’বাংলাদেশে আমি ৪ থেকে ৫ টাকার প্যাড করেই যাব’

মারজিয়া প্রভা
Published : 5 Dec 2015, 05:22 PM
Updated : 5 Dec 2015, 05:22 PM

হ্যাপি ব্লিডিং নিয়ে শুরু হয়েছে মেয়েদের এক অন্যরকম আন্দোলন। পাশের দেশের ভারতে ৬ থেকে ৬০ বছর বয়সী মেয়েদের মন্দিরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এক রাজ্য, কারণ কোন মেয়ে যদি তার মাসিকের খবর লুকিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে! দীর্ঘদিন ধরে ঋতুমতী মেয়েদের অশুচি, অপবিত্র বলে গণ্য করা হয়। তারও বাইরে মেয়েরা নিজেদের মাসিকের কথা কাউকে বলতে চায় না। আজ যখন হ্যাপি ব্লিডিং নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তখনও ছেলেদের তীক্ষ্ণ কথার স্বীকার হচ্ছে মেয়েরা।

অথচ ৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের মেয়েদের মাসিক আর স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড নিশ্চয়তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে অপরাজেয় বাংলাদেশ এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ওয়াহিদা বানু আপু। এদেশের মেয়েরা এখনও অস্বাস্থ্যকর ভেজা কাপড় ব্যবহার করে, যাতে থাকে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে অপরাজেয় বাংলাদেশের মেয়েদের নিজ হাতে প্যাড বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশী প্যাডগুলোর দাম যেখানে ১০০ টাকা, সেখানে এই প্যাডের ব্যবহারে দাম পড়বে ৪০ টাকা। মেয়েদের বানান এই স্যানিটারি ন্যাপকিন, তা বাণিজ্যকরণ নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা অপারজেয় বাংলাদেশের অফিসে বসে ওয়াহিদা আপুর মুখ থেকে শুনলাম । সাক্ষাৎকারটি আমার ব্লগ FeminismBangla- ফেমিনিজমবাংলা প্রকাশিত।

আপু, পিরিয়ড নিয়ে লড়াই

জানো কি না জানি না, ৯৮ থেকে আমি মাসিকের বিষয় নিয়ে আছি। ৯৮ এ বন্যাতে রিলিফ অপারেশনে গেলাম। পানিতে সব ডুবে গেছে। ঘরে ঘরে যেতাম, মহিলাদের সাথে কথা বলতাম । " খুব কষ্ট তাই না?" তারা বলত " এমন অনেক কষ্ট আফা, মানুষকে কওয়া যায় না, রক্ত যাইতেছে, যাইতেছে, কাপড় শুকাতে পারি না। কাপড় বাইরে শুকালে স্বামী যদি দেখে অন্ধ হয়ে যাব , আয়ু কমে যাব তার । ওইসব ন্যাতা দিয়ে গ্রামের মানুষ তাবিজ করবে"। আমি তাজ্জব হয়ে যেতাম। বলতাম " এটা তো আল্লাহ দিছে আপনারে, এটা না হলে মা হবেন না। এক মাস বন্ধ থাকলে স্বামী শ্বশুর বাড়ির মাথা খারাপ হবে। অথচ এই যে ভেজা কাপড় জড়ায় রাখছেন এতে তো রোগ হবে"। উনাদের কথা এই যে আমরা টাউনের মানুষ, বড় বড় কথা বলি। কিন্তু ওখানে সবাই যা মানে, বিশ্বাস করে তাই মানতে হবে, না মানলে তারা হবে উশৃঙ্খল।

তারপর?

এরপরএই আমি স্বপ্ন দেখতে লাগলাম যদি বাংলাদেশে ২ টাকা থেকে ৪ টাকার স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া যায় এরা বেঁচে যাবে। সেই লক্ষে ইতালি এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তাঁরা ডোনার দিতে পারবে কিনা। তো ওদের TDH নামে একটি অর্গানাইজেশন বলল মেশিন দিবে, মেশিনের দাম ১৪ লক্ষ টাকা। ওদের সঙ্গে যেটা সমস্যা হল, ওই মেশিনে আমাদের দেশীয় পণ্য ব্যবহার করা যাবে না। ওই দেশ থেকে কাঁচামাল আনতে হলে আমার দাম বেশী পড়েই যাবে। তাই সময় এবং এনার্জির অপচয় করার মানে নেই। তাই সেটা বাদ দিলাম। এরপর অনেক জায়গায় আসলে চেয়েছি ডোনার। জাপানে ফান্ড রাইসেস এর জন্য গিয়েছি ওদের বলেছি মেশিন বানিয়ে দাও , স্যানিটারি প্যাড বানাব। শুনে সব পুরুষ হেসেছেও। ইন্ডিয়ান এক সায়েন্টিস্ট ভদ্রলোককে চিঠি দিলাম মেশিনের জন্য।

কোনটাই ক্লিক করছিল না ?

ক্লিক করছিল না তা না। দেখ ২০০৬ সালে চাইনিজরা আমার জন্য মেশিন বানাতে আগ্রহ হল। কয়েক দফা সিরিজ মিটিং হল। আমার প্ল্যানিং ছিল আমার দেশের ম্যাটেরিয়াল দিয়ে প্যাড বানাব। সারাদেশে গাদা গাদা ঝুট আছে সেগুলো সহজে রিসাইকেল করে র ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহার করব। সেই ফ্যাক্টরিতে দেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কাজ করবে। তাদের মাধ্যমে তাদের পরিবারের কাছে যাবে । মেয়েরা, মায়েরা বুঝবে প্যাড ইউজ করার মজা, আরাম। এভাবেই cost effective প্রোডাক্ট আমরা পাব

পরে ?

ওরা আমাকে দু'তিনটা মেশিনের স্যাম্পলও দেখাল , যে কী কী রকমের স্যানিটারি ন্যাপকিন হতে পারে, আবার ওই মেশিন দিয়ে বাচ্চাদের ডায়াপারও তৈরি হতে পারে ।মেশিনের দাম ১ কোটি টাকা চাইল, ৬০ লাখ একবারে পেমেন্ট করতে হবে। টাকা প্রবলেম ছিল না, ছিল প্রতিদিন মাত্র ২৫০ টা স্যানিটারি ন্যাপকিন বানাতে পারব। অন্য শিফটে ডায়াপার বানাতে পারব। চারজন মানুষ লাগবে, সুইচ টিপলেই হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, আমাদের দেশের ম্যাটেরিয়ালও ইউজ হবে না। তো আমি আর আগালাম না। এখনও ওরা মেইল করে, এই টাইপ মেশিন তৈরি করেছি । এই এই সুবিধা। কিন্তু প্রব্লেম ওই, আমার ড্রিমের সঙ্গে মেলে না ।

ড্রিম?

হ্যাঁ আমার প্যাড নিয়ে লড়াইয়ের পাশাপাশি স্বপ্ন হচ্ছে এটা একটা ফ্যাক্টরি হতে হবে, দেশীয় জুট ব্যবহার হবে কাঁচামাল হিসেবে, ছেলেমেয়ে কাজ করবে। কিন্তু সেগুলো সম্ভব হচ্ছিল না। ওদের মেশিন পিপল অরিয়েন্টেড ছিল না। তার উপর ওই মেশিন ব্যবহার করার জন্য ওদের একজন এক্সপার্ট লোককে রাখতে হবে, যাকে সারা বছর খাওয়া দাওয়া করাতে হবে। এভাবে কি করে cost meet up সম্ভব ?

দেশে এই ব্যাপার নিয়ে কি কোন সাহায্য পাচ্ছিলেন না?

আমি BGME র এক প্রোগ্রামে গার্মেন্টসের মেয়েদের সুযোগ সুবিধা নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তখন আমি বলেছিলাম ২৪ লক্ষ মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে, তাদের প্রত্যেককে বেতনের পাশাপাশি স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হবে, ওই মেয়েরা তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের মাদের বলবে, এভাবে অন্য মেয়েরা জানবে। এক বছরেই আমাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন চলে যাবে ১ কোটি মেয়েদের কাছে । তো এই প্রোগ্রামের পর অনেকেই আমাকে বলেছে " চলেন এই কনসেপ্ট নিয়ে আমরা আলাদা বিজনেস করি"। কিন্তু আমি ব্যবসা করব না, সম্পূর্ণ সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি থেকে কাজটা করতে চাই। তাই নিজেই আমি ছয়জন পার্টনার ঠিক করি। বাজারে যেসব প্যাড আছে, তার স্যাম্পল নিয়ে এলো তারা, ওগুলোর দাম নিলাম, ক্যালকুলেশন করলাম। কোনটার প্যাকেটই ১০০ টাকার নিচে না, সব মেয়ের পক্ষে সেটা affordable ও না ।

অপরাজেয় বাংলাদেশ মেয়েদেরকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানানোর প্রশিক্ষণ?

অপরাজেয় বাংলাদেশ পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে। আমরা এখানে প্রত্যেক শিশুকে রিপ্রডাক্টিভ হেলথ, এইচআইভি প্রভৃতি নিয়ে সেমিনার করি, ক্লাস করি, শিক্ষা দেই। বলি ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা পর পর প্যাড বদলানোর কথা। এরাই যখন মেইন্সট্রিম স্কুলে যায়, তখন নিজেরাই সে স্কুলে বাচ্চাদের এই বিষয়ে ধারণা দেয়, যেটা টিচাররা পর্যন্ত এড়িয়ে যায়। তো ওদের নিয়ে ২-৩টা ওয়ার্কশপ করলাম। কনসেপ্ট নোট করলাম, ড্রাফ্‌ট করলাম, দেখলাম ২০ টাকার নিচে হলেও এক প্যাকেট প্যাড সব ক্লাসের কাছে খুবই সহজলভ্য। তো এরপরই ওরা কাজে লেগে গেল। স্কুল থেকে ফিরে এসে ১ ঘণ্টা আনন্দ, গান , নাচ ,খেলাধুলা করে, এর পাশাপাশি আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা প্যাড বানানোর কাজ করে।

প্যাড তৈরিতে ওরা কি ব্যবহার করছে ?

তুলা গজ দিয়ে প্যাড বানাচ্ছে, সেলাই করছে চারপাশ, তারপর ইলাস্টিক লাগাচ্ছে।

প্রতি প্যাড বানাতে কেমন খরচ পড়ছে ?

প্রতি প্যাডে ৪ টাকা। তাহলে এক প্যাডে ১০ টা প্যাড থাকলে, এক প্যাকেটের দাম হয় ৪০ টাকা। ওরা শুধু এক শেপেরই বানাচ্ছে না। অভাল বানাচ্ছে, বড় , ছোট সব রকম নিজেদের প্রয়োজনে বানাচ্ছে।

নিজেরাই নিজেদের বানানো প্যাড ইউজ করছে ?

আমি তাদেরকে সেলফিশ হতে মানা করেছি। তাই তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য প্যাড বানাচ্ছে। নিজেদের ড্রয়ার আছে আলাদা আলাদা প্রত্যেকের, সেখানে সেগুলো রেখে দিচ্ছে। যাতে প্যাডে তেলাপোকা, ইঁদুর বা অন্য ময়লা না পড়ে।

ছেলে মেয়ে সবাই প্যাড বানাচ্ছে ?

ওয়ার্কশপে ছেলে মেয়ে সবাই থাকে। কিন্তু প্যাড শুধু মেয়েরাই বানাচ্ছে, কিন্তু ছেলেরা সবই জানছে। কারণ এরাই পরে কারও বাবা, ভাই, বন্ধু হবে। সাইন্টিস্ট হবে। এরা নিজেরা আরও ভাববে, চিন্তা করবে, মা বোন কিংবা বন্ধুর জন্য আরও কত cost effective প্যাড বানান যায়।

বানান প্যাড কতটা স্বাস্থ্যসম্মত , যেহেতু হাতের ব্যবহার হচ্ছে, যন্ত্র ছাড়া?

নোংরা ভিজা কাপড় ইউজ করার থেকে ফ্রেশ তুলা গজের বানান প্যাড ৯৮% হাইজেনিক। তাছাড়া গাইনি ডাক্তারদের দিয়েও দেখান হয়েছে। তাঁরা এটাকে স্বাস্থ্যসম্মত বলে রেফার করেছ। দেখ, মাত্র ১২% ইন্ডিয়ান প্যাড ইউজ করে। বাকিরা শুকনা পাতা, ভুষি কাপড়ে বেঁধে ইউজ করে। আমাদের দেশের এই মেয়েগুলো তাদের চাইতে অনেক বেশী স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ইউজ করছে। যেগুলো ইকো-ফ্রেন্ডলিও পাশাপাশি। সহজে মাটির সঙ্গেও মিশে যায়।

প্যাড নিয়ে সবার আগ্রহ?

আমার মেয়েগুলো ক্লাসে যাচ্ছে, ফ্রেন্ডদের বলছে, ওরা আগ্রহ পাচ্ছে। এখন এসে বলছে ওদের ফ্রেন্ডরাও প্যাড চায়। এভাবে ওই ফ্রেন্ডগুলোর পরিবারে আর মেয়েরা জানবে। সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াতে আমার কোন চিন্তা নেই। আমার অপরজেয় বাংলাদেশ এর মেয়েদের নিয়ে আমার যথেষ্ট ভরসা আছে, এরা একজন প্যাড বানান শিখে গিয়েছে, সেটা যদি সবার মাঝে সচেতনতা করতে বলা হয়, একটি এলাকার জন্য আমার এক মেয়েই যথেষ্ট।

বাণিজ্যকরণের কোন ভাবনা নেই ? দেশের সব মেয়েদের কাছে এই কম দামের প্যাড পৌঁছে দেওয়ার ?

আমি বলেছি অনেককে, এখন প্যাড বানান শিখে গেছি, আমাকে মেশিন দাও। আমার মেয়েরা আমাকে বুদ্ধি দেয়, আমরা যত তুলা এক প্যাডে ইউজ করি, তা দিয়ে দুইটি প্যাড ইউজ হয়। তারা নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজন মত, কতটুকু ব্লাড যায়, সেই অনুযায়ী ছোট বড় শেপের প্যাড ইউজ করে। অনেকের কাছে অফার পেয়েছি এক টন তুলা, বা এক টন ইলাস্টিক তারা কিনে দিতে প্রস্তুত। লটে যখন তুলা বা ইলাস্টিক কেনা হবে তখন প্যাডের দাম আরও কমে যাবে। মরার আগে বাংলাদেশে আমি ৪ থেকে ৫ টাকার প্যাড করেই যাব।

সবশেষে

লং টাইম ড্রিম আমার ৪-৫ টাকায় মেয়েরা এক প্যাকেট প্যাড পাবে। সবাই বলে এটা " ওয়াহিদা আপার ব্রেইন চাইল্ড"। আমি চাই সব মেয়ে কি ভিক্ষুক, কি গার্মেন্টস কর্মী, কি গ্রামের মেয়ে সবার জন্য প্যাড cost effective হোক। সবাই যেন প্যাড কিনতে পারে, জরায়ুমুখের ক্যান্সার সহ ভ্যাজিনার আরও আরও রোগ নিয়ে যেন সচেতনতা তৈরি হয় সবার মাঝে। এখন আমার কোন ভয় নেই, আমার মেয়েদের আমি শিখিয়ে দিয়েছি। আমি না থাকলেও ওরাই সাড়া দেশে জাগরণ সৃষ্টি করবে।আমার স্বপ্ন সত্যি করবে ওরাই। এভাবেই আগামী বানাব আমরা।