করোনাকালের উপকথা

মো. নুরুল আবছার
Published : 28 June 2020, 10:16 AM
Updated : 28 June 2020, 10:16 AM

কাতার প্রবাসী মো. রাহিম তিন মাসের ছুটিতে দেশে ফিরেছেন। দেশে আসার পরপরই কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউন শুরু হয়। এর মধ্যে তার ছুটিও শেষ হয়ে গিয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি কর্মস্থল কাতারে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি। বর্তমানে বাধ্য হয়ে দেশেই অবস্থান করছেন। তিনি একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা যাদের পাঠানো অর্থে দেশ একটা শক্ত অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আর দেশ প্রতিনিয়ত গড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড।

দুই বছর হলো মো. রাহিমের উপার্জনের ওপর ভিত্তি করে তার পরিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বসবাস শুরু করে। ছেলেমেয়ের ভালো লেখাপড়ার কথা ভেবে তারা শহরে আসে। বড় ছেলেকে শহরের সেরা একটা স্কুলেও ভর্তি করানো হয়। পরিবার চলছিল বেশ ভালোভাবে। এরই মধ্যে পৃথিবীতে হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস। বাংলাদেশও ভয়াবহ ভাবে আক্রান্ত। ফলে দেশে ফিরে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। একদিকে প্রতি মাসের বাসা ভাড়া আর খাবার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে জমানো সকল টাকা শেষ। খরচ জোগাড় করতে না পেরে এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সপরিবারে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার খেওয়াই গ্রামে চলে যাবেন। মনে করার কোনো কারণ নেই করোনাকালে এটা কেবল একজনের গল্প – বরং হাজারো মানুষের করুণ আর্তনাদের উপকথা! করোনাভাইরাসে এটা বিশ্বময় বাস্তবতা, রূঢ় বাস্তবতা!

একদিকে করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময় মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে এভাবে হাজারো মানুষ জেলা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। কোনোরকম বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এ লড়াই বেঁচে থাকার লড়াই – কোনোরকম টিকে থাকার লড়াই। অন্যদিকে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় বড় শহরের চিত্রও একই। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মচারী ছাঁটাই ও বেতন কমানো, বাসাবাড়ি ও মেসে নারী গৃহকর্মীদের কাজ না থাকা এবং ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও হকারদের বিক্রি কমে আসায় ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। মধ্যবিত্তরা অতিরিক্ত বাসা ভাড়ার জন্য তাদের পরিবার পাঠিয়ে দিচ্ছে গ্রামে। শুধু চাকরিজীবী ব্যক্তি থাকছেন মেস ভাড়া নিয়ে। কর্মক্ষম ব্যক্তি পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এই সংগ্রাম কত দিন চলবে? সেটা কেউ বলতে পারছে না। করোনাকালে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের উপার্জনের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বিশ্বে এই শ্রেণির মানুষ অর্থনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

তবে এই সংগ্রাম থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি শুরু থেকেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন দেশের জনগণকে করোনাভাইরাসের আঘাতে জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি খাওয়া-পরার যুদ্ধও করতে হবে। আর তাই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দরিদ্র মানুষের সহায়তায় নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি সরকারি নানা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে এসএমই, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ভর্তুকি দিয়ে তহবিল দিয়েছেন। ইতোমধ্যে করোনাকালীন র্অথনীতিকে সচল রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী ১ লক্ষ ১১১৭ কোটি টাকার ১৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য বিশেষ তহবিল বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকা, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পসহ মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান ২০ হাজার কোটি টাকা, চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদেও বিশেষ সম্মানী ১০০ কোটি টাকা, করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ শ্রমিক ও দিনমজুর পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিবার প্রতি ২৫০০ টাকা করে নগদ প্রদান, কৃষি খাতের উন্নয়নে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রণোদনা প্যাকেজসহ অনেক যুগান্তকারী কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ করা হয়েছে। করোনাকালে সরকারের উদ্যোগ বিশ্বে নজিরবিহীন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে জনগণের সাথে মত বিনিময়ের করে তাদের করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার পাশাপাশি সাহস যুগিয়েছেন।

তবে কোভিড-১৯ এর মতো মহামারী মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে গানের একটা অংশ মনে পড়ছে- –

"….. ধনীরে ধন দিলা

গরীবের তুইলা পিঠের ছাল

রে দয়াল, এভাবে আর চলবে কতকাল….."

শিল্পপতিদের জন্য এখন সময় এসেছে স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে গরিবের পাশে দাঁড়ানোর।

করোনাকালে সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সাথে বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় করা গেলে সকল শ্রেণি পেশার মানুষজন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।