ময়মনসিংহে শিশুরা চালাচ্ছে অটোরিকশা

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 14 Dec 2016, 05:19 AM
Updated : 14 Dec 2016, 05:19 AM

প্রাচীন শহর ময়মনসিংহে এখন মাত্রাতিরিক্ত অটোরিকশা চলছে যার অধিকাংশই অনুমোদনবিহীন। এসমস্ত অটোরিকশার অধিকাংশ চালকই আবার অপ্রাপ্ত বয়স্ক অর্থাৎ শিশু। অটোরিকশার রুট পারমিট, চালকের লাইসেন্স নেই। এই কাগজপত্র পরীক্ষা করতে দেখা যায় না ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদেরকেও। অভিযুক্তদের আটক বা জরিমাণাও শূণ্যের কোটায়।


একেকটি অটোরিকশায় যাত্রী ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি বহনের অভিযোগও আছে। এতকিছুর পরও যাত্রী ভাড়া বাড়ছেই। এই শিশু অটোচালকদের কোন হেলপার নেই। একাই চালক, হেলপার আর কন্ট্রাকটারের কাজ করে। কোনো নির্দিষ্ট স্টপেজ নেই, অটোরিকশার যাত্রী ওঠানো-নামানো চলে সব সড়কেই। কখনো যাত্রী নেমে গেলে চালক হাতের ইশারায় যাত্রী তোলেন। আবার যাত্রীর ইশারায় অটো থামিয়ে ফেলেন।

ট্রাফিক বিভাগ সূত্রের দাবি, অটোর মালিকরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। একজন মালিক বলেন, নেতাদের মতো পুলিশ কর্মকর্তারা মাসে বড় অঙ্কের টাকা এখান থেকে পেয়ে থাকেন।

ময়মনসিংহ শহর মরণ ফাঁদ হচ্ছে বর্তমানে যাতায়াত মাধ্যম অটোরিকশার দ্বারা। প্রতিদিন দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন এখানকার যাত্রীরা। এর জন্য জনসাধারণ, জনপ্রতিনিধি দায়ী করছেন অপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সহীন চালকদেরকে। একটি শুমারি অনুযায়ী দেখা যায়, এসব অপ্রাপ্ত বয়স্ক লাইসেন্সহীন চালকদের হাতেই তুলে দেয়া হয় অনিবন্ধিত অটোরিকশা। অন্য একটি শুমারি অনুযায়ী দেখা যায় ময়মনসিংহ নিবন্ধিত অটোরিকশার তুলনায় অনিবন্ধিত অটোরিকশার সংখ্যাই বেশি। ১০ সহস্রাধিক অটোরিকশার ২৫ ভাগই শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক। ট্রাফিক সার্জেন্ট পিযুষ শহরে ১০ সহস্রাধিক অটোরিকশা চলাচল করে বলে স্বীকার করেন।

অটোচালক সজিব(১৩), বাবু(১২), রাকিব (৮), রাজু (১২), হামিদুল (১১), মামুন (১৩) জানায় পেটের দায়ে এপেশা এসেছি। আমারা শিশু। তাই মালিকরাও আমাদেরকে ঠকায়। সরাদিন অটোরিকশা চালালে, আমাদেরকে মাত্র ১শ" টাকা করে মজুরি হিসাবে দেয়া হয়।

গত সোমবার অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুচালকের অটোরিকশার ধাক্কায় আহত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন মোছলেম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমি নিয়ম মেনেই রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আচমকা পেছন থেকে অটোরিকশা আমাকে ধাক্কা দেয়। যার চালক অপ্রাপ্ত বয়স্ক।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, এই শিশুচালকদের কবলে পড়ে আহত হয়ে প্রতিদিনই রোগী আসছেন হাসপাতালে। এতে হাসপাতালে সিটিস্কেনের হার বেড়েছে কয়েকগুণ।

অভিযোগ রয়েছে, অটো রিকশার মালিকরা এই ৮/১০ বছরের শিশু বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকদের দৈনিক মজুরি হিসাবে ৫০/৬০ টাকা এবং এক বেলা খাবারের বিনিময়ে অটোরিকশা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে মালিকপক্ষ ভালো আয়ের সুবিধা নিচ্ছেন। দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে সাধারণ মানুষ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কখনও কখনও মূল্যবান জীবনটাও।

ভূক্তভোগীরা বলছেন, বর্তমানে যে হারে প্রতিদিন পুলিশ অটোরিকশার কাগজপত্র তল্লাসি করছে সে হিসেবে যদি পুলিশ আন্তরিকতার সাথে এসব অপ্রাপ্তবয়স্ক লাইসেন্সহীন চালকদের লাইসেন্সসহ গাড়ির কাগজপত্র তল্লাসি করতো অথবা তাদের বিরুদ্ধে যদি আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হতো তাহলে অনেকাংশেই অযোগ্য চালকদের মাধ্যমে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা কমে আসতো। তারা এসব সমস্যা সমাধান করতে না পারে তাহলে এসব দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে। তাই প্রশাসনের এ বিষয়ের উপর তড়িৎ গতিতে দৃষ্টি আরোপসহ পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।

সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহর পরিদর্শন করেছেন, দাতাসংস্থা ইউএনডিপি প্রতিনিধি দল। এ দলের তাপস খ্যাং ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুরনো এই শহরের সংখ্যায় এতো অটো রিকশা আর দেখিনি। এটা দু:খজনক।

ময়মনসিংহে ট্রাফিক কর্মকর্তা মাহবুব জানান, আগামী জানুয়ারি থেকে ১৮ বছরের নীচে কোন চালক অটোরিকশা চালাতে পারবেনা। এটি সর্ম্পূণ অবৈধ। কারণ অটোরিকশার বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক চালকদের হাতে। এসব চালকেরা মানেনা ট্রাফিক আইন এবং যাচ্ছেতাইসহ নানা বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে। ফলে ঘটছে দূর্ঘটনা।

পৌরসভার ১৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দুলাল উদ্দিন দুলাল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, লাইসেন্স ছাড়া কোন অটোরিকশা রাস্তায় নামানো যাবেনা। অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক দিয়ে এগুলি চালানো যাবেনা। পৌরসভার লাইসেন্স ছাড়া বহিরাগত কোন অটোরিকশা শহরে প্রবেশ করতে পারবেনা। এ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর জব্দ করে রাখা হবে বহিরাগত ও লাইসেন্স বিহীন অটোরিকশা। এই অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পৌরসভা।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, শহরের বিভিন্নস্থানে গড়ে উঠেছে অবৈধ গ্যারেজ। এই গ্যারেজগুলিতে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এইসমস্ত অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ দেয়া হয়। এখানেও শ্রম দেয় শিশুরা। যাদেরকে বেতনও দেয়া হয় তুলকামূলহারে কয়েকগুণ কম। অটোরিকশা চালক সুমন (১০) জানায়, সারাদিন অটো চালালে মজুরি দেয়া হয় ৫০/৬০ টাকা এবং এক বেলা খাবার।

বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের কাজে নিয়োগ দেয়া আইনত নিষিদ্ধ। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে এই পেশায় কমছে না শিশুশ্রম, যা শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের ভাবিষৎ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে সাহায্য করে তারা।

ময়মনসিংহের বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে অনেকে হয়ত বলবেন, শিশুশ্রম থাকা উচিত। কেননা এ সব শিশু টিকে আছে পরিশ্রম করে। কাজ না করলে তাদের খাওয়াবে কে? দেখবে কে? তাছাড়া তাদের পরিবারও টিকে আছে তাদের আয়ের উপর। মোটের উপর অটোরিকশা চালক হিসেবে এসব শিশু কাজ করলে সেটা অনেক পরিবারের জন্যও ভালো। আমাদের কাছে এ সব যুক্তি শিশুশ্রমের যৌক্তিক কারণ মনে হয় না। একটা শিশুকে কাজের মধ্যে ঠেলে দিয়ে একটা সুন্দর সম্ভাবনাকে কার্যত শুরুতেই মাটি চাপা দেয়া হয় আর এর দায় আমাদের সবার এবং অবশ্যই জনগণের প্রতিনিধি সরকারের।

অটোচালক শিশুরা অল্প বয়সেই বিভিন্ন রোগের কবলে পড়ে যায়। পরিশ্রমের ক্লান্তির কারণে, পর্যাপ্ত সময় না থাকায় লেখাপড়া থেকে কার্যত ছিটকে পড়ে। আইনে আছে ১৪ বছরের কম বয়সীদের কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে না। এই আইনের প্রয়োগ করতে হবে কঠোরভাবে এই দাবি অভিজ্ঞমহলের।