অনলাইনে পাঠক মন্তব্য কতটা জরুরি?

মারুফ ইসলাম
Published : 27 May 2018, 08:30 AM
Updated : 27 May 2018, 08:30 AM

ঘরোয়া আড্ডায় বেশ কজন বন্ধু জানালেন তারা বিভিন্ন সংবাদ পোর্টালে প্রবেশ করেন মূলত সংবাদের পাদদেশের মন্তব্য পড়ার জন্য। হাস্যমুখে তারা বললেন: মানুষ যে কী পরিমাণ অদ্ভুত, হাস্যকর, যুক্তিহীন এবং একইসঙ্গে অশালীন ও অরুচিকর বাক্যালাপ করতে পারে তা এইসব মন্তব্য না পড়লে জানা হতো না।

দেশের কয়েকটি জনপ্রিয় পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে চোখ বুলালে বন্ধুদের কথার সত্যাসত্য উপলব্ধি করা যায়। সেখানে যেকোনো সংবাদের নিচে এন্তার মন্তব্য লক্ষ্য করা যায় এবং বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় মন্তব্যকারীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পরষ্পরকে গালিগালাজ করছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মন্তব্য ঘরে এইসব অশ্লীল ও প্রকাশ অযোগ্য মন্তব্য দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে সেলিব্রেটি ব্যক্তিদের ফ্যান পেজে প্রবেশ করলেই দেখা যায় তাদের যেকোনো পোস্টের নিচে অশালীন অপ্রয়োজনীয় মন্তব্যের ছড়াছড়ি। আমরা একটু স্মৃতি ফেরালে দেখতে পাব, ফেইসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ যখন তার ফেসবুক পাতায় নিজের বিয়ের ছবি প্রকাশ করলেন তখন বাঙাল মুল্লুক থেকে অনেকেই বাংলা ভাষায় জাকারবর্গের স্ত্রী প্রিসিলাকে কটাক্ষ করে, ব্যক্তি আক্রমণ করে, তার বাহ্যিক রূপ সম্পর্কে শত শত অপমানজনক মন্তব্য করতে থাকলেন।

আমাদের দেশি তারকারাও রেহাই পান না এই মন্তব্যকারীদের আক্রমণ থেকে। সেই আক্রমণের ফিরিস্তি দিতে গেলে মহাভারততুল্য বৃহদাকার বহি রচিত হবে। অতএব সে চেষ্টায় না গিয়ে বরং এই প্রবণতার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নজর দেয়া যাক।

পাঠক মন্তব্য মানেই যেন যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। ছবিটি প্রতীকী। সূত্র: Aspire Auctions

এ মাসের গোড়ার দিকে এই সময়ের জনপ্রিয় ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক স্যালি রুনি টুইটারে লিখেছেন, 'পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে গার্ডিয়ানের নিবন্ধের কমেন্টগুলো সম্পর্কে কথা বলা।' এরপর আমেরিকার একজন জনপ্রিয় ব্লগার লিও বাবুয়াটা তার ব্লগ 'জেন হ্যাবিট' থেকে মন্তব্য সুবিধা চিরতরে অপসারণ করেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, বেশির ভাগ মন্তব্যেই 'স্প্যাম' অর্থাৎ অশালীন কিংবা প্রকাশ অযোগ্য। সম্প্রতি আটলান্টিকডটকম তাদের কমেন্ট অপশন বন্ধ করে দিয়েছে। পরিবর্তে চালু করেছে লেটার্স সেকশন। পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক জেফরি গোল্ডবার্গ পাঠকদের উদ্দেশে লিখেছেন 'আমরা কমেন্ট অপশন বন্ধ করে দিয়ে লেটার্স অপশন চালু করছি। কারণ আমরা শ্রদ্ধাপূর্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা পছন্দ করি।'

অাটলান্টিকের সম্পাদকের কৈফিয়ত। ছবি: অাটলান্টিক ডটকম

তবে কেউ কেউ এখনো দোটানার মধ্যে আছেন। তারা মন্তব্য করার সুবিধা চিরতরে বন্ধ করে দেবেন কি না সে বিষয়ে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছেন না। যেমন জনপ্রিয় ওয়েবসাইট কপিব্লগার ২০১৪ সালে তাদের ওয়েবসাইট থেকে কমেন্ট অপশন তুলে নিয়েছিল, কিন্তু ২০১৬ সালে তারা আবার কমেন্ট অপশন চালু করে। একই পথে হেঁটেছেন মার্কিন ব্লগার মিখায়েল হায়াত। তিনি একসময় তার ব্লগ থেকে মন্তব্য সুবিধা অপসারণ করেছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি তিনি তা আবার ফিরিয়ে এনেছেন।

আমাদের দেশীয় গণমাধ্যমগুলো এখনো এ বিষয়ে নিরব। মন্তব্য সুবিধা চালু রাখবেন নাকি বন্ধ করে দেবেন এ ব্যাপারে তাদের কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত বেশ কজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা মনে করেন যে মন্তব্যের কারণে ওয়েবসাইটের ট্রাফিক বাড়ে। ভিজিটর বাড়ে। র‌্যাকিংয়ের অগ্রগতি হয়। তাই তারা মন্তব্য সুবিধা রাখার পক্ষে।

পাঠকের মন্তব্য। স্ক্রিনশটটি প্রথম আলো ডটকম থেকে নেওয়া

কিন্তু সত্যিই কি ট্রাফিক বাড়ে মন্তব্যের কারণে? এ বিষয়ে গুগলে বিস্তর ঘাঁটাঘাটির পর জানা গেল, ইউরোপ-আমেরিকাতেও বিষয়টি নিয়ে মতদ্বৈততা রযেছে। প্রচুর বিতর্ক চলছে এ নিয়ে। এই বিতর্কের ডামাডোলের মধ্যেই একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে হাবস্পট। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি এক লাখ নিবন্ধ পর্যালোচনা করে একটি ফল প্রকাশ করেছে এবং সেখানে তারা বলেছে, মন্তব্যের সঙ্গে নিবন্ধের 'ভিউ' বাড়া-কমার কিংবা সাইটের 'ট্রাফিক' বাড়া-কমার কোনো সম্পর্ক নেই।

এখন দেখার পালা উন্নত দেশের গণমাধ্যম ও আমাদের গণমাধ্যমগুলো এই ফল মেনে নিয়ে তাদের ওয়েবসাইটের মন্তব্য সুবিধা বন্ধ করে কি না।

বেশিরভাগ গণমাধ্যমকর্মী অবশ্য মন্তব্য সুবিধা রাখার পক্ষে, কারণ তারা মনে করেন মন্তব্য সুবিধা থাকলে যেকোনো সংবাদের তাৎক্ষণিক পাঠক-প্রতিক্রিয়া জানা যায়। মন্তব্যের মাধ্যমে লেখক-পাঠক আন্তঃসম্পর্ক গড়ে ওঠে বলেও মনে করেন তারা।

কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা আবার তা মনে করেন না। তাঁদের ভাষ্য: এসব কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য সমাজে গোপন বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বসে পড়ছে। সম্প্রতি মার্কিন নৃবিজ্ঞানী ক্রিস্টাল ডি কস্টা তাঁর ব্লগে 'অনলাইনের মন্তব্যগুলো খারাপ জানার পরও আমরা তা কেন পড়ি' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, 'অনলাইন মন্তব্যগুলো সাধারণ খিস্তি খেউর, গালি-গালাজ ও ব্যক্তি আক্রমণ ধরনের হয়। এটা হয় কারণ অনলাইনে মানুষ সামাজিক মূল্যবোধের ধার ধারে না।'

ক্রিস্টাল ডি কস্টার মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়: একজন মানুষ অনলাইনে অদৃশ্য থেকেও নিজের উপস্থিতি জানান দিতে পারে। অনলাইনে অন্যের চেহারা না দেখে কিংবা অন্যের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয় না বলে সে নির্দ্বিধায় গালি দিতে পারে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে যার সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা হচ্ছে বা যাকে গালি দেয়া হচ্ছে তার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবার সম্ভাবনা থাকে না বলে মানুষ খুব সহজেই খারাপ ভাষায় গালি দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষের ভেতরে সেলফ সেন্সরশিপ কাজ করে না। মানুষের অন্তর্গত অনুমতিদাতা এ ক্ষেত্রে এই বলে মস্তিষ্কে বার্তা পাঠায় যে, আক্রমণাত্মক ব্যক্তির সঙ্গে আপনার কখনোও দেখা হবে না, সুতরাং আপনার অপমানিত হওয়ার সুযোগ নেই। অতএব আপনি ইচ্ছামতো গালি দিতে পারেন। খিস্তি খেউর করতে পারেন। আক্রমণ করতে পারেন।