কিছুই নেই। পীড়িতকে চিকিৎসা দেয়া সেবামূলক কাজের অংশ।

এক সময় সরকারি চিকিৎসা খাতকে চ্যালেঞ্জ করে পীড়িতকে আরও উন্নত সেবা দেবার প্রত্যয়ে স্বদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে উঠে। প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই উপযুক্ত চিকিৎসক, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবক-সেবিকা, আয়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও রোগীদের সেবা দেবার মত কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। নাম সর্বস্ব ডাক্তার, সেবক-সেবিকা, আনাড়ি টেকনিশিয়ান ও অদক্ষ লোকবল দিয়ে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চালানোর অভিযোগও রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ।

প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সম্মুখে দুই ডজনেরও বেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নামের তালিকা সম্বলিত বিশাল সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে । সাধারণ রোগীরা মনে করেন এই প্রাইভেট হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ছড়াছড়ি রয়েছে। দ্রুত আরোগ্য লাভের আশায় রোগীরা এই প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেন।

ভূক্তভোগীদের অভিযোগে জানা যায়, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক সিন্ডেকেট মালিকরা তাদের নিকটবর্তী এলাকার স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, জেলার সদর হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নামের তালিকা দিয়ে সাইনবোর্ড তৈরী করে হাসপাতালের সামনে ঝুলিয়ে রাখে। এখানে রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভর্তি হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরিবর্তে ভূয়া বিশেষজ্ঞ কিংবা ৩ মাস বা ৬ মাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রাম্য ডাক্তারদের ডেকে এনে বিশেষজ্ঞ সাজিয়ে রোগীর চিকিৎসা করিয়ে ফি আদায় করা হয়।

আবার প্রাইভেট এই প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকদের সাথে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের মৌখিক চুক্তি থাকে। সে অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসলে চুক্তি অনুয়ায়ী ডাক্তারদের ফোন করা হলে ডাক্তাররা কর্মস্থল ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে ছুটে যান। তখন ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদেরকে ডাক্তারের অপেক্ষায় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলার উপজেলাগুলির হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসককে অফিস চলাকালীন সময়ে স্বদেশ প্রাইভেট হাসপাতালে আসা যাওয়া করতে দেখা যায় বলে জানা গেছে। এভাবে এই প্রাইভেট হাসপাতালের টানাটানির কারণে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের চিকিৎসা সেবা বহুলাংশে বিগ্নিত হয় বলে জানা গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিক সিন্ডিকেটের অনেকেই নিজে চিকিৎসক না হয়েও রাতের বেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে মুখোঁশ পরে নিজের হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের রাউন্ডে দেখতে যান। তাদের যাবার আগে কনসালটেন্ট স্যার আসবে বলে ওয়ার্ডে, কেবিনে প্রচারণা চালানো হয় । তারপর ভূয়া কনসালটেন্ট ওয়ার্ডে গিয়ে সবকিছু দেখে আসেন। এই দেখা বাবত প্রতারণার মাধ্যমে ভর্তি রোগীদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা কনসালটেন্ট ফি আদায় করা হয় ।

এভাবেই প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকরা পীড়িতকে স্বাস্থ্যসেবা দেবার আড়ালে দ্রুত ধনী হবার উদ্দেশ্যে সাইনবোর্ড সর্বস্ব নামে মাত্র বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মানুষের সাথে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক অনুমোদিত হয় । একজন রোগী জানালেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যারা এই প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্স দিয়েছেন তারা কি জানেন ? এই প্রাইভেট হাসপাতালে এত ডাক্তারের উৎস কোথায়? স্বদেশ প্রাইভেট একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভিজিট ফি ৫০০-৮০০ টাকা। মানুষ মনে করে, এটা 'গলাকাটা ফি'। এত টাকা কেন নেওয়া হয়? কে নির্ধারণ করে দিয়েছে এত টাকা ভিজিট ফি? আর সেটা রাতারাতি ৫০০ টাকা থেকে এক লাফে ৮০০ টাকায় উঠলে কিছু বলার বা করার কেউ কি আছে? তা ছাড়া, চিকিৎসকেরা কি ভিজিটের টাকা নিয়ে রোগীকে রসিদ দেন? যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক স্বদেশ প্রাইভেট হাসপাতালের চেম্বারে বসে প্রতিদিন চল্লিশ-পঞ্চাশ জন রোগী দেখেন, তাঁর দৈনিক আয় কত? তিনি আয়কর বিভাগকে কী হিসাব দেন? প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিরীহ রোগীরা শুধু প্রতারিতই হচ্ছে না, অপচিকিৎসা, ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করছে, কেউ আজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়েছে , কেউ অকালে প্রাণ হারিয়েছে।

প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদেরকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে বাধ্য করাসহ কত ভাবে যে রোগীর পকেট কাটা হয় তার ইয়াত্তা নেই। কেবল ভুক্তভোগীরাই এ সম্পর্কে খুব ভালো জানেন।বর্তমান সময়ে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে জমজমাট ব্যবসা হচ্ছে- গর্ভবতী মায়েদের (সিজার) অপারেশন। এটি এই হাসপাতালের একটি বড় প্রকল্প বলে ভূক্তভোগীদের অভিযোগ জানা গেছে। ভূক্তভোগীরা জানায়, স্বদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গর্ভবতী মায়েদের (সিজার) অপারেশনের জন্য তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে ময়মনসিংহ জেলা ও উপজেলাগুলির প্রতিটি পাড়া মহল্লায় দালাল নিয়োগ করে রেখেছে। গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসক ও ফার্মেসী মালিকরাই এদের প্রদান দালাল। একটি রোগী পাঠালে তাদের তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন দেয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালে কর্মরতরা এ ক্ষেত্রে স্বদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের রেফারির দায়িত্ব পালন করছেন। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক রোগী পাঠিয়ে ভিজিটররা ও গ্রাম্য চিকিৎসকদের মতই কমিশন লাভ করেন। আর এসব টাকা আদায় করা হয় রোগীর নিকট থেকেই। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক রোগী ভর্তি হলেই বিলের মিটার ঘুরতে শুরু করে। এ মিটার রোগী হাসপাতাল কম্পাউন্ড ত্যাগ না করা পর্যন্ত বন্ধ হয়না। রোগীর সেবা বাবদ বিলের যে ফর্দ রোগীর স্বজনদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় সেটি গলাকাটা বিল নামে পূর্ব থেকে পরিচিত। এ বিলের ফর্দ দেখলেই রোগীর অভিভাবকরা প্রথমে আঁতকে উঠে। দরিদ্র রোগীর স্বজনদের অনেক সময় তাদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে স্বদেশ প্রাইভেট হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে হয়।

অর্থলিপ্সু প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অপচিকিৎসা ও চিকিৎসা বাণিজ্য বন্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনার দাবী ময়মনসিংহের প্রতিটি মানুষের । ময়মনসিংহবাসী মনে করেন, মৌলিক অধিকার মানুষের চিকিৎসাসেবা অর্থলিপ্সুদের কাছে জিম্মি হতে দেয়া যায় না। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের গলাকাটা ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। এর জন্য কঠোর নীতিমালা এবং জবাবদিহিতা বাধ্যমূলক করতে হবে। গলাকাটা বিল আদায়ের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কতজন রেজিষ্ট্রার্ড চিকিৎসক কর্মরত আছেন তা তদন্ত করে দেখতে হবে।

বর্তমান সরকার গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের কাছে চিকিত্সা সেবা পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই ময়মনসিংহের সর্বমহলে প্রত্যাশিত যে, মযমনসিংহবাসীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যা-যা করা দরকার, সরকার ব্যাপক জনকল্যাণের কথা চিন্তা করে অতিদ্রুত তাই করবেন। সরকারের কাছে প্রত্যাশা, এসব কিছু আমলে এনে ময়মনসিংহবাসীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।