আমরা এখনও সেই গ্ল্যাডিয়েটর যুগের পিশাচ

মারজিয়া প্রভা
Published : 13 July 2015, 10:12 AM
Updated : 13 July 2015, 10:12 AM

সেই কতকাল আগের কথা! গ্রিসের সেই স্বর্ণযুগের (!) গল্প, যখন ছিল বীর বীর যোদ্ধারা। অপরাধীকে হিংস্র জন্তুর সামনে ছেড়ে দেওয়া হত। তারপর লড়তো অপরাধি সেই চারপেয়ে, বিবেকহীন, অসভ্য, হিংস্র জানোয়ারগুলোর সাথে। রক্তাক্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করত লড়াকু বীররা, জন্তুগুলো তাদের মাংস ছিঁড়ে খেত। আর এই দৃশ্য দেখে দর্শক সারিতে হাততালি পড়ে যেত, উল্লাসে ফেটে যেত তারা।

দিন বদলেছে। আমরা সেই রকম অসভ্য নেই আর। শিক্ষায় সভ্যতায় পরিপুষ্ট হয়েছি। তাই আমরা হিংস্র জন্তুগুলোকে দিয়ে মানুষ খাওয়াই না, নিজেরাই পিটে মেরে ফেলি! ডেথ রেস একটা মুভি দেখেছিলাম, অপরাধীদের একটা রেসের মুখোমুখি হতে হবে। যে বাঁচবে ওই রেসে সে জয়ী, মুক্তি পাবে। আর যে বাঁচবে না সে তো বাই বাই! এমনভাবে রেসগুলো তৈরি করা যেখানে প্রতিটা পদক্ষেপ মৃত্যুকুপ। লাইভ প্রচার করা হত টিভিতে । দর্শকরা সে ভয়াবহ নৃশংসতা উপভোগ করত, টিআরপি বেড়ে যেত টিভিঅলাদের।

ওটা না হয় ফেক কাহিনী ছিল। ছবির গপ্প! কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? সেটাই কি না?

রাজনের মৃত্যুর গল্প ইংগিত দেয়, পিশাচী মন আমাদের, যেটা খুব সুন্দর করে আমরা জামা কাপড় শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে ঢেকে রাখি। কেউ কেউ পোষ মানিয়ে রাখি। কিন্তু সময় অসময়ে বেরিয়ে আসে । যে লোকটা মারছিল রাজনকে, যে লোকটা ভিডিও করছিল, যে লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছিল এরা সবাই পিশাচরুপী মানুষ। গ্ল্যাডিওটরের যুগ যায় নি, শুধু রুপান্তর ঘটেছে স্থান আর প্রকৃতির।

পড়াশুনা জানা মায়ের প্রেমিক তার বাচ্চাকে মেরে ফেলে, মা সেই মৃতদেহের টুকরো ফ্রিজে রেখে দেয়। মেয়ের প্রেমিক পছন্দ হয় নি বলে বাবা মেয়েকে সুপরিকল্পিত ভাবে খুন করে এবং ধরার পর কোন অনুতপ নেই। প্রথমটা বাংলাদেশের , ঢাকার ঘটনা। দ্বিতীয়টা কানাডার। সারা বিশ্ব জুড়ে পিশাচের আনাগোনা। সভ্যতা এসেছে, কিন্তু পশুত্ব এখনও যায়নি।

কেন মানুষ এইরকম হিংস্র হয়? পিশাচ হয়? আগে মানসিক রোগীকে পিশাচ বলা হত, পুড়িয়ে মেরে ফেলা হত, কিন্তু পিশাচ তো আসলে আমরা সাধারণ মানুষরাই। যারা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করি, হেসে হেসে খুন করি, বিকারহীন ভাবে খুন করি। ধীরে ধীরে পিশাচদের দেখতে দেখতে, লাই দিতে দিতে আমরা নিজেরাও সেইরকম হিংস্র হয়ে যাচ্ছি।

শিক্ষা, মূল্যবোধ আমাদের সভ্য করেছে, কিন্তু মানুষের ভিতর অমানুষকে মারতে পারে নি, যেটা পারে রাষ্ট্র। যেটা পারে আইন। যেটা তখন পেরেছিল গ্লাডিওটরের যুগে। লড়াকু গ্লাডিওটররা একদিন সংঘবদ্ধ হয়ে, মানুষের ভিতর সামাজিক চেতনা বাড়িয়ে দিয়ে , যুদ্ধ করে একদিন বন্ধ করেছিল সেই পৈশাচিকতা।

আমরা গ্ল্যাডিওটরের যুগের পিশাচ হয়েই আছি, আরও ভয়ানক ! শিক্ষিত পিশাচ! তাই আমাদের আরও লড়াকু, আরও নির্ভীক, ইন্টেলেকচুয়াল গ্ল্যাডিওটরদের দরকার, যারা বাঁধ ভাঙ্গবে এই সবকিছুর। আমাদের ভিতরের অমানুষকে মেরে ফেলে, মানুষটাকে জাগাবে।