কবিতার কলকব্জা, ঘাত ও অন্তর্ঘাত

মাসুদ খানমাসুদ খান
Published : 7 August 2021, 10:37 AM
Updated : 7 August 2021, 10:37 AM


কবিতা-অরণ্য হলো সেই রহস্যমেদুর রেইন ফরেস্ট, যেখান থেকে অক্সিজেন নেয় বহু-বহু বিষণ্ন ফুসফুস আর ত্যাগ করে খেদ ও নির্বেদ, গ্লানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড, এমনকি কখনো-কখনো মনোক্সাইডও। আর সেই বৃষ্টিবন ওইসব বিষ ও বিষাদকে ফের রূপান্তরিত করে ফেলে দ্রুত অম্লজানে। কবিতার রয়েছে সেই অভিনব সালোক-সংশ্লেষণী ক্ষমতা।

রহস্যের আবরণে ঢাকা প্রকৃতি। রহস্যেই আবৃত থাকতে চায় সে। বিজ্ঞান খুলে খুলে দেখায় সেই রহস্যের সেলাই, খুঁড়ে দেখায় অভ্যন্তর। অন্যদিকে, প্রকৃতিরই এক অমোঘ অংশ, মানুষের শিল্পীমন, যেন প্রকৃতিরই পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত জোড়া দিয়ে যায় সেই খুলে-যাওয়া সেলাই, বুজিয়ে দিতে চায় খননক্ষত, একটু একটু করে সবকিছুকে করে তুলতে চায় রহস্যসুন্দর। এতে ঘর্ষণ হয় মৃদু, মনোরম। জেগে ওঠে দর্শন। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞান ও নন্দনশিল্পের এই মিহি ঘর্ষণজাত ধূসর স্ফুলিঙ্গের নাম দিই 'দর্শন'।

চূড়ান্ত বিচারে সব শিল্পই সংগীত হয়ে উঠতে চায়। শিল্প হিসেবে কবিতাও তার ভাব ভাষা রূপ রীতি সবকিছুকে চূড়ান্ত পর্যায়ে দ্রবীভূত করে নিয়ে পৌঁছাতে চায় সংগীতের মতো, সুরের মতো, সৌন্দর্যের এক নিরাকার নিঃসংজ্ঞ দশায়।

কবিতা এমনই এক ওপেন-এন্ডেড রহস্যপ্রপঞ্চ, অনির্ণেয় যার সংজ্ঞা, অমীমাংসিত যার হয়ে ওঠার সূত্র। বিশেষ থেকে নির্বিশেষের দিকে, পার্টিকুলার থেকে ইউনিভার্সালের দিকে এর আয়োজিত অভিযাত্রা। সেই যাত্রাপথে, একটি কবিতার শুরু থেকে শেষ অবধি, চলতে থাকে বহুবিচিত্র ভাবানুষঙ্গের নিরন্তর সংশ্লেষ। ভাষার পরমাণুচুল্লিতে ঘটতে থাকে নানা প্রসঙ্গ-পরমাণুর নিরন্তর ফিউশন।

কবিতা নিয়ে যুগযুগ ধরে কত কথা ও কোলাহল, কত উপলব্ধি-নানা মহাজনের। সমস্ত কথা ও কোলাহলের পরে দিনশেষে মনে হয়, কবিতা, বা যে-কোনো নন্দনশিল্প, শেষপর্যন্ত রূপরচনা, সৌন্দর্যসৃজন–সেই রূপ যা প্রোজ্জ্বল ও প্রশান্ত, সেই সৌন্দর্য যা ধারালো অথচ স্নিগ্ধ, যা সংবেদী সমঝদার পাঠকের চিত্তে জাগায় বিস্ময়জনিত মুগ্ধতা এবং তা থেকে উৎসারিত চিদানন্দ। নৈশব্দ থেকে শব্দের দিকে, এবং পরে শব্দ থেকে ক্রমে নৈশব্দের দিকে চলে কবিতার সোনালি শোভাযাত্রা। যে কোনো একটি ভালো কবিতা তাই তার শব্দের আবেশ ও আলোড়নশেষে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এক অনির্বচনীয় মুগ্ধতার নৈশব্দের ভেতর ডুবিয়ে দেয় পাঠককে। এই 'বিস্ময়জনিত মুগ্ধতা' বিষয়ে গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ার বলেছিলেন, "দ্য সিংগল গ্রেটেস্ট পটেনশিয়াল অফ পোয়েট্রি ইজ সারপ্রাইজ"।

যদিও এ-কথা ঠিক, দেশ-কাল-শ্রেণি-ও-রাজনীতি-নিরপেক্ষ সর্বজনীন সৌন্দর্যবোধ বলে কিছু নেই, তবুও যেহেতু 'রূপ ও সৌন্দর্য', তাই স্বাভাবিকভাবেই কবিতার ভাব ও ভাষা, আধার ও আধেয় এদের পরস্পরের মধ্যে থাকে, থাকতে হয়, সুষমা, সুসংগতি, পরিমিতি ও ভারসাম্য, যা সৌন্দর্যেরই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক। আবার কবিতা যেহেতু 'সৃজনলীলা'ও, তাই তাতে থাকতে হয় নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য– কনটেন্ট ও ফর্ম উভয় দিক থেকেই; থাকতে হয় মৌলিকত্ব (অরিজিনালিটি অর্থে)।

কবিতায় ভাব ও ভাষা তো বটেই, সেইসঙ্গে ছন্দ-অলংকার-অনুপ্রাস, অঙ্গ-আঙ্গিক এসবের যুগপৎ যোগসাজশ এবং সম্মিলিত তিল-তিল অবদানের মধ্য দিয়েই সম্ভব হয়ে ওঠে সর্বাঙ্গ সৌন্দর্যসৃজন, কবিতার তিলোত্তমা গড়ন। যেমন ধরা যাক 'অলংকার'। বিষয় বা ভাববস্তুর থাকে একটি স্বাভাবিক সৌন্দর্য, উপযুক্ত ও পরিমিত অলংকারে সে-সৌন্দর্য হয়ে ওঠে আরো মাধুর্যমণ্ডিত। আবার ছন্দের কথা যদি ধরি– ছন্দ সম্ভব করে তোলে, এবং বজায় রাখে, কবিতায় অন্তর্নিহিত সুরের দিকটি। ছন্দ দেয় স্বাচ্ছন্দ্য এবং ছন্দের শাসনে সাধিত হয় কবিতার পরিমিতি ও ভারসাম্যও। ভাব ভাষা শৈলী আঙ্গিক ইত্যাদি বিবিধ মাত্রা-র ফিউশনে ফুটে ওঠে কবিতার বহুমাত্রিক গড়ন।

যে কোনো নন্দনশিল্পের সঙ্গে অপরিহার্যভাবে যুক্ত থাকে নিমগ্ন সাধনা। সস্তা মনোরঞ্জন শিল্পের অভীষ্ট নয়। তবে শিল্পীর যেমন চাই সাধনা, তেমনই সমঝদারিত্বের জন্য শিল্প-উপভোক্তারও চাই কিছুটা দীক্ষা, কিছুটা প্রস্তুতি। কথাগুলি কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে কোনো নন্দনশিল্প তাই অনেকটা দীক্ষাপেক্ষ ব্রতাচারও বটে।

ভাব ও ভাষার কোন জাদুকরী কম্পোজিশন, কোন রুহুদারি বিন্যাসের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠবে যে কোন প্রকারের ফুল, সে-এক রহস্যই বটে। তবে এও সত্য-সহজ-স্বাভাবিক-অথচ-লাগসই শব্দমালার বিশেষ বিন্যাসে কোনো ভাববস্তুকে মৌলিক ও হৃদয়গ্রাহী করে ফুটিয়ে তোলাটাই কৃতিত্বের। মৌলিক ও হৃদয়গ্রাহী। উৎকৃষ্ট কবিতা সেটিই, যার উপরিতল-অন্তস্তল…নানান তল থেকে, বিভিন্ন কৌণিক দিক থেকে, বিভিন্ন স্তরের পাঠক আহরণ করতে পারে কবিতার মর্মপ্রসাদ, আস্বাদন করতে পারে তার সৌন্দর্যসার। প্রতিটি উৎকৃষ্ট কবিতাই তাই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সর্বাঙ্গসুন্দর প্রস্ফুটন– প্রফুল্ল, সজীব, গতিশীল। সমকাল অতিক্রম করে সে-কবিতা যায় কালান্তরে। উৎকৃষ্ট কবিতার একটি গুণ হচ্ছে এই কালান্তরগম্যতা-গুণ। উৎকৃষ্ট কবিতার অভিঘাত সিনক্রনিক তো বটেই, ডায়াক্রনিকও।

২।
কবিতা হচ্ছে অনুভূতির সৎ ও অকৃত্রিম প্রকাশ। অনুভূতিকে হুবহু, অবিকৃতভাবে, ভাষায় রূপান্তরিত করতে চায় কবিতা। সমস্যা হলো, অনুভূতি হচ্ছে একটি মনোদৈহিক ক্রিয়াকলাপ, বিমূর্ত ও অন্তর্গত। তাকে কীভাবে অবিকৃতভাবে, সৎ ও সঠিকরূপে প্রকাশ করা যাবে শব্দের মাধ্যমে? এমনিতেই শব্দ যেখানে বস্তু বা বিষয়ের বিমূর্ত প্রতীক বা চিহ্নায়ক, তা-ও আবার সেই প্রতীক বা চিহ্নায়ক যার মধ্যে উদ্দিষ্ট বস্তু বা বিষয়ের স্বভাবচরিত্রের নেই কোনো প্রতিফলন। যেমন, 'নদী' শব্দটির ধ্বনিরূপ বা লেখ্যরূপ কোনোটাই প্রকৃত নদী-র মতো নয়। 'অশ্ব' বা 'ঘোড়া' শব্দের রূপও নয় প্রকৃত ঘোড়া বা অশ্বের মতো। বস্তুত কোনো শব্দের স্বভাবই ওরকমটা নয়, কেবলমাত্র কিছু ধ্বন্যাত্মক বা অনুকারজাতীয় শব্দ ছাড়া।

কিন্তু ধরা যাক, যদি এরকম হতো, নদী কে 'নদী' শব্দ দিয়ে না বুঝিয়ে যদি বোঝানো হতো 'কলকল' বা এমন কোনো শব্দ দিয়ে যা শুনে মনে সরাসরি দ্যোতিত হতো নদীর অর্থ ও চিত্র! ঘোড়া-র নাম 'ঘোড়া' না হয়ে যদি হতো 'টগবগ-টগবগ' বা 'চিঁ-হিঁ-হিঁ…' বা এই জাতীয় কোনো ধ্বনিসমষ্টি যা ঘোড়ার ক্রিয়া-ধ্বনিরই অনুরূপ, তরঙ্গ যদি হতো 'ছলাৎ-ছলাৎ' কিংবা মৃদু ঢেউ 'ঝিলমিল-ঝিলমিল', ঝোড়ো হাওয়ার নাম যদি হতো 'শোঁ-শোঁ' আর মৃদুমন্দ বাতাসের নাম 'ঝিরঝির' কিংবা 'মিলমিল', বৃষ্টি যদি 'বৃষ্টি' না হয়ে হতো মাত্রাভেদে 'ঝমঝম', 'রিমঝিম' 'টিপটিপ', 'ঝিরিঝিরি'… তাহলে হয়তো প্রকৃত বস্তু বা বিষয়ের সঙ্গে শব্দের কিছুটা হলেও মিল থাকত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি বা হওয়া সম্ভবও নয়। আসলে সব বস্তু বা বিষয়ের ক্ষেত্রে কি আদৌ সম্ভব ওরকম সাযুজ্যময় প্রতিনিধিত্বমূলক ধ্বনিগুচ্ছের উদ্ভব?

উচ্চারিত বা লিখিত শব্দের সঙ্গে যদি উদ্দিষ্ট বস্তু বা বিষয়ের থাকত সরাসরি মিল, ধ্বনিগত কিংবা চিত্রগত, তাহলে হয়তো কবির পক্ষে কিছুটা সহজ হতো অনুভূতিকে ভাষায় রূপান্তরের কাজটি। বাস্তবে তা হয়নি। আর এখানেই কবিকে মুখোমুখি হতে হয় এক দুঃসাধ্য চ্যালেঞ্জের। কবি ঘটাতে চান তার অনুভূতির অবিকৃত সৎ প্রকাশ, কিন্তু বিদ্যমান শব্দ তথা ভাষাব্যবস্থা মোটেই তার অনুকূল নয়। অথচ এই শব্দই কবির একমাত্র অবলম্বন, এ ভিন্ন অন্য কোনো সহায় নেই তাঁর। অপরাপর শিল্পমাধ্যমের মতো তাঁর নেই কোনো দৃশ্য, সংগীত, আলো, আলো-আঁধারি, রং, রেখা, পাত্রপাত্রী, কুশীলব। একমাত্র শব্দই তাঁর অবলম্বন, শব্দই সহায়। সেই শব্দের আচরণও ফের বিমাতাসুলভ।

এরকম এক নিঃসহায় ও নিঃসঙ্গ অবস্থার মধ্যেই কবিকে গ্রহণ করতে হয় শব্দ ও ভাষার ছুড়ে দেওয়া সেই চ্যালেঞ্জ। কবি তাঁর অনুভূতিমালাকে যতটা সম্ভব সৎভাবে ভাষায় রূপান্তর ঘটানোর প্রয়াস পান। এই প্রয়াস আত্যন্তিক। এই প্রয়াস চলে চেতন ও অবচেতনের এক অপরূপ গোধূলিলগ্নে, এক অভূতপূর্ব ঘোরের ভেতর, এক অনির্বচনীয় টানাপড়েন ও দোলাচলের মধ্য দিয়ে। অনুভূতিকে ভাষায় রূপান্তরের এই কৃত্যে কবি কখনো সফল হন, কখনো-বা ব্যর্থ। কিন্তু ব্যর্থতাও ফুটে ওঠে মহৎ ও অপরূপ হয়ে। কবিতার শরীর জুড়ে অলক্ষেইে লিপ্ত হয়ে থাকে কবির আন্তরিক রক্তক্ষরণের চিহ্ন।

ভাষার এই নিদারুণ কপটাচার সত্ত্বেও কবিকে ওই ভাষার মাধ্যমেই ঘটাতে হয় তাঁর অনুভূতির প্রতিফলন, ভাষার মাধ্যমেই আকার দিতে হয় নিরাকার অনুভূতিকে, মূর্ত করে তুলতে হয় বিমূর্ত উপলব্ধিকে। আর এটা করতে গিয়ে তাই অনিবার্যভাবেই ভাষার শরীর যায় ফেটে ফেটে। চিড় ধরে ভাষিক শৃঙ্খলায়। লঙ্ঘিত হয় ব্যকরণ, ভেঙে পড়ে স্বাভাবিক যুক্তি ও পরম্পরা। বস্তুত যে কোনো সাধারণ একটি কবিতায়ও আমরা ভেঙে পড়তে দেখি ভাষার ওই প্রথাগত শৃঙ্খলা।

ভাষাকে চিরে-ফেড়ে, বিশৃঙ্খল করে দিয়ে, নেমে আসে কবিতা। ভাষার ভিতরে ঘটিয়ে দেওয়া এক তুমুল রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে কবিতা। ভাষার এক শুদ্ধসৎ আরতিকতার ফসল কবিতা। উপমা-উৎপ্রেক্ষায়, রূপকে, প্রতীকে, প্রতিমায় আর ভাষা ও যুক্তির শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় এক নতুন শৃঙ্খলা, এক অভিনব গোধূলিভাষ্য। এ যেন খোদ অনুভূতিরই এক অবিকৃত সৎ প্রতিচ্ছবি, উপলব্ধিরই এক অকপট আলপনা। কবিতা। পরম মমতায় কবি তাকান তাঁর নবজাত কবিতার দিকে। কবির তখন যুগপৎ শান্তি ও সংশয়। এ-শান্তি সৃজনের, এ-শান্তি গর্ভমোচনের– পরম ও অনির্বচনীয়। এ-সংশয় আধ্যাত্মিক– 'আমিই কি জন্ম দিলাম এই কবিতার, নাকি তা নাজিল হলো এইমাত্র আমার ভেতর?'

কবিতাকে তাই অপৌরুষেয় বলে ভ্রম হয়, হতে থাকে, দেশে দেশে, কালে কালে।

৩।
কবিতা এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম। কারণ, মানুষের অনুভূতি ও উপলব্ধির সৎ ও অকৃত্রিম প্রতিফলন ঘটে কবিতায়, আর সেই অনুভূতি একজন সৃজনশীল শিল্পীর অনুভূতি।

শিল্পীমানুষের অনুভূতি। কথাটি এজন্য বলছি যে, শারীরতত্ত্ববিদ পাভলভের মতে, একজন শিল্পীমানুষের ফার্স্ট সিগনালিং সিস্টেম থাকে শক্তিশালী। কবিদের, শিল্পীদের ইন্দ্রিয় নিত্যজাগর, সদাপ্রখর। বাইরের জগতের যে-কোনো সংকেত– হোক তা সুখের কিংবা অসুখের, আনন্দের কিংবা ব্যথার, ভয়ের বা নির্ভয়ের, হোক সে-সংকেত উত্তাল কিংবা নিস্তরঙ্গ, লাউড কিংবা হাস্কি কিংবা মাফল্ড– আগে ধরা দেয় শিল্পীমানুষের অ্যান্টেনায়। সাড়া তোলে তাঁর সংবেদী চেতনায়, তৈরি হয় সে-সম্পর্কিত অনুভূতি ও উপলব্ধি। আর যেহেতু কবি সৃজনশীল, তাই তাঁর সেই অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রতিফলন তিনি ঘটান এমন এক কাব্যিক জগৎ তৈরির মধ্য দিয়ে, এমন এক প্রকৃতি-সৃজনের ভেতর দিয়ে যে, সেই জগৎ, সেই প্রকৃতি এই প্রচলিত জগতের বস্তু-বাস্তবতা, শব্দ-নৈশব্দ দিয়েই গড়ে ওঠে বটে, কিন্তু গাঁথা হয়ে ওঠে এক ভিন্নতর সম্পর্কসূত্রে, বিন্যস্ত হয় যেন এক অপ্রাকৃত বিন্যাসে, এক আপাতছদ্ম যুক্তিসিলসিলায়।

এজন্যই, কবি যা সৃষ্টি করেন তাকে বলা হয় 'বিকল্প জগৎ', 'বিকল্প প্রকৃতি', যেখানে খেলা করে অন্য আলো-ছায়া, অন্য মেঘ-রোদ্দুর, অন্য নিসর্গ– ভিন্ন চালে, ভিন্ন লজিকে। প্রথাগত যুক্তিশৃঙ্খলার গভীর বিপর্যয়সাধনের মধ্য দিয়ে কবি রূপায়িত করে তোলেন এক অলৌকিক নৈরাজ্যবিন্যাস। তারপর তার সেই স্বরচিত বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকে সৃজন করতে থাকেন ভিন্নতর এক নান্দনিক শৃঙ্খলা, এক ভাষাতীত ভাষাপ্রপঞ্চ। শৃঙ্খলা ভেঙেচুরে নতুন শৃঙ্খলা। 'অর্ডার অব ডিসঅর্ডার'-এর গণিত… গণিতের উচ্চতর ক্রিয়াকাণ্ড।

কবির সেই 'বিকল্প জগৎ' সৃষ্টির যে-রসায়ন, তাতে অবলীলাক্রমে, এক অকপট বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, এক ইনসাইটফুল অভিব্যক্তির সঙ্গে সংশ্লেষ ঘটে নানা ছন্দ ও স্পন্দন, প্রতিমা ও প্রতীক, উপমা ও রূপকের। আর মানুষের মনের ওপর ছন্দ-স্পন্দন, উপমা-রূপকমেশানো ইনসাইটফুল ভাষার অভিঘাত সবসময়ই হয় তীব্র ও কার্যকর। একটি উত্তম কবিতা তাই ছুঁয়ে যায় পাঠকের যুগপৎ হৃদয় ও মনন, দুলিয়ে দেয় তাকে, মনে হানা দেয় প্রতিনিয়ত। উৎকৃষ্ট কবিতা কোনো-না-কোনোভাবে ছাপ ফেলেই যায় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে। একজন প্রকৃত কবি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন "ভয়েস অব হিজ ট্রাইব"। ব্যক্তি ও সমাজের নানা প্রয়োজনে, আয়োজনে ও সংকটে মানুষ যায় কবিতার কাছে– চিদানন্দের জন্য, শুশ্রূষার জন্য, উদ্দীপনার জন্য।

এগুলি তো আছেই, কবিতার গুরুতর দিক আমার বিবেচনায় অন্যত্র। কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে, যে-শব্দরাশি একটি জনগোষ্ঠির ভাষার অন্তর্গত, যে-ভাষা ফের সামাজিক সম্পদ। আর ভাষার সবচেয়ে সূক্ষ্ম, সংবেদনশীল, স্থিতিস্থাপক, সৃজনমুখর ও সৃষ্টি-উন্মুখ দিকগুলি নিয়েই কবিতার কারবার। শব্দের প্রচলিত, অভিধানসিদ্ধ অর্থেরও অতিরিক্ত, সম্প্রসারিত ও নব্য অর্থের সম্ভাবনাকে ক্রমাগত উসকে দিতে থাকে কবিতা। টালমাটাল করে দিতে থাকে শব্দের প্রথাগত অর্থ, উৎপাদন করে নতুন-নতুন অর্থ। ভাষার বিভিন্ন সুপ্ত শক্তি ও সম্ভাবনাকে বিচিত্র ধারায় উন্মোচন করে করে এগিয়ে চলে কবিতা।

পোয়েট্রি ইজ দ্য সুপ্রিম ইউজ অব ল্যাংগুয়েজ । মানুষ ভাষিক প্রাণী; সমাজ একটি ভাষাবদ্ধ ব্যবস্থা। আর কবিতা সেই ভাষার মধ্যে ঘটিয়ে দেয় এবং নিত্য জারি রাখে একধরনের বৈপ্লবিক অন্তর্ঘাতের ধারা, নীরবে-নীরবে, আস্তে-আস্তে, গেরিলা কায়দায়। আর এভাবে প্রতিনিয়ত ঝাঁকুনি-খেতে-থাকা ভাষার মধ্য দিয়েই ঝাঁকুনি খায় সমাজের নানা ক্ষেত্রের স্থিতাবস্থা, রক্ষণশীলতা। কবিতা ঢেউ তোলে ভাষার সাগরে আর সেই ঢেউয়ের ধাক্কা গিয়ে লাগতে থাকে সমাজে প্রচলিত নানা প্রথা ও মূল্যবোধে। কবিতার কাজ এক্ষেত্রে নীরব, অন্তর্ঘাতমূলক। আপাতদৃষ্টিতে, বাইরে থেকে হয়তো বোঝা যায় না, কিন্তু কাজ চলে নীরবে, ভেতরে-ভেতরে। আর বলাই বাহুল্য, এই অন্তর্ঘাত সদর্থক। এই অন্তর্ঘাত ইতিবাচক।

কবিতা দর্শনের আগে-আগে-থাকা একটি শিল্পপ্রপঞ্চ। এটি সবসময় তা-ই ছিল। একটি কালপর্বের কবিতার মধ্যে আগাম পাওয়া যায় সেই কালের অস্ফুট ও স্ফুটমান বিভিন্ন চিন্তা ও দর্শনের রূপরীতি, তাদের নানারকম উদ্ভাস। একটি কালখণ্ডের মধ্যে জন্ম-নেওয়া কাব্যসমুদয়ের বিপুল হাঁড়িতে ফুটতে থাকে, আকার পেতে থাকে সেই সময়কালের নানা চিন্তা, ভাব ও দর্শন।

সমাজে নানা মানুষের নানা মত-পথ, নানা সংস্কৃতি-উপসংস্কৃতি। যার-যার ধর্ম, নীতি, আদর্শ, রাজনীতি তার-তার অহং। ধর্ম, নীতি, আদর্শ ও রাজনীতি যেখানে নানা ভাগে ভাগ করে রাখে মানুষকে, সেখানে কবিতা বা যে কোনো নন্দনশিল্প, চিত্তে আবেদন জাগিয়ে, অর্থাৎ চিত্ত ধরে এক পঙক্তিতে প্রসাদ খাইয়ে ছাড়ে সবাইকে, বিচিত্র-এমনকি-পরস্পরবিরোধী নানা মত-পথ-কৃত্য-বিত্ত-সংস্কৃতির মানুষকে।

সুকুমারশিল্প কাজ করে এভাবেই অন্য এক উচ্চতর স্তর থেকে। ঘটিয়ে দিতে চায় বৈচিত্র্যের ভেতরে ঐক্য, বিভেদের ভেতরে অভেদ। নন্দনশিল্প চিত্তে আবেদন ঘটায় নানাভাবে– কখনো রাঙিয়ে, কখনো জাগিয়ে; মনকে কখনো শমিত ও আনন্দিত ক'রে, কখনো উত্তেজিত উদ্দীপিত ক'রে। শিল্পের ভূমিকা তাই চিত্তরঞ্জনী এবং চিত্ত-জাগানিয়া, উভয়তই।

৪।
দৃশ্য, চিত্র, স্মৃতি, স্বপ্ন ও কল্পনাচূর্ণের সংশ্লেষ ও মন্থন ঘটে কবিতায়। সঙ্গে যুক্ত হয় অনুভূতির উত্তাপ। সে-উত্তাপে কবিতায় সরের মতো জেগে ওঠে মিহি এক অর্থস্তর। কবিতা এভাবেই কিছু অর্থ উপরিতলে ভাসিয়ে রেখে ভেতরে-ভেতরে ঘটিয়ে দেয় সূক্ষ্ম অনর্থ। কবিতা থাকে ধরা-অধরার দোলাচলে। আর সেই 'ধরা'টুকু দিয়ে 'অধরা'টুকুকে ধরবার জন্য থাকে সংবেদী সমঝদার পাঠকের ব্যাকুলতা।

ধু-ধু বালিয়াড়িতে, ঠিক জল নয়, জলের আভাস ফুটিয়ে তোলে কবিতা। ঘটিয়ে তোলে সর্পতে রজ্জুবিভ্রম, কিংবা রজ্জুতে সর্পপ্রমাদ। আর শালুক শ্যাওলা দামঘাসে ভরা রাতের জলাভূমিতে মিটিমিটি-জ্বলা মিথেনের আলো-কে আলেয়া আকারে প্রতিভাত করায় কবিতা। ভূতপূর্বকে করে তোলে অভূতপূর্ব।

কবিতা নানা ধরনের। কোনো কোনো কবিতা পাঠককে এক স্নিগ্ধ নাতিধীর গতিতে চালিয়ে নিয়ে পৌঁছিয়ে দেয় গন্তব্যে– খুবই সাধারণ এক স্টেশন থেকে উঠিয়ে নিয়ে নানারূপ দৃশ্য ও হাওয়াপ্রবাহের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে পৌঁছিয়ে দেয় এক নতুন, অভাবিতপূর্ব স্টেশনে। অভাবিত, তবে সুনিশ্চিত সেই স্টেশন। সেসব কবিতা দেয় গন্তব্যের নিশ্চয়তা, নির্ভরতা। পাঠশেষে পাঠকের ভেতরে জাগে এক ধরনের বিস্ময়জনিত মুগ্ধতা, সেইসঙ্গে সে পায় অভিযানের সম্পূর্ণতা।

আবার কোনো কবিতা আছে যে কবিতা নিয়ে যায় না কোনো গন্তব্যে, পাঠককে নানারূপ বাঁকাগতি দেখিয়ে, চোরাপথে ঘুরিয়ে, নানারকম ইন্দ্রিয়হর্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ ছেড়ে দেয় এক অচেনা অনিশ্চিত প্রান্তরে। এই যে ইন্দ্রিয়হর্ষ অভিজ্ঞতা আর অভিযানের এই যে অসম্পূর্ণতা, এতেও মুগ্ধ হয় অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পাঠক।

কোনো কোনো কবিতা পৌঁছিয়ে দেয় না, আবার কোনো কবিতা দেয়। কোনো কবিতা থিমেটিক, বিষয়নির্ভর। কোনোটা নির্বিষয়। কোনো কবিতা দেয় ভাবের সম্পূর্ণতা, কোনোটাতে থাকে ভাঙা-ভাঙা ইমেজ, আর ভাবের অসম্পূর্ণ উদ্ভাস।

থিমেটিক কবিতা তো বটেই, এমনকি একটি সিচুয়েশনাল বা কনটেক্সচুয়াল কবিতাও হয়ে উঠতে পারে যথার্থ কবিতা যদি কবি তাঁর কল্পনা ও ভাষাশক্তি দিয়ে সেই বিশেষ থিম বা কনটেক্সটের সীমা ছাড়িয়ে তাঁর টেক্সটিকে উতরে নিয়ে যেতে পারেন নির্বিশেষের দিকে, এমনকি কখনো-কখনো শাশ্বতের দিকে, সর্বজনীনতার দিকে, যদি তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেন সেই চেনা থিম বা কনটেক্সট পেরিয়ে-যাওয়া এক অচেনা আবহ, অচেনা সৌন্দর্য, যা বিস্ময় জাগায়, মুগ্ধ করে।