ময়মনসিংহে ডিসি বিতর্ক নাকি সংস্কৃতি ধ্বংস?

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 28 Sept 2016, 03:51 AM
Updated : 28 Sept 2016, 03:51 AM

ময়মনসিংহে ছিলেন জেলা প্রশাসক মোস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী। ইতোমধ্যে বিদায় নিয়ে, বিদায় না বলে বদলি বা স্থানান্তরও বলা চলে, অন্য মন্ত্রনালয়ে চলে যাওয়ার আগে ময়মনসিংহে বিভিন্ন সংগঠন ডিসি মোস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীকে বিদায় জানায় আনুষ্ঠানিকভাবে। এটা কেবল ময়মনসিংহের সংস্কৃতি অথবা ঐতিহ্যই নয় এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি।তবে ময়মনসিংহের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্নতা অবশ্যই আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো যিনি বিদায় নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছেন তিনি কতটা জনসম্পৃক্ত ছিলেন তার ওপর নির্ভর করে বিদায় অনুষ্ঠান দায়সাড়াগোছের না আড়ম্বরপূর্ণ হবে।

ময়মনসিংহের ডিসি মোস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী অত্যন্ত জনসম্পৃৃক্ত ছিলেন। যার ফলে তাঁর বিদায়ানুষ্ঠান প্রায় সবগুলোই আড়ম্বরপূর্ণ ছিল পত্রিকান্তরে প্রকাশ। ময়মনসিংহ জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত বিদায় সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডিসিকে চড়ানো হয় ঘোড়ার গাড়িতে ।এই ক্রিড়া সংস্থার মত অনেক প্রতিষ্ঠানেই তিনি পদাধিকার সভাপতি ছিলেন। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে উৎকৃষ্টমানের খেলোয়াড়, কবি, আবৃত্তিকার, অভিনেতা সর্বোপরি আপাদমস্তক একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। যে কারণে তিনি ছিলেন এক অনুকরনীয় অনুসরনীয় মানুষ। সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিদায়ী এই ডিসির রাজকীয় পোশাক পরিহিত ছবিসহ রিপোর্ট হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিভিন্ন মহল বিষয়টিকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখছেন। অনেকে পেয়ে বসেছেন। আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে। রাজধানী ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমগুলো বিদায়ী ডিসির সংবর্ধনার খবরকে গুরুত্বসহ কভারেজ করে যাচ্ছেন।

পত্রিকার কাটতি বেড়েছে। টক অব দ্য ডিস্ট্রিক্ট থেকে খবরটি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। খবরটি পত্র-পত্রিকার মেকআপও দৃষ্টিদন্দন করেছে কেননা যাত্রা পালার রাজা বাদশার মতো পোশাক ও রাজ মুকুট পরেছেন বিদায়ী ডিসি। একটি পত্রিকার ভেতরের রঙ্গিন পৃষ্ঠায় 'বাদশা-বেগম' বেশে সদ্য সাবেক ডিসির সাথে তার সহ ধর্মিনীর ছবি ছাপা হয়েছে। একটি কাগজে তার সস্তানদের ছবিও ছাপা হয়েছে।

যদিও সাবেক ডিসির সাথে তার স্ত্রী-সস্তানদের ছবি ছেপে দেয়াকে অনেক পাঠক মেনে নিতে পারেন নি। তারা গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার সীমারেখা ও বাড়াবাড়িকেও সমালোচনা করেছেন। গণমাধ্যম অবশ্য সেইসব প্রতিক্রিয়া ধারণ করে না।


জাতীয় গণমাধ্যম যখন ময়মনসিংহ ও চট্রগ্রামের বিদায়ী জেলা প্রশাসনের সংবর্ধনার খবর দিচ্ছে তখন ময়মনসিংহের স্থানীয় গণমাধ্যম এর কড়া সমালোচনা করেছে। যদিও ময়মনসিংহের কয়েকজন সাংবাদিকই প্রথম খবরটি ছাড়েন। যারা অতীতে জেলা প্রশাসকের প্রশ্রয় পান, কিন্তু বিদায় বেলায় 'কোটপিন' এর খবরটিতে আংশিক সত্য প্রকাশিত হলে বিদায়ী ডিসি তাদের ইতিবাচক সাংবাদিকতা চর্চার কথা বলেন।

এরপরই শুর হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিউজ। যার উদ্দেশ্য বিদায়ী ডিসিকে বিতর্কিত করা ও ইমেজ ক্ষুন্ন করা। সেই লক্ষ্য সম্পন্ন হয়েছে। বিদায়ী ডিসি সমালোচিত হওয়ায়।

ময়মনসিংহের সচেতন মহল ব্যথিত হয়েছেন। বিব্রত হয়েছেন। তারা উদ্দ্যেশ্যমূলক সাংবাদিকতার কড়া সমালোচনা করে যাচ্ছেন। যদিও সব কিছুই সংবাদ ও সাংবাদিকরা বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে খবর দিতেই পারেন-সে অবস্থায় বিদায় সংবর্ধনার খবর গণমাধ্যমে আসছে তা স্বাভাবিক।

যার মধ্য দিয়ে উঠে আসছে ইস্যু। এ ব্যাপারে এখন এমন প্রশ্নও উঠেছে যে-সরকারী কর্মকর্তাদের বরণ ও সংবর্ধনার রীতি বহাল থাকবে না। তা তুলে নেয়া হবে।?


ময়মনসিংহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বিদায়ী ডিসির বিপক্ষে প্রকাশিত সংবাদগুলোকে তীব্র সমালোচনা করে ষ্ট্যাটাস দেয়া অব্যাহত রয়েছে।

জনগণের আবেগ, ভালোবাসা ও সম্মান প্রকাশের বিষয় বিদায় সংবর্ধনা। এটি একটি এলাকার জনগণের লোকাচার। সংস্কৃতি। ময়মনসিংহে বিদায়ী জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীর বিদায় সংবর্ধনাগুলোর আয়োজক, অংশগ্রহনকারী জনগণকে অবমাননা করা হচ্ছে সাম্প্রতিক রিপোর্ট গুলোতে। জনগণের সম্মিলিত অভিব্যক্তির বহিপ্রকাশ ছিল ওইসব বর্নাঢ্য বিদায় সংবর্ধনা।

যেখানে বিদায়ী জেলা প্রশাসকের অংশগ্রহন করা ছাড়া কোন ভূমিকা ছিল না। বা কোন কিছু করার ছিল না। তিনি ৩ বছর ময়মনসিংহ কর্মস্থলে থাকার বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নেও ভূমিকা রাখেন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রশ্নে উচ্চ কন্ঠে ছিলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তার সময়ে ময়মনসিংহ শান্তিপূর্ণ জেলায় পরিণত হয়। সরকার বিরোধীদের আগুন সস্ত্রাস এখানে মাথাচাড়া দিতে পারে নি।

সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জল করতে জেলা প্রশাসক হিসাবে মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী জেলা প্রশাসনে গতিশীল নেতৃত্ব দেন। জেলার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন-সুশীল সমাজসহ নতুন প্রজন্ম সব মহলই তার ভূমিকায় মুগ্ধ। যেজন্য তার বিদায় বেলায় এতো সংবর্ধনার ঘনঘটা। সংবর্ধনা বেশি হওয়া তার নয় ময়মনসিংহের সমাজের দায়। গণমাধ্যমের অবিমৃশ্যকারী হঠকারি রিপোর্ট কী জনগণকে প্রকারান্তরে কাঠগড়ায় তুলছেন না।

সাবেক জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীর মতো জেলা প্রশাসক ময়মনসিংহে খুব কম এসেছেন। তিনি সংস্কৃতি নগরী ময়মনসিংহে সাংস্কৃতিক জাগরন সৃষ্টি করেছেন।

সচেতনতা বিকাশে সামাজিক আন্দোলন বিস্তুৃত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে তার বক্তব্য প্রশাসনকে জনবান্ধব করেছেন। তিনি দুর্নীতিমুক্ত গতিশীল প্রশাসন পরিচালনা করেছেন। তিনি বলেছেন-সংস্কৃতিই রোধ করবে জঙ্গিবাদ। তিনি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জনগণের অনুরোধে মঞ্চে দাড়িয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।

নাট্য অঙ্গনকে প্রনোদনা দিতে দর্শক আসন থেকে উঠে একটি নাটকে বিচারক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তার সময়ে জেলা প্রশাসনে আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংস্কৃতিকজন ও মেধাবী। যাদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ ময়মনসিংহ এগিয়ে গেছে।

সেই বিদায়ী জেলা প্রশাসককে ঈশ্বরগঞ্জের সংবর্ধনায় একজন স্বর্ণের কোটপিন উপহার দেন। মঞ্চে তাকে বিব্রত করেননি সত্য কিন্তু অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে নেমেই তিনি কী কোটপিন ফিরিয়ে দেন নি। তার বক্তব্য ও তিনি একে নিরুৎসাহিত করেন। সাংবাদিকরা এই তথ্যটি কী জানতে পারলেন না, সত্য চেপে গিয়ে আংশিক সত্য প্রকাশ করা হয়েছে। অনসাম্বল থিয়েটার ময়মনসিংহের প্রতিশ্রুতিশীল নাট্য সংগঠন। বিদায় পর্বে তারা মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীকে বরণ করেছেন। তাকে আজীবন সদস্য পদ দিয়েছেন।

মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনসাম্বল এর আয়োজনটি ছিল অনুষ্ঠান নয় আড্ডা। সেখানে অনসাম্বল এর রীতি মাফিক আজীবন সদস্যকে যাত্রা পালার ঐতিহাসিক রাজকীয় পোশাক পরিধান করানো হয়। পারিবারিক আয়োজনের ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। সেই ছবি সাংবাদিকরা লুফে নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করে রাজকীয় গণসংবর্ধনা বলে তথ্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন।

বিদায়ী ডিসি সংবর্ধনা নিতে পারেন কিনা সেই বির্তকে বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন। প্রশাসন কী দেশ ও জাতির কাছে গুরুত্বহীন। একজন জেলা প্রশাসক বিদায় নিয়ে ময়মনসিংহে তাকে ঐতিহ্যেও সূত্র ধরেই আন্তুরিক বিদায় সংবর্ধনা দেয়। এটি জমিদারী শহরের বৈশিষ্ট। ইতিহাস। এটি নতুন নয়। চিরাচরিত প্রথা। কিন্তু যেভাবে বিদায়ী জেলা প্রশাসককে বিকৃতির মাধ্যমে অপদস্থ ও বিতর্কিত করা হলো ময়মনসিংহের জন্য তা অবমাননা।

এরপর কী ময়মনসিংহ আর কোন কর্মকর্তাকে, বিদায় সংবর্ধনা দিবে, না তারা সেই সংবর্ধনা নিবেন? এমন যদি হয়-তবে কী ময়মনসিংহে কোন অফিসার আসবেন? যে ডিসি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা তার সংবর্ধনায় বলে গেলেন- তাকে সমালোচিত হতে হবে কেন?

কে বা কারা এটি-করছেন। ময়মনসিংহ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে। 'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। সুতরাং রাজকীয় পোশাকে সমস্যা কোথায়? ছোট্ট ইস্যুতে বিব্রতকর দশা। এক ছবিই কী সব শেষ করে দেয়? রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনা ছিলো না সেটি। ছিলো ঘরোয়া আয়োজন। ময়মনসিংহের মনের মানুষ মনের রাজাকে বরণ।

অনসাম্বল থিয়েটার এর রীতি মোতাবেক নতুন আজীবন সদস্য বরণে যাত্রাপালায় কুশলীদের ব্যবহৃত রাজকীয় পোশাক পরিধানের রেওয়াজ। মাত্র ৫ মিনিটের পর্ব। মাটিতে গোল হয়ে বসে মনের কথা প্রাণ খুলে বলা। আড্ডা । জনমানুষের সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা ঘোষনা করা।

বিদায়ী জেলা প্রশাসকের উপস্থিতি। ছিলো নির্মল নির্দোষ আয়োজন। অথচ ফেসবুক থেকে নেয়া ছবি নিয়েই তোলপাড়। বিদায়ী জেলা প্রশাসক এর সময়ে ময়মনসিংহে দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত হয়েছিলো যাত্রা উৎসব।

মৌলবাদী হুমকি ও জুয়ারীদের জন্য যে শিল্প ধংস হতে বসেছিলো তা প্রাণ পেয়েছিলো সংস্কৃতিবান এই বিদায়ী জেলা প্রশাসকের জন্যই। এজন্যই হয়তো হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি তারা ফুঁটিয়ে তুলেছিলেন এই বিদায়ী ডিসিকে ঘিরেই । আসলে এটি ডিসি বিতর্ক? নাকি সংস্কৃতি ধংস করার একটি অপচেষ্টা প্রশ্ন সংস্কৃতিপ্রেমীদের ।


ডিসি-কে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছে।

আমাদের মানসিকতার যতটুকু দৈন্যতা রয়েছে ততটাই তাদের কাছে বিসদৃশ মনে হয়েছে ডিসি-কে ঘিরে যে অনুষ্ঠানাদি হয়েছে তা দেখে।

যতক্ষণ পর্যন্ত মোস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী ডিসি ছিলেন কেউ এ বিদায়ানুষ্ঠান প্রসঙ্গে কোন নেতিবাচক কথা বলেছে বলে মনে হয়নি, চোখে পড়েনি বা কানে আসেনি। যাক, যোগ্য ব্যক্তিকে আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করি। সমালোচনাকারীকে বন্ধু ভাবি আর নিন্দুক তার সে কাজ করবেই!