যুদ্ধ কার স্বার্থে?

মঞ্জুর মোর্শেদ
Published : 25 Dec 2016, 02:40 PM
Updated : 25 Dec 2016, 02:40 PM

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি ) সব সময়ে একটা ব্যাপারে গবেষণা করে আসছে – পৃথিবীটা  ধীরে ধীরে বসবাসের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠছে কিনা । একদিকে প্যারিসে এবং জার্মানিতে হামলা আর অন্যদিকে ইরানের সাথে পরমাণু অস্ত্র নিরোধে চুক্তি , পৃথিবীটা কি শান্তির দিকে না অশান্তির দিকে যাচ্ছে । ওদের ভাষ্য অনুযায়ী এটা বলা কঠিন ।

সিপরির ২০১৫ তে মূল ফোকাস ছিল মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত -ইরাক ,সিরিয়া , ইয়েমেনে যুদ্ধ , লিবিয়ায় বিশৃঙ্খলা , নাইজেরিয়ায় বোকো হারামের সহিংসতা । এছাড়াও ছিল ছয়টা দেশের সমুদ্র সীমা নিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে অনিশ্চিয়তা ।

ওদের গবেষণায় উঠে এসেছে গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্রের জোগান ব্যাপকহারে বেড়েছে । গত দু'বছরে অস্ত্রের জোগান কিছুটা কমলেও এর ৫০% এর বেশি সরবরাহ এসেছে আমেরিকা থেকে। পশ্চিম ইউরোপও বিশেষ করে জার্মানি , ফ্রান্স এবং ব্রিটেন ও পিছিয়ে ছিল না । এই তিনটি দেশ জোগান দিয়েছে শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি। আর রাশিয়ান অস্ত্র বিক্রয়কারী কোম্পানিগুলোর গ্লোবাল শেয়ার ছিল ৮% এর মত। এশিয়ার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার অস্ত্র বিক্রি গত বছরের তুলনায় বেড়েছে বত্রিশ ভাগেরও বেশি।

বিশ্বে অস্ত্র উৎপাদনকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লকহিড মার্টিন আর নরথ্রপ গ্রূমেন , দুটোই আমেরিকান । কোম্পানিগুলোর মূল ক্রেতা হল লোকাল মার্কেট বা সরকার আর বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলো। সিপরি বলছে ২০১৫ তে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রি ২% কমার মূল কারণ ছিল ফেডারেল বাজেটের টানাটানির কারণে সরকারের অস্ত্র কিনতে পারেনি আর ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ার দরুন অস্ত্র বিক্রিতে বিরূপ একটা প্রভাব পড়েছিল । এছাড়াও আর একটা কারণ হতে পারে নতুন চুক্তি হলেও সরবরাহ হয়ত শুরু হয় নি ।কিন্তু ২০১৬ তে এসে সেটা পাল্টেছে । রিপাবলিকান সরকারের সময় আমেরিকা নিপীড়নকারী রাষ্ট্র এবং সরকারগুলোকে ব্যাপক হারে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল । সে চিত্র ওবামা সরকারের সময়েও পাল্টায়নি ।

আর কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চ যারা কিনা কনফ্লিক্ট জোনগুলোতে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহ নিয়ে গবেষণা করছে ,তাদের মতে রাষ্ট্রীয় চুক্তির বাইরে অবৈধ অস্ত্র গুলো আসছে মূলত চীন থেকে । এগুলো হয়ত সস্তা বলেই ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি । বিশেষ করে সাবসাহারা, আফ্রিকান দেশ গুলোতে চাইনিজ অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে বেশি ।

আর ২০১৫ তে অস্ত্র বিক্রি কমলেও এখনো সেটা ২০০২ এর তুলনায় ৩৭% বেশি । অস্ত্র টা অন্য কোন পণ্যের মতো বিক্রি হলে সমস্যাটা ব্যাপক আকার ধারণ করত না । কিন্তু এর সাথে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয় যুক্ত হয়ে সমস্যা আরো ব্যাপক আকার ধারণ করেছে । সিরিয়ায় রাশিয়ার জড়িত হওয়া , চার লাখের ওপরে মানুষ হত্যা , আর সম্প্রতি ব্রিটেন এবং আমেরিকার সাথে সৌদিআরবের সর্ববৃহৎ অস্ত্র চুক্তি, আর এজন্য ইয়েমেন কে দিতে হচ্ছে চরম মূল্য ।

ইউকের অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো মানা হয় সেটা কাগজে কলমে অনেক বেশি সুস্পষ্ট এবং শক্ত । বলা হয়েছে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হবে না । সৌদী আরবকে দেয়া ইউকে ফাইটার প্লেন থেকে নিক্ষিপ্ত বোমায় ইয়েমেনে কিভাবে হাসপাতাল , স্কুল গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে । গতমাসে এক শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ভুলবশত নিক্ষিপ্ত বোমায় মারা গিয়েছে ১৫০ জন নির্দোষ ইয়েমেনি । ব্রিটেন এ ব্যাপারে টু শব্দ পর্যন্ত করে নি । বরঞ্চ ইয়েমেনে বোম্বিং শুরু হবার পর গত ১৮ মাসে অস্ত্র বিক্রি বেড়ে তিন বিলিয়ন পাউন্ডে ঠেকেছে ।
এমনকি ফ্রান্সের অস্ত্র বিক্রিও বেড়েছে গত একবছরে, বিশেষ করে মিশর এবং কাতারে ।

সোমালিয়া বা মালের মত দেশগুলো যাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা অবকাঠামো গত খাতে বিনিযোগের মুরোদ নেই , তারাও অস্ত্র কিনতে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে । অধিকাংশ আর্মসের লম্বা মেয়াদকাল থাকাতে এগুলো আবার হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহী গ্রূপ গুলোর কাছে ।

এশিয়ায় সাউথ কোরিয়া, ইউএসএ এবং ফ্রান্সের সাথে সমন্বিত টেকনোলজি ব্যবহার করে শুধু গত একবছরেই অস্ত্র বিক্রি বাড়িয়েছে ৩০% এরও বেশি, যেটা এ লিখার শুরুতেই বলা হয়েছে।

এখানে বিশ্ব বাজারে চিনের অস্ত্র কি পরিমান বিক্রি হচ্ছে তার কোন সঠিক, নির্ভরযোগ্য ডাটা পাওয়া যায়নি । চীনা কোম্পানিগুলো অবৈধভাবে সুদানে অস্ত্র বিক্রি করার দরুণ, সে অস্ত্র পরে বিদ্রোহীদের হাতে পড়েছে। যেটা চীনও হয়ত জানে না।

উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকা মিডল ইস্ট এবং আফ্রিকাকে তাদের অস্ত্রের বিশাল বাজারে পরিণত করেছে । এ দেশ গুলোতে নেই কোন সুশাসন, এদের অধিকাংশেরই রয়েছে পাশ্চাত্যের তল্পিবাহক অত্যাচারি সরকার । সেটা জেনেও মুখে গণতন্ত্রের বুলি আউড়িয়ে ব্রিটেন ,ফ্রান্স ,জার্মানি এবং আমেরিকার মতো দেশগুলোর এই অতিরিক্ত বাজার সৃষ্টির জন্যই নিবর্তনমূলক সকারগুলোকে সাহায্য করতেও পিছপা হচ্ছে না । পরিকল্পিত ভাবে সৃষ্ঠ সংঘাতে তৈরি হচ্ছে শরণার্থী সমস্যা । এই রিফিউজিদের হযত খুব ছোট একটা অংশকে আশ্রয় দিয়ে তারা হয়ত উদারতার মহিমা প্রকাশ প্রকাশ করছে মিডিয়া গুলোতে । আর যখন কিছু মানুষ তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকে মানতে না পেরে, ট্রাক নিয়ে ঢুকে পড়ছে সুপারমার্কেটে, কনসার্টে, পানশালায় বা ফুটবল মাঠে, তখনো আবার ওয়েস্টার্ন মিডিয়া এসব হন্তারকের ছবি ছাপিয়ে, নিহতদের স্মরণে পুষ্পার্ঘ অর্পণ দেখিয়ে দেদারছে সিমপ্যাথি কামাই করছে।

মূল সমস্যা হচ্ছে ব্যবসার অভিপ্রায়। আজকে রিফিউজিদের পেছনে এবং তাদের পুনর্বাসনে যে পরিমান অর্থ তারা ব্যয় করছে তার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি আয় করছে পরিকল্পিত যুদ্ধ থেকে সৃষ্ট অস্ত্র বিক্রি থেকে । আর এসব কথা যারা বলবেন মিডিয়াতে তারা অচ্ছুৎ। সে কারণেই নোম চোমস্কি, বলা হয় যার নাম প্রতি দু'মিনিটে একবার করে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে উচ্চারিত হয়, তাকে শেষ বার ১৯৭০ সালে মেইন স্ট্রিম মিডিয়া (নিউইয়র্ক টাইমস) আলোচনায় এনেছিল। নব্বুয়ের কাছাকাছি এ তরুণ এখনো স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।