বুক রিভিউ: ‘ভারত মহাসাগর, ভারত-চীন দ্বন্দ্ব’

মাসুদ মিয়াজী
Published : 15 May 2022, 08:35 PM
Updated : 15 May 2022, 08:35 PM

আগামীর খেলার মাঠ ভারত মহাসাগর যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা 'ভারত মহাসাগর, ভারত-চীন দ্বন্দ্ব' বইটি না পড়লে অজানা থেকে যেত। যেদিন বইটি কিনবো চিন্তা করছিলাম কাকতালীয় ভাবে সেদিনই মুন্নি আপু উপহার দিলেন বইটি।

আন্তর্জাতিক বিষয়ের বইয়ের কথা আসলে আমাদের অনেকের কাছেই তারেক শামসুর রেহমানের বইগুলো আগে মনে পড়ে। তিনি গত দু'দশক ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। আন্তর্জাতিক নানা ইস্যূতে গণমাধ্যমে প্রায়ই উপস্থিত হতেন। গত বছর এক আকস্মিক সংবাদে জানতে পারি লেখকের প্রাণ বিয়োগের কথা।

ঘটে যাওয়া বৈশ্বিক বিষয়ে তার চিন্তার অংশীদার হওয়ার সুযোগ আর না থাকলেও তিনি যে কর্মযজ্ঞ রেখে গেছেন তা আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনুসন্ধিৎসু মস্তিষ্ককে প্রেরণা যোগাবে বহুকাল। বাংলাদেশের প্রতিবেশীদেশ নিয়ে লেখা লেখকের এই বইটি আমাদের অনেককেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব বুঝতে খুব সাহায্য করবে।

ভারত মহাসাগর নিয়ে এতটা আগ্রহ ছিল না। বরং ধারাবাহিক ভাবে জানার আগ্রহ বেশি ছিল সবদিকে জ্বলে উঠা চীন নিয়ে; সাথে প্রতিবেশি ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে।

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব নিয়ে বইটি লেখা হলেও এ দ্বন্দ্বের দ্বারা বাংলাদেশ যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে জড়িত তা ভালোভাবে নজরে এনেছেন লেখক তারেক শামসুর রেহমান। আসন্ন দিনে যুক্তরাষ্ট্র -চীনের কোনো যুদ্ধ হলে তা যে ভারত মহাসাগর নিয়ে হবে তা ধারণা করেছেন লেখক।

মার্কিন নৌ স্ট্র্যাটেজিস্ট আলফ্রেড মাহানের একটি ভবিষৎবাণী দিয়ে বইটি শুরু হয়েছে। মাহান বলেছেন, ভারত মহাসাগর যার আওতাধীন থাকবে সেই এশিয়ার নেতৃত্ব দিবে। বিংশ শতাব্দীর এই উক্তির মর্মকথা আজ একদম পরিষ্কার। চীন দ্রুতই এই বাণী উপলদ্ধি করতে পেরেছে, আর তাই সর্বকৌশলে জলে নেমেছে বিশ্ব জয়ের নেশায়। কারণ ভারত মহাসাগর শুধু এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দেবে না, এনে দিবে বৈশ্বিক আধিপত্যে বিস্তারের সুযোগ।

কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?

বইটিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৬০ ভাগ তেলের রিজার্ভ এ অঞ্চলে। রয়েছে ৩৫ ভাগ গ্যাস, ৪০ ভাগ স্বর্ণ, ৬০ ভাগ ইউরেনিয়াম এবং ৮০ ভাগ ডায়মন্ড। কিন্তু বিশ্ব ব্যবস্থার কর্তৃত্বের আসন চীনের হাতে ছেড়ে দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না আমেরিকা। তাই এ অঞ্চলের চীন বিরোধী শক্তিগুলোকে নিয়ে জোট করেছে যুক্তরাষ্ট্র, প্রধান শক্তি হিসেবে ভারতের সাথে মজবুত করেছে সম্পর্ক। এ অঞ্চলে চীনের জন্য ভারত কীভাবে তার প্রভাব হারাচ্ছে তা লেখক দেখিয়েছেন সহজভাবে। সাথে উঠে এসেছে পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে চীনের সরাসরি তৎপরতায় ভারত যে কতটা শংঙ্কিত।

এই গ্রন্থে উঠে এসেছে চীনের বিশ্ব নেতৃত্ব দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার তার অর্থনীতি। বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির চীন আগামীর এক নম্বর অর্থনীতির দেশ। চীন তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুক্ত করেছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, এটি চীনকে বৈশ্বিক সেরা শক্তি হতে অনেকাংশে সাহায্য করবে সাথে ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ। এ বইয়ে লেখক দেখিয়েছেন ৬৫টি দেশের সংযোগে বিআরআই কীভাবে চীনকে চালকের আসনে নিয়ে যাবে।

আর ভারতের অনীহা এ চীনা মহা উদ্যোগে, এ প্রকল্পে ভারতের অসহযোগিতা চীনকেও কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে। ভারতও তার প্রভাব বিস্তারে ভারত মহাসাগর তীরবর্তী সিচিলিস, মরিশাসে নৌঘাঁটি স্থাপনে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরানের চাবাহারে করেছে গভীর সমুদ্রবন্দর।

এ মহাসাগর নিকটবর্তীতে চারটি বিমানঘাঁটি রয়েছে ভারতের। অন্যদিকে জিবুতিতে চীনা নৌঘাঁটি, চট্রগ্রাম, মালদ্বীপ, কেনিয়া, ইরাক, সুদানসহ এ মহাসাগর ঘেঁষা ১৫টি সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করেছে চীন, যা চীনের মুক্তার মালা। বাদ যায়নি প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোও। এসব ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে।

এ সময়ের বহুল আলোচিত দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এ গ্রন্থে। এ সাগর নিয়ে গণমাধ্যমের নিউজ এখন কমন ব্যাপার। এটিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ, বলা হচ্ছে এ সাগরের নিয়ন্ত্রণই মূলত ভারত মহাসাগর তথা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ। কমপক্ষে নয়টি দেশ দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িত। নানা কারণে আকর্ষণীয় এ সাগরের রিজার্ভের সব তেল আয়ত্তাধীন হলে সমগ্র চীনের আগামী ৫০ বছরের জ্বালানি ঘাটতি হবে না।

লেখক তুলে ধরেছেন চীন বনাম ভারত তথা আমেরিকার এই দ্বন্দ্ব আসলে ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বনাম চীনের বিআরআই। বাংলাদেশ বিআরআই এর অংশীদার আবার যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিচ্ছে ইন্দো প্যাসিফিকে যুক্ত হতে। ইন্দো- প্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আছে ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া; এরা মূলত এ অঞলে চীনকে ঠেকাতে তৈরি হচ্ছে।

এছাড়াও চীনা ঋণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে এ গ্রন্থে। বিভিন্ন দেশ চীনা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছে এমনটার পাশাপাশি লেখক তুলে ধরেছেন কীভাবে চীন কোন কোন ঋণ মওকুফ করে দিয়েছেন সেটাও। আরও আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ।

আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলো নিয়ে লেখা এ গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে টপিকগুলো অনেকক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে সংশ্লিষ্ট। এগুলো আন্তর্জাতিক বিষয়ে আমাদের সচরাচর জানতে চাওয়া ব্যাপারগুলো উত্তর দিয়েছে।

এর মাধ্যমে তথ্য-উপাত্তের দ্বারা লেখক বোধগম্য করাতে পেরেছেন চীন ও ভারতের বিভিন্ন আচরণ। তবে দেশদুটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক দিক আলোচনায় আসলেও সাংস্কৃতিক দিক আলোচনায় নেই। ভারত অন্যদিকে পিছিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকার মত দেশে তার সাংস্কৃতিক বলয় তৈরী করেছে। এছাড়া রাশিয়া নিয়ে আলোচনা কম হয়েছে, কারো সাথে রাশিয়ার জোট অবশ্যই সেখানে নতুন সমীকরণ তৈরী করবে।

মোদ্দা কথা, এই গ্রন্থ শেষে আন্তর্জাতিক বিষয়ে আগ্রহীরা আগামীর বিশ্ব রাজনীতি পট পরিবর্তন সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন, সেই সাথে চীন ও ভারতের ভবিষ্যতের অনেক ঘটনা বুঝার রসদ যোগাবে এটি। আশা করি আগ্রহীদের আন্তর্জাতিক জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে এই বই।

বইটি ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে শোভা প্রকাশ থেকে। ২৩৭ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৩৫০ টাকা।