রাজনীতির কালো ক্যানভাসে অবরুদ্ধ গণতন্ত্র মুক্ত হোক

মাসুম আহম্মেদ
Published : 30 July 2012, 04:25 PM
Updated : 30 July 2012, 04:25 PM


স্বাধীনতার ৪১ বছর আর গণতন্ত্রের ২১ বছর পর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন আজ দুই দলের হাতে জিম্মি। ১৯৯০ সালে এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় স্বৈরাচার খ্যাত এরশাদ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দলীয় কাজে ব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে এরশাদের পছন্দের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সুবিধাজনক পদায়নের যা ছিল সুশাসনের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু সেই স্বৈরাচারকে বিদায় করা হল, দেশে এলো গণতন্ত্র, কিন্তু মাঝখান থেকে আমরা সাধারণ জনগণ কি পেলাম? স্বৈরাচারের আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণের ''ডাকসু'' নির্বাচন হয়েছে; মেধার ভিত্তিতে সরকারী চাকুরিতে নিয়োগের একমাত্র প্রতিষ্ঠান পিএসসি ছিল যোগ্যদের দখলে; বিচার বিভাগ ছিল গণ-মানুষের আস্থাশীল প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে যারা দায়িত্ব পেতেন তারা ছিল সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব কিন্তু ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলে এসে পিএসসি হয়ে পড়ে দলীয় অনুগতদের পুনর্বাসন কেন্দ্র যেখান থেকে খুনের মামলার পলাতক আসামিকেও দলীয় স্বার্থে নিয়োগ দেয়া ছাড়াও টাকার বিনিময়ে বা দলীয় বিবেচনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে নিয়োগ দেয়া হয় যা আজ আঞ্চলিকতা-আত্মিয়তার ভিত্তিতে পরিচালিত এবং সে কারণে প্রকৃত মেধাবীরাই কেবল বঞ্চিত হচ্ছে না, দেশ দুর্নীতির তালিকায় আন্তর্জাতিক খেতাব প্রাপ্ত হয়েছে আর সাধারণ জনগণ হয়ে পড়েছে দুর্নীতিবাজ, দলবাজ, আঞ্চলিক, আত্মিয়দের কাছে জিম্মি। তাহলে এরশাদকে তাড়াতে যারা প্রাণ দিয়েছেন, মুল্যবান সময় নষ্ট করেছেন তার কি প্রয়োজন ছিল? ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে এবং তাদের আমলে ১৯৯৩ সালে বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে সাব-রেজিস্ট্রার নেয়া হয় ৩০ জন, যেখানে অনুসন্ধানেই বের হয়ে আসবে কিভাবে খুনের মামলার পলাতক আসামিকেও পুরস্কৃত করা হয়েছে। সেই থেকে দেশ পরিচালনায় মেধাবীরা ক্রমেই বঞ্চিত হওয়ার যাত্রায় পর্যবসিত যা আজ চরমে। সেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পিএসসিতে এমন সকল সদস্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে একজন ঘুষের টাকা ভাগাভাগি কেন্দ্র করে নিজের গাড়ীর ড্রাইভার এর হাতে মার খেয়েছে (ডঃ হাসানুজ্জামান), ১/১১ সরকারের সময় মাহফুজ নামের এক সদস্যের দুর্নীতির দায়ে সাজা হল, সে আজও বিদেশে পলাতক। সেই কুখ্যাত মাহফুজের ছোট ভাই মামুনুর রশিদ মাজু তখন ছিল সিনিয়র সহকারী সচিব এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের প্রতি-মন্ত্রী রেদোয়ান আহমদের পিএস, যে ছিল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের ব্যবসায়ী এবং তার দেয়া ভুয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় বিভিন্ন ক্যাডারে চাকুরী প্রাপ্তরা আজ ধরা পড়ে চাকুরী হারাচ্ছে মাত্র। অথচ তারা থেকে যাচ্ছে বিচারের বাইরে । তাহলে স্বৈরাচার খ্যাত এরশাদের কেন আমরা বিচার চাই? সেই গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেই আমরা জাল সনদ ধারী ফয়েজি কে হাইকোর্টের বিচারপতি হতেও দেখেছি। তাহলে গণতান্ত্রিক শাসনে আমাদের প্রত্যাশা কি? স্বৈরাচারের সাথে ব্যবধান কি? যদি ব্যবধান না থাকে তাহলে এই গণতন্ত্রের প্রয়োজন কি?
এই দলীয় গণতন্ত্রের আমলে এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কি ঘটেছে? গণতন্ত্রের আমলে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারের মত মেধাবী সৎ ব্যক্তিদের হত্যাকান্ড ছাড়াও জঙ্গি-বাংলা ভাই , সায়েখ আব্দুর রহমানদের উথ্যান, ক্ষমতায় থাকা এবং যাবার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কেউ রাজাকার কেউ স্বৈরাচারের মুখাপেক্ষিও আজ। কেন? এছাড়াও দুর্নীতিবাজ আমলা, চোরাচালানি ব্যবসায়িদের দখলে আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, যা দুই বড় রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন বানিজ্যের ফলে সৎ মেধাবী যোগ্য রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতি বিমুখ। গত ২০ বৎসরে বিএনপি রাজাকার আর আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার নির্ভরতা ছাড়াও আঞ্চলিকতা এবং আত্মীয়তাকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে যার ফলে সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠান গুলো আজ জনগণের শোষণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আজ তাদের এই দলীয়করণের বাইরে নয়। ২০১০ সালে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়- আমাদের নারী শিক্ষায় বিশেষ ভুমিকা পালনকারি ইডেন কলেজ সরকারী নেতা, এম পি , মন্ত্রীদের মনোরঞ্জনের সরবরাহ কেন্দ্রে পরিণত। সেখানে বিশেষ এলাকার নেতার স্ত্রীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগেই এসকল ঘটনার কারণ বলে ক্ষমতাসীনদের ছাত্র নেতৃত্বের দাবিও আমরা পত্রিকায় দেখেছি। তাহলে আমরা এই গণতন্ত্র চাই কেন? বাংলাদেশের আয়তন যাই থাকুক ৬৪টি জেলায় তা বিভক্ত, কিন্তু গণতন্ত্রের আমলে বিশেষ এলাকার নাগরিকদের আধিপত্য আমাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, আসলে কি আমরা এদেশের নাগরিক? কখনো নোয়াখালী বগুড়া, কখনো গোপালগঞ্জ , কিশোরগঞ্জ কি আমাদের শাসক শ্রেণীর এলাকা? আর আমরা শুধুই প্রজা?
দেশ আজ স্পষ্টতই দুভাগে বিভক্ত। একভাগ পুঁজি করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে, অন্যভাগ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে। অথচ তাদের দুজনই ছিলেন গণ-মানুষের পরম বন্ধু এবং তাদের ছিল না ব্যক্তিগত লোভ লালসা। তাদের নাম –সুনাম ব্যবহারকারী দল দুটির নেতৃত্বে থাকা দুই উত্তরাধিকারী দেশটাকে তাদের উত্তরাধিকারে পাওয়া সম্পত্তির মত ব্যবহার করে যাচ্ছে; কেন? তারা কি আমাদের জাতির সম্পদ নাকি তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের সম্পদ? তাই আজ আমাদের ভাবতে হবে আমরা কি চাই ,বর্তমান দ্বি দলীয় গণতন্ত্র নাকি জনগণের গণতন্ত্র ? যদি জনগণের গণতন্ত্র চাই তাহলে আমাদের মধ্যে যারা সৎ যোগ্য এবং দেশপ্রেমিক তাদেরকে নিজেরা মনোনয়ন দিয়ে –নিজেদের শ্রম ঘাম দিয়ে নির্বাচিত করতে হবে এবং দুই বড় দলের মনোনীত দুর্নীতিবাজ আমলা ,চোরাচালানি ব্যবসায়িকে প্রত্যাখান করতে হবে ।তাই আসুন আমরা জনগণের গণতন্ত্র কায়েম করতে যার যার জায়গায় থেকে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দেই এবং সামাজিকভাবে তাদের বয়কটের মাধ্যমে এখন থেকেই কাজ শুরু করি ।