আমাদের মোহন, আমাদের কীবোর্ড

মারজিয়া প্রভা
Published : 30 Sept 2015, 09:11 PM
Updated : 30 Sept 2015, 09:11 PM

সময়টা খুব অস্বস্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করি এবং এই দেশে এখনও রয়ে গেছি তাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে যাচ্ছে " এটা লেখা ঠিক না, এটা এইভাবে না ওইভাবে লিখ"। এখন সরাসরি তীক্ষ্ণ কথা বলতে আমাদের হাজারবার চিন্তা করতে হয়, সোজা কথা ঘুরিয়ে বলাটাই যেন স্বস্তি। তোমার বলাও হল, লোকের অহেতুক অনুভুতিতে লাগল না। আমি পাতি লেখক, সেই আমিই আমার জায়গা থেকে ভাবি, একটা মানুষের মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ধরে তাকে বলা হল " নিঃশ্বাস নাও", এর চাইতে বড় কৌতুক আর কি হতে পারে ?

আমাদের লেখনী সত্ত্বা ৫৭ ধারা নামক প্রহসনের ঠ্যালায় আজ বিপর্যস্ত। অপরদিকে আইজি কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর " সীমা অতিক্রম" না করার নির্দেশ! এইসব কিছু ছাপিয়ে তবুও ভেবে বসেছিলাম এই দেশে ৫৭ ধারার বহু আগেই মানুষের বাকস্বাধীনতার চর্চা হয়েছে, তাই এত সহজে হয়ত মানুষের লেখা আর বলার স্বাধীনতা এইভাবে হুমকির সম্মুখীন হবে না। কিন্তু আমি হয়ত ভুল ছিলাম।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর মোহন কুমার মণ্ডল এবং আজ এক স্কুলছাত্র দিপু বিশ্বাসকে ধর্মীয়অনুভূতিতে আঘাত হানা সম্পন্ন লেখার জের ধরে গ্রেফতার করা হয়েছে ! তখন আমি ভাবতে বসি এ কেমন আইন, কিংবা কাদের জন্য আইন ? আমার বোধগম্য না !

পুণ্যার্থীরা যখন পুণ্যস্নানের ভিড়ে মারা যায়, তখন একবার স্ক্রিনশট দিয়েছিলাম ফেসবুকে । প্রত্যেকটা কমেন্ট ছিল হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করা, তাদের দেবতাকে গালাগালি করা! ৫৭ ধারা তখনও ছিল, কেউ গ্রেফতার হয় নি! আজ স্বাধীনদেশে আমার বন্ধুর মা কে শুনতে হয় " মালাউনের বাচ্চা"! নাহ! কোন আইন আরোপ করা হয় নি ! বিগত বছরগুলোতে দুর্গাপূজার মণ্ডপ পুড়ানোর অপরাধে দুষ্কৃতিরা কোন আইনের আওতায় পড়ে শাস্তি পায় নি! আইন তাহলে কার জন্য ?

মোহন মিনায় বহুসংখ্যক হাজি মারা যাবার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছিল। আমরা প্রত্যেকেই জানিয়েছিলাম। তার ভাষাটা ছিল একটু অন্যরকম

"শয়তানকে পাথর মারার জন্য এত মানুষের লাশ, লাশের স্তুপ দেখে মনে হচ্ছিল লতিফ সিদ্দিকি ভাই ঠিক বলেছিলেন। তবে সৌদি কতৃপক্ষ ভাল বিহেভ করে নি , ২টি দরজা বন্ধ করে দিল, সেটা হাজীদের জানান হয় নি কেন ? কিন্তু একটা কথা মাথায় ঢুকে না, শয়তানকে পাথর মারার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মিনায় যেতে হবে কেন । আমার আপনার বাড়ির পাশে শয়তানকে একটা পাথর মারুন না"।

এই স্ট্যাটাসের পরপরই তাকে মেসেজে কমেন্টে আক্রমণ করা হয় যে সে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। মোহন সবার কথাকে সম্মান জানিয়ে ২৪ মিনিট পর স্ট্যাটাস মুছেও দেয়, মুছে ফেলার পাচ মিনিট পর তাকে মুছে ফেলা স্ট্যাটাসের জের ধরে গ্রেফতার করা হয়।

আর দিপু বিশ্বাস তো একটা নবম শ্রেণি পড়ুয়া বালক, সে নিজেই এইসব আইন আর আইনের প্যাঁচ বুঝে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে ! হয়ত তার মন ধর্ম নিয়ে যা সায় দিয়েছে, তাই বলেছে। কীবোর্ড যে আস্তাকুড়ে রাখার জিনিষ তার বুঝতে আরও সময় লাগবে !

প্রবির সিকদার, মোহন কুমার মণ্ডল, আজকের স্কুলছাত্র দিপু বিশ্বাস প্রত্যেকেই সংখ্যালঘু ধর্মের অনুসারী! ৫৭ ধারা কি সংখ্যালঘুর জন্যই খালি ? আমার ফেসবুকে হাজার মৌলবাদে অন্ধ মানুষদের দেখেছি, যারা সংখ্যালঘু ধর্মালম্বীদের দিনের পর দিন নোংরা মন্তব্য করে যাচ্ছে, একবারও তো তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না ! কিন্তু কেন ? তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের রিপ্রেজেন্ট করছে বলে ?

মাসখানেক আগে কোন দম্পতি দুই ধর্ম পালন করেছিল, পুজা এবং নামাজ উভয়ই ! তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়, ধর্মীয়অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য। একজন মানুষ কি বিশ্বাস করবে, কিভাবে নিজের বিশ্বাস পালন করবে, কোন আচারে, তা দেখার দায়িত্ব আজকাল কি সমাজ নিয়েছে ? কবে থেকে মানুষের নিজস্ব জীবনধারা এইরকম "অন্যের দ্বারা নির্ধারিত" হয়ে পড়ল ?

সৌদি আরব প্রতিবছর আট বিলিয়নের মত টাকা উপার্জন করে এই হজ থেকে। আমাদের দেশ থেকেও কোটি কোটি টাকা যায় এই হজ মৌসুমে। তাই সৌদি কতৃপক্ষের সম্পূর্ণ দায়ভার থেকে যায় এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য ! তাদের প্রতি সেইরকম কট্টর সমালোচনা হচ্ছে কই ! নাকি " সৌদি আরবে হজে মৃত্যু পুণ্য" সেই খাতিরে কোন আলোচনা হবে না ! তা বাদ দিয়ে, আমার দেশের কোন মানুষ ঈমানদণ্ডে আঘাত হানল সেই নিয়ে চল চেঁচাই ! তাই কি ?

ধর্মীয়অনুভূতিতে আঘাত হানা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকে না। কেন সৌদি আরবে মিনায় এতগুলো লোক যোগ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রাণ হারাল, কেন ধর্ম পালন করতে গিয়ে মিছে প্রাণ হারান, আমাদের ধর্মীয়অনুভূতিতে লাগে না ? "ধর্মীয় বৃথা আস্ফালন রীতি-নীতি" কে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে কেন আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে লাগে ? আমি তো দেখেছি বেগম রোকেয়া কে নিয়ে উল্লাস , নারীদের চাকরি করা, পহেলা বৈশাখের প্রতিবাদে রাস্তায় নামা, সবেতেই কারও না কারও ধর্মীয়অনুভূতিতে লাগে ! এই দায় কি আমার ?

উত্তেজনা তোমার , আর তাই আমার মানা সেসব নিয়ে লেখা! কি আজব কারখানা!

গুলশানে ইতালীয় এক ব্যাক্তির হত্যা জানিয়ে দিয়েছে আইএস এই দেশে গোঁড়াপত্তন করছে, দেশকে বাংলাস্থান বানানোর অভিপ্রায়ে ! ৫৭ ধারা কুলুপ এঁটে দিয়েছে আমার কীবোর্ডে ! মোহন দিপু জেলে, কেউ যদি এগিয়ে এসে এদের পক্ষে হাল না ধরে আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের কথা বলাও বন্ধ হয়ে যাবে ! সরকারের অসচেনতায় বা কিছুটা পরোক্ষ সায়ে জঙ্গিবাদ উত্থানে দেশ সিরিয়া হবে ! বাংলাদেশ হারিয়ে যাবে ! কীভাবে বাঁচব আমরা ! শুধু ধর্মের নিষ্প্রাণ আচার নিয়ে কি বাঁচা যায়, জীবনের অন্য কোন গল্প যদি নাই থাকে ?

Sylettoday24.com এ প্রকাশিত ।