রাজনীতিতে ’বেনিফিট অব ডাউট’ তথা মিথ্যাচারের চর্চা বন্ধ হোক

মাসুদ সজীব
Published : 5 Nov 2016, 04:20 PM
Updated : 5 Nov 2016, 04:20 PM

'ইসলাম অবমাননার' অভিযোগ তুলে গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক ঘর ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সংঘবদ্ধ এ হামলার পরে অনলাইন-অফলাইনের ছোট্র পরিসরে সেটি আলোড়ন তুুলেছে। যদিও এ ধরণের হামলা ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের দেশে নতুন কিছ নয়, বরং প্রতিনিয়ত ঘটছে এসব ঘটনা। ফলে এমন ঘটনাগুলো সর্বত্র খুব বেশি আলোড়ন তুলে না। নাসিরনগরের ঘটনার পরপরই যশোর, বগুড়া, ফরিদপুরে ও একই ধরণের ঘটনা ঘটেছে। হামলা হয়েছে হবিগঞ্জের পরে সুনামগঞ্জের ছাতকে, ঠাকুরগাঁওয়ে নেত্রকোনায় । এ যেন উৎসবের আমেজে সারাদেশে হিন্দুুুদের প্রতিমা ভাঙ্গচুুর, ঘর বাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। সেই আমেজকে আরো রাঙাতে আবারও দ্বিতীয়বারের মতো নাসিরনগরে হামলা চালানো হয়েছে, এবার আগুন দিয়ে উৎসব পালন করা হয়েছে ! একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখবো, গত সাত-আটবছরে এটি নিত্যকার ঘটনা হয়ে গিয়েছে আমাদের জন্য। তবে নির্বাচন ব্যতিত এভাবে সারাদেশে একযোগে হঠাৎ করে হামলার দৃষ্টান্ত নেই বললে চলে। এর উপর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার স্থানীয় প্রশাসন আর সাংসদের আচরণ আর দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মের জন্য চারিদিকে কিছুটা ক্ষোভের জন্ম হয়েছে । অনলাইনে এ ক্ষোভ যতোটা না ভিন্নসম্প্রদায়ের মানুষের উপর অন্যায়ের বিচারের প্রত্যাশায়, তার চেয়ে বেশি সেই এলাকার সাংসদ এবং মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর পদত্যাগে গিয়ে ঠেকেছে। এ ঘটনাগুলোর বিচার না হয়ে মন্ত্রীর পদত্যাগে কি আসে যায়? ছায়েদুল হকদের তো ঘাটতি নেই দেশে !

এমন ক্ষোভের সময়টিতে অনলাইনে কিংবা অফলাইনে বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ক প্রগতিশীলদের নানান আলোচনায় দুুুটো বিষয় খুব স্পষ্ট ভাবে সামনে উঠে আসে। প্রথমটি হলো, যে দেশের জনগণ যেমন সে দেশের সরকার ও তেমন হয়। দ্বিতীয়টি হলো, সাম্প্রদায়িক ঘটনায় দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবি সমাজ, নাগরিক সমাজ কেন চুপ থাকে? কেন সবাই প্রতিবাদ করে না? তাদের চুপ থাকার জন্যই এমন অপরাধ বারবার ঘটে ।

একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রায় দুটো মতেই বেশিরভাগ দোষ শিল্প-সাংস্কৃতিকমনা মানুুষ থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সব শ্রেণীর জনগণ বাংলাদেশের সব বড় অপরাধের জন্য দায়ী ।

(১)
প্রথম যে মতটি এ দেশের বেশিরভাগ প্রগতিশীল মানুষ দিয়ে থাকে সেটি আমার কাছে সুকৌশ মিথ্যাচার মনে হয়। এবং এ মিথ্যে কোন না কোনভাবে নিদিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে জন্ম হয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে কেন এটি মিথ্যে কিংবা কেনইবা এই উক্তিগুলো কোন রাজনৈতিক দলের জন্য বেনিফিট অব ডাউট হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে দাবি করছি ?

আমরা জানি, ন্যায়-আদর্শ-সাম্যতা এগুলোর সাথে সংখ্যাধিক্য আর সংখ্যালঘুর কোন সম্পর্ক নেই। এবং গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্র চলে/পরিচালনা করতে হয় সাংবিধানিক কাঠামোর ভিত্তিতে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চরিত্রের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের চরিত্র গঠিত হতে পারে না কিংবা রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না। ধরা যাক একটা রাষ্ট্রের বেশিরভাগ মানুুষ অন্যায় করে, চুরি করে, এখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে অন্যায় করা, চুরি করা কে কি রাষ্ট্র বৈধতা দিবে? দিতে পারে?

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতেই যদি রাষ্ট্র তার নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করতো, তাহলে আমেরিকায় কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো না, আমাদের ৭২র সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আসতো না। এগুলো কোনটার পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিলো না। ন্যায়, আদর্শ, নীতি এগুলো কখনো সংখ্যার উপর নির্ভর করে না। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেমন হবে তার রাষ্ট্র ও তেমন হবে এটি একটি মিথ্যাচার। পৃথিবীর কোথায় মানুষে-মানুষে বিদ্বেষ নেই, ধর্মীয় সংকীর্ণতা নেই? আমেরিকায় আছি আজ প্রায় দু বছর, আমি তো প্রতিনিয়ত দেখি এখানে সাদা-রা কালোদের, কালো-রা সাদাদের জন্য চোখের কোণে কি পরিমাণ ঘৃণা পুষে রাখে। আবার নেটিভ আমেরিকানরা মেক্সিকানদের, এশিয়দের ও সেই চোখে দেখে। তবু ও সেই ঘৃণার বহি:প্রকাশ নেই। কেন? কারণ, তাদের আইন, শাসন ব্যবস্থা। আমেরিকা একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র, সেখানে পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্রের, সকল ধর্মের মানুষ থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে সেখানে এতটুকু অপরাধ করে আপনি বাঁচতে পারবেন না। আপনি যে ধর্মের হোন, যে দেশ থেকেই আসুন না কেন, আপনি আইনের শাসন পাবেন।

একটি সত্য ঘটনার উদাহারণ দেই। আমার ভাগিনা-ভাগ্নি থাকে আমেরিকায়। ওরা জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক। ৯/১১ এর পরে আমার ভাগ্নি তার ক্লাসে একদিন ধর্মবিদ্বেষী আচরণের শিকার হলো। ঘটনাটি ছিলো এমন, ক্লাসে একমাত্র সে হিজাব পরে যেত। ফলে সহজেই সবাই বুঝতো ও মুসলমান। একদিন তার ক্লাসের এক শিক্ষক বলেছিলো 'আমেরিকায় যে হারে মুসলমান বাড়ছে তাতে কিছুদিন পর আমাদের কে মেরে তারা আমেরিকা দখল করে নিবে'। শিক্ষকের এমন কথার পর ক্লাসের সকল শিক্ষার্থী তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ও কিছু বলে কি না। বয়স অনেক কম (১১ বৎসর) হওয়ায় সে কিছু বলতে পারেনি কিন্তু প্রচন্ড অপমানিত হয়েছিলো। সে প্রতিবাদ করতে পারেনি কারণ তখন মুসলমান-খ্রিষ্টান-ইহুদি এগুলোর ভালো-খারাপ বুঝতে শিখেনি। বাসায় এসে সে প্রচন্ড মন খারাপ করে, এবং আব্বুকে বলে আচ্ছা আব্বু 'মুসলমানরা কি খুব খারাপ?' দুলাভাই প্রথমে তার মতো করে বুঝিয়েছেন, যে সকল মুসলমান খারাপ না। কিছু মুসলমান খারাপ, যেমন খারাপ সব ধর্মেই থাকে। অল্প কিছু খারাপের জন্যে একটা ধর্মের সকল মানুষকে খারাপ বলা যায় না। তার পরের দিন দুলাভাই সে স্কুলে গিয়েছিলেন, স্কুল প্রধানের কাছে বিচার দিয়েছেন ঘটনার। প্রধান শিক্ষক ভাগ্নি কে ডেকে ক্ষমা চেয়েছেন এবং ওই শিক্ষক কে চাকরিচ্যুত করেছেন।

মৌখিক ধর্মবিদ্বেষের ঘটনায় শাস্তি হবে এমনটা কি কোনদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে কল্পনা করা যায়? যায় না, এখানে হিন্দু-বৌদ্ধদের বাড়ি-ঘরে আগুন দিলে, ধর্ষণ করলেও বহাল তবিয়াতে থাকা যায়। অপরাধ করে ছাড় পেলে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রের মানুষ অপরাধ করবে না? দোষটা তাই জনগণের না, দোষ রাষ্ট্র পরিচালকদের। সুতরাং এটি স্পষ্ট করেই বলা যায় একটি রাষ্ট্র যেমন হয় তার জনগণও ঠিক তেমন হয়, জনগণের চরিত্রের উপর রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ভর করে না, বরং রাষ্ট্রের চরিত্রের উপর নির্ভর করে জনগণের চরিত্র নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্র অপরাধীর শাস্তি দিতে পারলে সে রাষ্ট্রে অপরাধ কম হবে, আর রাষ্ট্র শাস্তি দিতে না পারলে সে রাষ্ট্রে অপরাধ বাড়তে থাকবে।

এখন আসি বেনিফিট অব ডাউট প্রসঙ্গে। এইযে জনগন যেমন নেতাও তেমন হয় , এই কথাটি শুধু মাত্র শুনা যায় নিদিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের অপরাধ/ব্যর্থতার আলোচনা প্রসঙ্গে। আমরা অন্যদল/জোট কে আগে থেকেই যেহেতু সাম্প্রদায়িক জেনেছি/মেনে নিয়েছি তাই যাদের কে অসম্প্রদায়িক জানি তাদের উপর যাতে সরাসরি দোষটা না আসে সে জন্য সব দোষ কৌশলে চাপিয়ে দেই জনগণের ঘাড়ে! মরলে মরুক আমজনতা তবু দলের গায়ে যেন আঁচড় না লাগে।

(২)
সুশীল-বুদ্ধিজীবী এ দুটো এখন ভীষণ নেগেটিভ অর্থে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। কেন সেটি খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হয় সেটি নিয়ে এ লেখায় আলোচনা করতে চাইছিনা। আমার মূল ফোকাস হলে সাম্প্রদায়িক হামলায় কেন সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করছে না এমন দাবি করা হয় আর কেনই বা তাদের নীরব থাকার জন্য এমন ঘটনা ঘটছে বলা হয়?

অসংখ্য ছোট ঘটনার কথা বাদ দিলাম, শুধু কক্সবাজারের রামুর কথাই বলি। রামুতে যখন সাম্প্রদায়িক হামলা হলো তখন তো প্রায় সব মহল থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে! আমাকে একটু বলেন তো সেই ঘটনায় কয়জনের সাজা হয়েছে? একজনেরও সাজা হয়নি, তাই না? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ কিংবা নীরবতায় কি আসে যায়?

এবার আসুন গুলশান হামলায়! এখানে সুশীল, বুদ্ধিজীবী সমাজ কিংবা সাধারণ জনগনকে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে হয়নি, সরকার নিজ থেকেই সব জঙ্গিকে খুঁজে বের করেছে, মেরেছে! একি ভাবে বিএনপি-জামাত সরকারও তাদের ক্ষমতার সময় যখন দেখেছে বাংলাভাই আর শেখ আব্দুর রহমান-রা তাদের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে ঠিক তখনি তাদের গ্রেফতার করেছে এবং বিচার করেছে। তার আগে সবকিছু অস্বীকার করে গেছে।

সুশীল-বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ জনগণের প্রতিবাদের গুরুত্ব কতটুকু সেটি বুঝাতে উপরের উদহারণগুলোই যথেষ্ট, অনেকবেশি উদহারণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই বোধহয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সরকারগুলো মনে করছে কোন ঘটনা তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি না, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণের সরবতা কিংবা নীরবতায় তার/তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ সরকার জানে দুই-চারদিন কিংবা এক সাপ্তাহ বড় জোর একটা ঘটনার রেশ থাকবে, এর মাঝেই আরেকটি বড় ঘটনার জন্ম হবে এবং জনগণের সব দৃষ্টি ‍সদ্য জন্মানো ঘটনার উপর গিয়ে পড়বে। এই বঙ্গদেশে তো চাঞ্চল্যকর ঘটনার অভাব হয় না, প্রতিনিয়ত একটা ঘটনা তার পরবর্তী ঘটনার চাঞ্চল্যতায় ধামাচাপা পড়ে যায়, যাচ্ছে। সুতরাং হিন্দু নির্যাতন, ব্লগার-লেখক হত্যা, মুয়াজ্জিন-ধর্মযাজক হত্যা, আদিবাসী নির্যাতন এগুলো সরকারের অস্তিত্বের জন্য যেহেতু হুমকি না, সেহেতু সরকার আক্রান্তদের নিয়ে এতটুকুও মাথা ঘামাবে না। মাঝে মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোর কন্ঠে আলোড়ন উঠলে লোক দেখানো কিছু ক্ষতিপূরণ (যেমন রামুতে করা হয়েছে) দিয়ে হয়তো তাদের দায়িত্বটুকু শেষ করবে। যদি তাই না হতো, তাহলে ২০০১-০৬ পর্যন্ত তৎকালীন সরকারি বাহিনীর নির্যাতনে যে লক্ষ লক্ষ হিন্দু দেশ ছাড়া হয়েছে, তার একটিরও অন্তত বিচার হতো। গত এক দশকে হিন্দু সম্প্রদায় থেকে শুরু করে পাহাড়ি আদিবাসী নির্যাতনের একটি ঘটনাতেও কোন সরকার কারো বিচার করেনি। সে ধারাবাহিকতায় এ ঘটনার ও যে বিচার হবে না, তা সহজে অনুমেয়। সুতরাং দয়া করে রাজনৈতিক দল কিংবা সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে জনগণের উপর সব দোষ চাপানো সহ মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে সেই রাজনৈতিক দল কে বেনিফিট অব ডাউট দেওয়ার নোংরা রাজনীতি বন্ধ করুণ। এ রাষ্ট্রে পাঁচ-সাত বছরে একবার ভোট দেওয়া ছাড়া সাধারণ জনগণের আর কোন ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা যাদের হাতে, ক্ষমতার প্রাণ কেন্দ্রে যারা তাদের দিকে আঙ্গুল তুলুন, তাদের ব্যর্থতার দায়ভার ক্ষমতাহীন সাধারণ জনগণের উপর চাপাবেন না।