ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে বাংলাদেশ কিংবা মিথ্যে আশার গল্প

মাসুদ সজীব
Published : 1 Feb 2017, 03:28 PM
Updated : 1 Feb 2017, 03:28 PM

এ যেন রূপকথা! আসলাম, মানুষ কে বিনোদন দিলাম এবং দিনশেষে নিজের সেই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছে গেলাম। না, এ কথাগুলো কোন টেলিভিশনের কৌতুক অনুষ্ঠান বিজয়ী কৌতুক অভিনেতার জন্য নয়। ওখানে জয়-পরাজয়ে বিনোদন দিতে পারাই মূল নির্ধারক হয়। কিন্তু এ তো রঙ্গমঞ্চ না, এটি ছিলো রাজনৈতিক মঞ্চ, আরো স্পষ্ট করে বললে নির্বাচনের মঞ্চ। সেই আপাত বিনোদনকারী যখন দলের মনোনয়নের লড়াইয়ে নেমেছিলেন তখন প্রায় সবাই তাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন! আরে দূর, এ উল্টাপাল্টা কথা বলার লোক কি কোনদিন রিপাবলিকান দল থেকে মনোনয়ন পায়? যার রাজনৈতিক কোন প্রজ্ঞা নেই, যাকে মানুষ রাজনৈতিক ময়দানে কোনদিন দেখেনি, সে কি করে এতবড় একটা দলের মনোনয়ন পায়? তারপর দলের চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচনের তর্কে বিতর্কে দিন-মাস যেতে থাকলো এবং একসময় সবাই কে ভুল প্রমাণ করে ঠিকই রিপাবলিকান দলের প্রার্থী মনোনীত হয়ে গেলেন সেই বিতর্কিত বক্তা ডোনাল্ড ট্রাম্প।

প্রথম থেকেই মানুষ তাঁর নানান চটকদার কথায় মজা নিতে থাকলো, ক্ষ্যাপাটে আর অযৌক্তিক বক্তা দেখে অনেকে ভাবলো অনেকদিন পর তারা রাজনৈতিক মাঠে একজন কৌতুক অভিনেতা পেল। রিপাবলিকান দলের এমন মনোনীত প্রার্থী দেখে ডেমোক্রেটিক পার্টির হিলারি ক্লিনটন সমর্থকরা খুশিতে মোটামুটি আত্নহারা হয়ে গেলো! ট্রাম্পের মতো বেপারোয়া, আপত কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ যদি প্রতিদ্বন্দ্বি হয় তাহলে হিলারী ক্লিনটনের জয় রুখে কে? এরপর এই জরিপ, সেই জরিপ কত জরিপ হলো এবং সব জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্প পিছিয়ে থাকলেন। পরিসংখ্যান আর জরিপ যে আধুনিকযুগের সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার সেটি ৮ই নভেম্বর আরেকবার প্রমাণ হলো এবং বিশ্বকে অবাক করে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়ে গেলেন আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট!

এখন প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের মতো একজন লাগামহীন বক্তা কী করে আমেরিকার মতো উদার রাষ্ট্রে জয়লাভ করলো? এই যে মেইনস্ট্রিম মিড়িয়ায় ট্রাম্পকে ভাঁড় নাম দেওয়া হলো, বিনোদন দানকারী বলা হলো, এগুলো আসলে কতটুকু সঠিক ছিলো? প্রকৃতপক্ষে এগুলো সব ভুল ছিলো, ট্রাম্প কোন ভাঁড় নন। আমেরিকানসহ বিশ্বের প্রধান মিড়িয়াগুলো যতই সত্য আড়াল করে ট্রাম্পকে ভাঁড় বানিয়েছিলো ততই ট্রাম্প শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ঠিকি আমেরিকার জনগনের সমস্যা ঠিক কোথায় সেটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। গত এক-দেড় দশকে আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে দিনদিন পিছিয়ে পড়ছিলো বিশেষ করে ডিগ্রীবিহীন সাদা চামড়ার আমেরিকান-রা চাকরির লড়াইয়ে অভিবাসীদের থেকে পিছিয়ে পড়ছিলো সেটি ট্রাম্প ঠিকি চিন্থিত করতে পেরেছিলেন। পেশাদার রাজনীতিবিদরা যতই অস্বীকার করুক, মেইনস্ট্রিম মিড়িয়া যতই এড়িয়ে যাক, আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝে একটা বিরাট হতাশা ঘিরে ধরেছিলো। ঝানু রাজনীতিবিদরা যেখানে অঘোষিত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মানুষ কে স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেদের দলে টানতে চেয়েছিলো, সেখানে ট্রাম্প সরাসরি শত্রু চিন্থিত করে দিয়েছিলো। কম শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, যারা আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তারা অনেকদিন অপেক্ষা করেছে পরীক্ষিত রাজনীতিবিদদের মুখের বুলিতে আর মিষ্টি আশ্বাসে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি, তাদের ভাগ্যের আকাশে কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং তাদের কর্ম সংস্থান কমে এসেছে, জীবনযাপনের মান দিন দিন নিচে নেমে এসেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির রব তুলে গত কয়েক দশকে যেমন আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি কলকারখানা হ্রাস পেয়েছে ঠিক তেমনি প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় দক্ষ জনগণ ছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে এটাও সত্যি। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আর উন্নত রাষ্ট্রে যে উচ্চশিক্ষা মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সেটির খবর ক'জন রাজনীতিবিদ রেখেছে? শিক্ষা কে সবার আয়ত্তে নিয়ে আসতে গত কয়েক দশকে এখানে কোন রাজনীতিক সরকার-ই কাজ করেনি। ফলে স্থায়ী আমেরিকার জনসংখ্যার অনেক বড় একটা অংশ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেনি।

শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া এই নেটিভ আমেরিকানদের কর্মহীন হওয়ার জন্য ট্রাম্প অভিবাসী তথা মেক্সিকান-হিসপ্যানিক আর আফ্রিকানদের দায়ী করেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ (যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ) মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত সাদা আমেরিকার-রা স্পষ্ট বুঝতে পারে তাদের এ কর্মহীনতার জন্য আসলে এরাই দায়ী। সুতরাং ট্রাম্প যখন অবৈধ ১১ মিলিয়ন অভিবাসীদের তাড়িয়ে দিবেন বলেন কিংবা মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করবেন বলেন তখন সেটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। যদিও প্রধান মিড়িয়া এগুলো কে অস্বীকার করে যেতে থাকে। ফলে ট্রাম্পের লড়াইটা শুধু রাজনীতিবিদ দের সাথে ছিলো না, ছিলো মিড়িয়ার সাথেও। সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে এ মিড়িয়াও তাদের এতোদিন ভুল ভাবতে শিখিয়েছে, ভুল স্বপ্নে বিভোর রেখেছে। তারা দেখেছে আমেরিকার আজকের মোট সম্পদের ৭৬ শতাংশের অধিকারী হচ্ছে সবচেয়ে ধনীরা, অর্থাৎ প্রথম সারির ১০% জনগোষ্ঠী। ৪০ শতাংশের হাতে আছে ২৩ ভাগ সম্পদ। ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে আমেরিকার ৯৯ শতাংশ সম্পদ! তাহলে নিচের ৫০ শতাংশের কি অবস্থা? পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্পদশালী এই রাষ্ট্রের ৫০ শতাং মানুষ তথা গরিবরা মাত্র ১% সম্পদের অধিকারী। এই যে ৫০ ভাগেরও বেশি মানুষ আমেরিকায় নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের গোলকে আটকা পড়েছে, তাদের হতাশার কথা কজন রাজনীতিবীদ খোঁজ নিয়েছে? তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কি করেছে?

৫০ ভাগের বেশি আমেরিকানরা শুনতে পায়, জানতে পারে তাদের রাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত, তাদের রাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর! কিন্তু তাদের যাপিত জীবনে তারা সেই উন্নত জীবন কে দেখে না। ফলে ট্রাম্প যখন বলেন নিজের দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে অন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় কোটি কোটি ডলার খরচ করা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমেরিকার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চার আনা উন্নতি হচ্ছে না, তখন এসব কাজে অর্থ বিনিয়োগ বৃথা। সত্য হোক আর মিথ্যে হোক সাধারণ সুবিধা বঞ্চিত মানুষ নিজেদের এমন নিম্নতর জীবনযাপনের জন্য এই কারণগুলো কে দায়ী করে। ফলে এখানেও ট্রাম্প ব্যাপকভাবে সফল হয়। তথাকথিত দক্ষ রাজনীতিবিদদের নিদারুণ ব্যর্থতায় ট্রাম্প সাদা আমেরিকানদের মাঝে উগ্রজাতীয়তাবাদের বীজ বপণ করে দেন এবং বুঝাতে সক্ষম হন যে তাদের দেশে তাদের সব অধিকার, সুযোগ-সুবিধা অভিবাসীরা নিয়ে যাচ্ছে।

অভিবাসী ইস্যু ছাড়াও ট্রাম্প বর্তমান সময়ের হটকেক জঙ্গিবাদকে ও দারুণভাবে নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করেন। এবং এখানেও স্পষ্ট শত্রুর দিকে আঙ্গুল তুলেন। এ কথা নিশ্চিতভাবই বলা যায় ট্রাম্পর প্রেসিডেন্ট হওয়ার পেছনে উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা অভিবাসী ইস্যুর পাশাপাশি সারা বিশ্বে ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে আল কায়দা থেকে বোকা হারাম, লস্কর-ই- তৈয়বা থেকে আইএস সহ প্রায় সব জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোই ইসলামি ভাবধারার কিংবা ইসলামের অনুসারী এবং এরাই সারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে অন্য ধর্মের মানুষদের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে অভিবাসীর পরে মুসলমানদের কে আমেরিকার জনগণের জন্য বড় হুমকি প্রমাণ করতে ট্রাম্পকে বেশি বেগ পেতে হয়নি।

জঙ্গিবাদের জুজু আর কোটি কোটি কর্মসংস্থানের বুলি উড়িয়ে ৮ই নভেম্বর ২০১৬র নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করে এখন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট! ২০১৬ শুরুতেও যদি আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম বলা হতো অধিকাংম মানুষ তা হেসে উড়িয়ে দিতো অথচ বছরের শেষে সেটিই সবচেয়ে বড় সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। এখনো তাই বেশিরভাগ মানুষের কাছে ট্রাম্পের এই উত্থান রূপকথা কে ও হার মানায়!

এবার রূপকথা থেকে বাস্তবের মাটিতে পা দেওয়া যাক। অবশ্য ইতিমধ্যে মাত্র সাতদিনের ট্রাম্প শাসনে বিশ্ববাসীর পা মাটিতে নেমে এসেছে। 'ধনীদের আরো ধনী আর গরীব কে আরো গরীর করার নামে যে তথাকথিত গনতান্ত্রিক রাজনীতি' বিশ্বব্যাপি সমাদৃত হয়েছিলো, তার শরীরে পঁচন ধরিয়ে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতায় তাই দেশে-দেশে , দিকে-দিকে উগ্র জাতীয়তাবাদ আর অসংখ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পদের উত্থান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যেখানেই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করবে, সেখানেই ধর্মান্ধতা, রাজনীতি নিয়ন্ত্রনে একটা বড় হাতিয়ার হয়ে উঠবে। যেটির প্রতিফলন আমেরিকায় হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেক রাষ্ট্রে হবে।

সাতদিনেই ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সবকিছুই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, মুসলমান (সাতটি) রাষ্ট্রের মানুষকে সাময়িক নিষিদ্ধ, মেক্সিকোর পণ্যে অতিরিক্ত করারোপ, টিপিপি চুক্তি বাতিল, অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন, জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো থেকে সরে আসার ঘোষনা সহ ধর্মীয় বিদ্বেষ উস্কে দেওয়ার সব কাজ-ই সফলতার সহিত করেছেন। ফলে বিশ্বব্যাপি ট্রাম্প আতংক ভালোভাবে ঝেঁকে বসেছে। যারা ভেবেছিলেন, রাজনীতিক প্রচারণা আর রাষ্ট্র পরিচালনা এক নয় তাদের জন্য ট্রাম্পের প্রথম সাতদিন বিস্ময়কর আর আতংকের ছিলো নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন আক্রমনাত্নক ছিলেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও সেই আক্রমনাত্নক নীতিতেই আছেন, বরং কিছুক্ষেত্রে আরো বেশি আগ্রাসী হয়েছেন।

আমেরিকা আর ট্রাম্প থেকে এবার বাংলাদেশে আসি। এ কথা সবাই জানে আমরা বাঙালিরা শত নিরাশাতেও মিথ্যের আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি, মিথ্যে স্বপ্নের জাল বুনি। আমাদের বুদ্ধিজীবিরা, আমাদের সুশীল-রা সব সেই মিথ্যে আশাতে জাল বুনে আর দলান্ধরা তো এ ক্ষেত্রে একেকজন মিথ্যে আশার সুবৃহৎ কারখানা গড়ে তুলে। আর সেই মিথ্যে আশার কারখানার প্রতিষ্ঠাতারা, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়াতে ঈদের চাঁদ দেখার মতো খুশি হয়েছে। তাদের এই আনন্দের কারণ হলো, হিলারী ক্লিনটন ক্ষমতায় আসতে না পারা এবং আওয়ামীলীগের ক্ষমতা আরো বেশি নিরাপদ আর ঝামেলাহীন হওয়া। তারা আবিষ্কার করেছে হিলারীর সাথে ড. ইউনুসের সম্পর্ক গাঢ়। ফলে হিলারী প্রেসিডেন্ট হলে ড. ইউনুস আমেরিকা কে কাজে লাগিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার কে সরিয়ে দিবে! প্রথমত হিলারী ক্লিনটনের সাথে ড. ইউনূসের সম্পর্ক সত্যি গাঢ় হলেও তিনি প্রেসিডেন্ট হলে খুব সহজে আওয়ামীলীগ কে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেওয়া যেত এটি অতি মাত্রায় সরলীকরণ এবং দলান্ধ মতবাদ ছাড়া কিছু নয়। বাংলাদেশের জনগণের মতের কথা বাদ দিলেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি তে আমেরিকার জন্য ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই ভারত কে বাদ দিয়ে সরাসরি বাংলাদেশের রাজনীতি তে হস্তক্ষেপ আমেরিকা কখনো করতো না। যদি তাই করতো, তাহলে ২০১৩ সালেই করতে পারতো। এছাড়া নিজেদের বড় কোন স্বার্থ ( তেল বানিজ্য, অস্ত্র বানিজ্য ) ছাড়া আমেরিকা কোথাও তাদের পেশী শক্তি প্রয়োগ করে বলে আমরা অন্তত দেখিনি। তাই শুধু মাত্র একজন ব্যক্তির স্বার্থে আমেরিকা বাংলাদেশের রাজনীতি তে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে বিষয়টা বিশ্বাস করা সত্যি হাস্যকর।

এ দলান্ধরা নানান অংক কষে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সু-বাতাস বইবে, তিনি হিলারীর মতো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন না, জঙ্গিবাদ দমন করবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। দলান্ধদের এমন ভবিষ্যত বাণী মাত্র সাতদিনেই মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। হিলারী না আসলে লীগ তথা বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে যারা আশার বুলি উড়িয়েছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলি আপনারা এখনো অলীক কল্পজগতে বাস করেন। কিভাবে?

প্রথমত, যে সাতটি দেশের মুসলমানদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন ট্রাম্প, গত চল্লিশ বছরে সেসব দেশের একজন মানুষ ও আমেরিকায় কোন ধর্মীয় হামলা চালায়নি। সিরিয়া-লিবিয়া-ইরাকে আত্নঘাতী হামলার ঘটনা ঘটলেও ইরানে তেমন ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। বরং মুসলমান রাষ্টগুলোর মাঝে শিক্ষায়, বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে ইরানিরা অনেক বেশি এগিয়ে। এমনকি আমেরিকার শিক্ষায়, বিজ্ঞানে মুসলমান রাষ্ট্রের মাঝে ইরানীদের অংশগ্রহন সবচেয়ে বেশি। তাই ঠিক কি যুক্তিতে, কিসের ভিত্তিতে ইরানের উপর এ নিষেধাজ্ঞা? আগের সরকারগুলো ইরানের সাথে যেমন বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখেছিলো, ট্রাম্প সরকারও ঠিক সেই পথেই হেঁটেছে। তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে ট্রাম্প সরকারের কোন পরিবর্তন আসেনি বলাই যায়।

ডেমোক্রেটিক প্রার্থী থেকে রিপাবলিকান প্রার্থী যে দলের হাতেই আমেরিকার রাষ্ট্র ক্ষমতা আসুক তাদের পররাষ্ট্র নীতি যে কখনো বদলায় না তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট হলো সর্বশেষ মুসলমান রাষ্ট্র নিষিদ্ধকরণের তালিকা। ডেমোক্রেটিক সরকারের মতোও রিপাবলিকান ট্রাম্প সরকারও সৌদি আরব কে বুকে আগলে রেখেছে! টুইন টাওয়ার তথা আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলায় ১৯ জন আসামীর ১৫ জনই ছিলো সৌদি আরবের। তাই সন্ত্রাস তথা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকা যদি সত্যি নিরপেক্ষ হতো, আন্তরিক হতো তাহলে সবার আগে সৌদি আরবের সাথে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করতো। কারণ সারা বিশ্বে জঙ্গি তৈরির মূল কারখানা হলো এই সৌদি আরব। আল কায়দা থেকে আজকের আইএস সব সেই সৌদি আরবের সৃষ্টি।

সৌদি আরবকে বুকে-পিঠে নিয়ে আর যাই হোক পৃথিবী থেকে জঙ্গিবাদ নিশ্চিন্ত করা যাবে না।। ব্যবসায়ী ট্রাম্পও ভালো করে জানে সৌদি তাদের হাতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও যেমন তাদের দখলে থাকবে তেমনি জঙ্গিবাদ ও বেঁচে থাকবে। আর ওটাকে পুঁজি করেই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের এই জঙ্গি-জঙ্গি দমন খেলা চলমান থাকবে। সুতরাং এ কথা সহজে অনুমেয় যেসব মুসলমান রাষ্ট্রের টাকা আর তেল নাই বরং জঙ্গিবাদের হুমকি আছে তাদের কে ট্রাম্প সরকার তার দেশে নিষিদ্ধ করবে। তাই আজ হোক আর কাল হোক বাংলাদেশের অভিবাসন প্রত্যাশীরা ও আমেরিকায় নিষিদ্ধ হতে চলেছে।

আগেও উল্লেখ করেছি কিছু না থাকলেও বাঙালির কাছে মিথ্যে আশাবাদ থাকে! তারা আশা করে গোখরা সাপ ও একদিন বিষহীন হয়ে তাদের গোয়াল ঘর রক্ষা করবে! তাই তারা ট্রাম্পের মতো গোখরা যখন টিপিপি চুক্তি বাতিল করে তখন বাংলাদেশ ভীষণ লাভবান হবে বলে খুশিতে বগল বাজাতে থাকে। তারা হয়তো জানে না টিপিপি চুক্তি বাতিল করাতে বাংলাদেশ যতটুকু লাভবান হবে তারচেয়ে কয়েকগুন বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে যখন বাংলাদেশের মানুষ আমেরিকায় নিষিদ্ধ হবে! মুসলমান বিদ্বেষের জন্য ট্রাম্প সরকার থেকে বাংলাদেশ কোন সুযোগ সুবিধা পাবে না, এটি বলে দিতে কাউকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হতে হয় না। তাই ট্রাম্পের জয়লাভে কোথাও বাংলাদেশের কোন সুফল আসার সম্ভাবনা নেই।

অন্যদিকে ট্রাম্পে স্বপ্ন দেখা কিছু মানুষ মাত্র সাতদিনে হতাশ হয়ে, গুটিকয়েক জায়গায় ট্রাম্প বিরোধী কিছু আন্দোলন দেখে ট্রাম্প বেশিদিন টিকে থাকবে না বলে আবার আশ্বানিত হয়ে উঠেছেন সেই ভীষণ আশ্বানিত মানুষদের জ্ঞতার্থে বলি, এটা বাংলাদেশ নয় যে এক ভোরে সেনাবাহিনী এসে নির্বাচিত সরকার কে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবে! আপনারা ঠিক যত মানুষ কে দেখছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সেচ্চার হয়েছে-হচ্ছে, তারচেয়ে অনেকবেশি মানুষ কিন্তু ট্রাম্পের পক্ষেও আছে। এরাই ট্রাম্প কে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে এবং ট্রাম্প এখন পর্যন্ত তাদের অখুশি করার মতো কিছু করেনি। সুতরাং যতদিন পর্যন্ত সে সব মানুষের মোহ না ভাঙ্গে, যতদিন পর্যন্ত তারা ঘরে ঘরে চাকরি না পাওয়ার বেদনায় নীল না হবে ততদিন পর্যন্ত অর্থাৎ সময়ের হিসেবে কমপক্ষে চার বছরের আগে ট্রাম্পের বিদায়ের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ও নেই।

ট্রাম্প নামক বর্ণ বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক চেতনার উগ্র জাতীয়তাবাদী আর সংকীর্ণমনা কোন মানুষের দ্বারা আমেরিকার সাধারণ মানুষের কতটুকু উন্নয়ন হবে কিংবা আদৌ হবে কিনা সেটি হয়তো সময় বলে দিবে, তবে এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ট্রাম্প কে দিয়ে বিশ্ব তথা মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর কোন উপকার হবে না। একবিংশ শতাব্দী এসে ট্রাম্প মানুষে মানুষে ঘৃণার যে সফল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন, সে ঘৃণার এ আগুণ সহসায় প্রশমিত হবে না বরং দিকে দিকে তা ছড়িয়ে যাবে। উত্তর থেকে দক্ষিন মেরু পর্যন্ত সবাই কে তাই ট্রাম্প যুগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে আগুনের উত্তাপ সইতে হবে। তাই ট্রাম্প নিয়ে মিথ্যে আশায় বুক বাঁধার কিছু নেই।