বিরোধী দলীয় প্রধানের ভারত সফরঃ সরকারী দলের বক্তব্য, জনগণের প্রতি আস্থাহীনতার রাজনীতি

মাসুম আহম্মেদ
Published : 7 Nov 2012, 08:03 PM
Updated : 7 Nov 2012, 08:03 PM

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রত্যাশাকে সামনে রেখে, কিন্তু স্বাধীনতার অল্প সময় পরে শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন- বাকশাল (সকল শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিত্বে) প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্বপরিবারে নিহত হন ১৯৭৫সালের ১৫ই আগস্ট। ক্ষমতায় আসে বঙ্গবন্ধুর শেষ দিকের বিশ্বস্থ খন্দকার মোশতাক। ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে ৩রা নভেম্বর '৭৫ এ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় হত্যা করে জাতীয় চার নেতা (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান) কে। একই মাসের ৭ তারিখে সেনা বিদ্রোহের মাধ্যমে নিহত হন তৎকালীন সেনা বাহিনীর অন্যতম অফিসার খালেদ মোশারফ সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। ক্ষমতাচ্যুত হন খন্দকার মোশতাক এবং বন্দী জিয়াউর রহমান হন একাধারে সেনা প্রধান এবং সামরিক বাহিনী প্রধান তথা সরকার প্রধান অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের সকল ঘটনার একক সুবিধাভোগী এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মানে সরকার এবং রাষ্ট্র প্রধানের একছত্র দায়িত্ব নিয়ে নেন মেজর জিয়া। ক্ষমতা গ্রহণের পরে জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশালের স্থানে বহু দলীয় গণতন্ত্র চালু করেন যা এখনও চলছে। আসলে কি দেশে গণতন্ত্র এবং এর সুফল আমরা জনগণ পেয়েছি বা পাচ্ছি? না পাইনি! কারণ শাসকদের ব্যর্থতা নাকি জনগণের অসচেতনতা? দুটোই হয়ত কারণ; কিন্তু শাসকদের ব্যর্থতা যা আঞ্চলিকতা, আত্মিয়তা, দলীয়করণ, দুর্নীতি-দুঃশাসন দ্বারা জনগণকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সেবা প্রতিষ্ঠান গুলো হয়ে উঠেছে জন দুর্ভোগের আখড়া; প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা হয়ে উঠেছে দুর্নীতি পরায়ণ এবং সে থেকে বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য, শ্রেণী ক্ষোভ। আর এসব সৃষ্টি হচ্ছে সকল শ্রেণীতেই। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সামাজিক ও যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা যার প্রভাবে যুব ও তরুণ সমাজে বাড়ছে হতাশা এবং মাদকাসক্তি।

ক্ষমতার সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দেশের মধ্যে যাদের রাজনীতি করার অধিকার ছিল না সেই যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, ৭৫এর খুনি সহ রাজনৈতিক উচ্ছিষ্টদেরকে রাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করেন কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। জিয়াউর রহমান আরো ঘোষণা করেন, ' মানি ইজ নো প্রবলেম ', যাতে বিভিন্ন সুবিধাবাদী শ্রেণীকে একধরনের উৎসাহ দেয় দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হবার, যদিও ব্যক্তিগত ভাবে জিয়াউর রহমান ছিলেন সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও তখন থেকেই আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের ভুমিকার একটি স্পষ্ট অবস্থান পরিষ্কার করে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় আমেরিকান সরকার। সেই থেকেই আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশীদের হস্থক্ষেপ এবং আমাদের নেতা নেত্রীগন হয়ে উঠেন বিদেশী দুতাবাস নির্ভর! এখন যা প্রকাশ্যরূপে আমরা দেখছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এবং ৩রা নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে জাতিকে কার্যত নেতৃত্ব শূন্য করা হয় এবং তখন থেকেই ক্ষমতা বদলে বিদেশীদের ভুমিকা/হস্থক্ষেপ শুরু হয় এবং আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীরা ক্রমান্বয়ে দেশের জনগণের চেয়ে বিদেশী প্রভুদের উপর নির্ভরশীল হতে হতে আজকের বাস্তবতায় পৌঁছে গেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য সহযোগিতা ছিল নজীর বিহীন, কিন্তু ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে মিত্রদেশ ভারতের সৈন্য ফিরিয়ে নিতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করলে দ্রুততম সময়ে ভারত তাদের সৈন্য ফিরিয়ে নেয়- যা ছিল বিশ্বের আরেক নজিরবিহীন ঘটনা। অথচ সেই প্রতিবেশী বন্ধুদেশ ভারত এখন প্রায়ই নির্বিচারে সীমান্তে গুলি চালায় নিরীহ গরু ব্যবসায়ী, কৃষকের উপর। এর কারণ কি তা আমরা জানি না; তবে আমার মনে হয় এর বড় কারণ- দুটি দলের ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতি এবং জনগণের দ্বিধা বিভক্তি যা সৃষ্টি করেছে উত্তরাধিকারী অযোগ্য ক্ষমতালোভী দুই নারী হাসিনা-খালেদা। তাঁরা দুইজন ক্ষমতায় থাকতে আর যেতে শুধু বিদেশীদের উপর নির্ভরশীলই নয়, বরং তাঁরা রাজনীতিকে করেছে তাঁদের এবং দলীয় আঞ্চলিক ও আত্মীয়দের ভাগ্য বদলের হাতিয়ার। দুই দলের ত্যাগী সৎ দক্ষ যোগ্যদের বঞ্চিত করে নিজেদের অনুগত তাবেদার দুর্নীতিবাজদেরকে করেছে পুনর্বাসন, যার ফলে আজ দুর্নীতির হয়েছে জাতীয়করণ। ক্ষমতায় আসা-যাওয়া নিয়ে বড় দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও শেয়ার মার্কেট লুট, ব্যাংক জালিয়াতি, নির্বাচনে মনোনয়ন, ভর্তি ও চাকুরী ইত্যাদি বানিজ্যের ক্ষেত্রে অসম্ভব মিল। ইতোমধ্যেই দেশের আর্থিক খাতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো চলছে ধার দেনা করে। দুর্নীতির কারণে সম্প্রতি হলমার্ক কেলেঙ্কারী অন্যতম, যার পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারের বড় বড় কর্তারাই দায়ী।

দুই বড় দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে সমাজ-রাষ্ট্রের উচ্ছিষ্ট দুর্নীতিবাজ তাবেদারদেরকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান; প্রতিপক্ষ দলের সমর্থক বিবেচনায় সৎ দক্ষ ও যোগ্যদের বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে দেয়ার মত ঘটনাও গত ২০ বৎসরের গণতান্ত্রিক আমলে দুই নেত্রী ঘটিয়েছে এবং এখনো ঘটাচ্ছে। যার ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়ছে দলীয় তাবেদারদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে আর রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা নিজেদেরকে মনে করে তারা যে যেই দায়িত্বে সে সেইটুকুর মালিক। রাষ্ট্রীয় এমন কোন সেবা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে নাগরিক তার অধিকার ঘুষ ছাড়া ভোগ করতে পারে! এমনকি গত ১৮ মাসে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশের বিরুদ্ধে ৪৬ হাজার বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে, যার মধ্যে ছিনতাই চাঁদাবাজি ছাড়াও অস্র গুলি পাচারের মত ঘটনাও আছে। ইতোমধ্যেই দুদকের এক সহকারী পরিদর্শক সহ ক্ষমতাসীন দলীয় ক্যাডার ধরা পড়েছে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন জালিয়াতির কারণে। আজ (০৬/১১/'১২) এই লেখা লিখার সময় পত্রিকায় দেখলাম খাদ্য বিভাগের গাড়িতে করে পাচারের সময় ধরা পড়েছে ১০,০০০ (দশ হাজার) বোতল ফেন্সিডিল। ইতোমধ্যে আমরা পত্রিকায় দেখেছি নারী শিক্ষার অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইডেন মহিলা কলেজ পথবধু/পতিতা সরবরাহের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেত্রী এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগী অধ্যক্ষ ও হলগুলোর সুপারদের পরোক্ষ সহযোগিতা; অথচ সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্বিকার! কেন আজ আই বাস্তবতা এবং কি ভাবে? অনুসন্ধানে দেখা যায়- এসকলের পিছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতা আর প্রধান বিরোধী দলের নিরবতা! তাহলে আমরা সাধারণ জনগণ কি তাদের কাছে জিম্মি?

কিছুদিন আগে এরশাদ সাহেব ভারত সফর করে এলেন, বিরোধী দল সমালোচনা করতে লাগল। এবার গত সপ্তাহে প্রধান বিরোধী দলের প্রধান ভারত সফরে গেলে সরকারী দলের নেতা নেত্রীরা প্রলাপ বকতে শুরু করেছে, যেন ভারত বিরোধী দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিচ্ছে। দেশে ফিরে বিরোধী দলীয় প্রধান এবং তাঁর দলীয় নেতা নেত্রীদের ভাবসাব এমন যেন ভারত সফর করে ক্ষমতার চাবি নিয়েই দেশে ফিরেছেন তাদের দলীয় প্রধান অথচ নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার বদল হবার কথা যেখানে ভোট দেবে এদেশের সাধারণ জনগণ। সবকিছু দেখে মনে হয়, জনগণের ভোট তেমন প্রয়োজনীয় নয় যতটা প্রয়োজন বিদেশী প্রভুদের খুশী করা। আজ আমাদের ভাবতে হবে- আমরা আসলে কি চাই? দুই উত্তরাধিকারীনি নারীর দাসত্ব নাকি স্বাধীন দেশের নাগরিকের মর্যাদা!

তাই আসুন আমরা যারা এদেশকে আমাদের মাতৃভুমি ভাবি এবং নিজেদেরকে স্বাধীন জাতি মনে করি তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হই দুই অযোগ্য ক্ষমতা লোভী নারীর বিরুদ্ধে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
জয় আমাদের অনিবার্য । আমাদের শ্লোগান-
"আত্মীয়তা, আঞ্চলিকতা, দলীয়করণ নয়
যোগ্যতাই হবে সকল নাগরিকের অধিকার ভোগের মাধ্যম।"