ময়মনসিংহ শহর ভাঙ্গা-গড়ায় বিলুপ্তির পথে প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 19 Sept 2016, 01:14 AM
Updated : 19 Sept 2016, 01:14 AM


সর্বত্র পরিবর্তনের পালা জমিদারদের শহর ময়মনসিংহে। বাংলাদেশের ৮ম বিভাগীয় শহর। ১৮২৯ সনে ঢাকা বিভাগের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০১৫ সনের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিলো এই বিভাগের অংশ বিশেষ। বর্তমান সারকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় বৈঠক করেন। এরই ধারাহিকতায়অবশেষে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা নিয়ে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ বিভাগের ঘোষণা দেন। বিভাগের আয়তন ১০,৪৮৫ বর্গকিলোমিটার ও জনসংখ্যা ১,১৩,৭০,০০০ জন।


এই বিভাগের জেলা এবং ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল নিয়ে ১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ ভারত সরকারের গড়া ছিলো ময়মনসিংহ জেলা । ১৭৮৭ সালের ১ মে তারিখে প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ আদিনাম ছিলো 'নাসিরাবাদ'। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত উনবিংশ শতকের শুরুতে গঠিত হয় ময়মনসিংহ শহর । দুই শতাধিক বছরেরও অধিক প্রাচীন শহরে প্রতিষ্ঠিত প্রতœতত্ত্ব নিদর্শন আজো ঐতিহ্যের স্বাক্ষী ।


যদিও ময়মনসিংহের নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে । ষোড়শ দশকে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ'র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন । সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি। মুসলিম যুগের উৎস হিসেবে নাসিরাবাদ নামটির প্রয়োগ এখনও আছে ।


১৭৭৯ সালের রেনেল এর ম্যাপে মোমেসিং নামটি বর্তমান 'ময়মনসিংহ' অঞ্চলকেই নির্দেশ করে। তার আগে আইন-ই-আকবরীতে 'মিহমানশাহী' এবং 'মনমনিসিংহ' সরকার বাজুহার পরগনা হিসাবে লিখিত আছে; যা বর্তমান ময়মনসিংহকেই ধরা যায়। এসব বিবেচনায় বলা যায় স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালের আগে থেকেই ময়মনসিংহ নামটি প্রচলিত ছিলো। ব্রিটিশ আমলে জেলা পত্তন কালে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমৃদ্ধ জমিদারগণ সরকারের কাছে জেলার নাম 'ময়মনসিংহ' রাখার আবেদন করলে সরকার তা বাস্তবায়ন করে ।


আবার আরেক পক্ষের দাবী, ময়মনসিংহ নামকরণ করা হয় সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহের নাম অনুসারে। সেনাপতি মানসিংহকে সম্রাট আকবর এ অঞ্চলে পাঠান বার ভূইয়ার প্রধান ঈশা খাঁকে পরাজিত করার জন্য। পরবর্তীতে মান সিংহের কাছে ঈশা খাঁ পরাজিত হয়। তখন থেকে বাংলা থেকে বার ভূইয়ার আধিপত্য শেষ হয় ।


১৭৯১ সালে জেলা সদরের পত্তন হয় এবং ১৮৬৯ সালে ময়মনসিংহ পৌরসভা গঠিত হয়। কালেক্টরেট ভবন ছিল ময়মনসিংহ শহরের প্রধান কেন্দ্র । ১৭৮৭ সারে সরকারী ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। ১৮৮৭ সালে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। ১৭৯১ সালে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করা হয়।১৮৮৩ আদম শুমারী পরিচালিত হয় । ১৮৮৯ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ১৮৬৫ ময়মনসিংহ-জগন্নাথগঞ্জ রেলপথ চালু হয় । ১৯৩৭ সালে পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয় । বর্তমানে ময়মনসিংহ শহরের সর্বত্রই পরিবর্তনের পালা । নতুন নতুন নির্মাণ শৈলিতে গড়ে উঠেছে আধুনিক বহুতল ভবন । অপরদিকে প্রাচীন অনেক ভবনের নিদর্শন বিলুপ্তির পথে।

মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী নিজ পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নির্মান করেন দ্বিতল ভবন "শশীলজ"। ময়মনসিংহের রাজবাড়ি বলতে মহারাজা সূর্যকান্ত নির্মিত দৃষ্টিনন্দন শশীলজ কটেজকেই বুঝে থাকেন। গঙ্গাদাস গুহ রোডে জেলা পরিষদ ভবনের বিপরীতে এর বিশাল উপস্থিতি চোখে পড়ার মত। প্রধান ফটকের সামনে দাড়িঁয়ে বাড়িটির দিকে তাকালে সবুজ গাছ গাছালির সমাবেশে সাদা পাড় মেরুন বাড়িটি অদ্ভুত সুন্দর নারী ভাষ্কর্যসহ যে কাউকে চমকে দেয়। বিশাল এ বাড়িটিতে আছে অসংখ্য দুর্লভ বৃরে সমারোহ। ১৯৫২ সাল থেকে শশীলজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের একমাত্র সরকারি মহিলা শিক প্রশিক্ষন কলেজ।

শশীলজ থেকে সামান্য দূরেই মহারাজের বাগানবাড়ি। আয়তন বিবেচনায় বাগান বাড়িটি বেশ কিছুটা বড়। ময়মনসিংহ শহরের উল্ল্যেখযোগ্য এক স্থাপত্য আলেকজান্ডার ক্যাসেল বা আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল এ বাগান বাড়িতে অবস্থিত। মহারাজা সূর্যকান্ত ময়মনসিংহ শহরের জুবলি উৎসব পালনের জন্য তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড পত্নী সম্রাজ্ঞী আলেকজান্দ্রার নামে দ্বিতল লোহার তৈরী এই ভবন নির্মান করেন। অন্য এক মতে ময়মনসিংহের তৎকালীন ইংরেজ কালেক্টর আলেকজান্ডার আই সি এস এর নামে ১৮৮৯ তে ভবনটি মহারাজা সূর্যকান্ত নির্মান করেন। লালকোঠি বা লোহার কুঠি নামে সাধারন্যে পরিচিত দ্বিতল ভবনটি অভ্র বা চুমকি ব্যবহারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত ছিল বলে জানা যায়। এটি বর্তমানে শিক প্রশিন কলেজ (পুরুষ)। ১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সহ পৃথিবীর অনেক খ্যাতিমান মানুষ এখানে আতিথ্য গ্রহন করেন।

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন রোডের পাশে আকর্ষনীয় কারুকার্য খচিত চৈনিক নির্মান শিল্পীদের দ হাতের দ্বিতল কাষ্ট্র নির্মিত বাড়িটির নাম গৌরীপুর লজ। গৌরীপুরের জমিদারের শহরের বাসভবন এটি। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের পর দ্বিতল বাড়ি নির্মানের অনুমতি না থাকায় কাঠের বাড়িটি নির্মান করেন গৌরীপুরের জমিদার রাজেন্দ্র কিশোর। বর্তমানে বাড়িটি সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

নারায়নডহের জমিদার মোহনী মোহন মজুমদার শহরের বাড়ি এটি। বর্তমান এএসপি ট্রাফিক এর অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার জমিদার বাড়ি তালজাঙ্গালাজ। সি কে ঘোষ রোডে অবস্থিত এ বাড়িটি বর্তমানে আলমগীর মনসুর মেমোরিয়াল কলেজ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।এ বাড়িটি জমিদার রায় বাহাদুর জেমি গুহর বাড়ি বর্তমানে খামার বাড়ি হিসাবে পরিচিত। অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেস সভাপতি সুসং দূর্গাপুরের জমিদার কুমুদ চন্দ্র সিংহ এর আবাসটি ছিল মহারাজা রোডে, যার নামে মহারাজা রোডের নামকরন হয়।

সাহেব কোয়ার্টার রোডের শেষপ্রান্তে পৌর পার্কেও পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র জমিদারদের নগরী এটি মূলত অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী নলিনী রঞ্জন সরকারের একতলা বাড়ি পরবর্তীতে যা দ্বিতল করা হয়েছে। গৌরীপুরের কালিপুর এষ্টেটের জমিদার রমনীকান্ত লাহিড়ীর শহরের বাসভবন এটি যেটি বর্তমানে সূর্যকান্ত হাসপাতাল বা এস কে হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেসব জমিদার বাড়িগুলো ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে বা রনা বেনের অভাবে অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে । তন্মেধ্যে গোলপুকুরের জমিদার কুমার উপেন্দ্র চৌধুরীর বাড়ি ।

আলাপসিংহ পরগনার বাসাবাড়ি এস্টেট এর জমিদার শিরীষ চন্দ্র চৌধুরীর বাসভবন কিছুদিন আগে ভেঙ্গে মার্কেট করা হয়েছে, গৌরীপুরের রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর বাসভবন বিপন্ন প্রায়, কালিবাড়ি রোডের নারায়নডহের জমিদার বাড়িটিও ধ্বংস প্রায়, ঈষান চক্রবর্তী রোডের টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির জমিদার এবং ঈষান চক্রবর্তীর নিজের বাড়িটির অবস্থাও ভাল না। মুক্তিযুদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের অফিস হিসাবে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে, শিানুরাগী আঠার বাড়ি এষ্টেট এর জমিদার িিতশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর বাসভবন বর্তমানে যার কোন অস্তিত্ব আর নেই ।

শহরের সি কে ঘোষ রোডের অমরাবতী নাট্যমন্দির (বর্তমানে ছায়াবনী সিনেমা হল) এর বিপরীতে যে জমিদার বাড়িটি দেখতে পাবেন এটি ছিল ত্রিশালের সেনবাড়ির জমিদার সুরেন্দ্র চন্দ্র সেন ও বাদল চন্দ্র সেনদের শহরের বাসভবন। তিনি ছিলেন ভাওয়াল রাজার রায়ত, কিশোরগঞ্জের মসুয়ার জমিদার হরি কিশোর রায় চৌধুরীর বাড়িটি এখন কমিউনিটি সেন্টার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার পরস্পরা উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সুকুমার রায়, সত্যাজিৎ রায়, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দানবীর রায় বাহাদুর রনদা প্রসাদ সাহার বাড়িটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যা শিশু একাডেমীর কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিশোরগঞ্জের গাঙ্গুটিয়ার জমিদার ডি এন চক্রবর্তীর বাড়িটির কোন অস্তিত্ব আর এখন নেই । কিছুদিন আগে চিরদিনের জন্য হাড়িয়ে গেল ত্রিশালের কালি হারীর জমিদার প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তীও বসত বাটি। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া আরেকটি জমিদার বাড়ি টাঙ্গাইলের বেলতার জমিদার অনাথবন্ধু গুহর বাড়ি যেটি ভেঙ্গে ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয়ের জন্য বহুতল ভবন নির্মান করা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন বাড়িগুলি সংস্কার সংস্কারের দাবি ময়মনসিংহবাসীর ।