যুদ্ধাহতের ভাষ্য- ৪৯: ‘‘শেখের মাইয়ার ব্রেইনই যথেষ্ট’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 9 Sept 2011, 03:37 PM
Updated : 25 June 2016, 08:43 AM

''আমি তহন ক্লাস টুতে। পেট ফোলা কালাজ্বরে মানুষ মরতাছে। ওই রোগ আমারেও ধরে। প্রাণে বাঁইচা গেলেও আমার লেহাপড়া হয় বন্ধ। একটু বড় হইতেই বাপের লগে কাজে যাইতাম। অবসরে মাছ মারতাম বাগমারা খাল আর খাইস্যামারা নদীতে। বড়শি আর উড়াল জালে ধরা পড়ত বোয়াল আর পাবদা। তহন অনেক মাছ ছিল। খাওনের মানুষ ছিল কম। এহন মানুষ আছে, মাছ নাই।''

''বন্ধু মোহাম্দ আলী, আবদুস সালাম, আবদুল কাদির, আবু সাইদ ও সিরাজের লগে ডাংবাড়ি, দাড়িয়াবান্দা আর হাডুডু খেলতাম। হাডুডুতে ইয়ালি কইরা দম দিলে, আমারে কেউ আটকাইতে পারত না। একবার হায়ারে খেলতে যাই চাঁনপুর গ্রামে। ওই গ্রামে হিন্দু ছিল বেশি। পানি পিপাসা লাগছে। তহন করি কী? একজন দেখায়া দিল ইসমাইল হাজির বাড়িডা। বাড়িত ঢুইকা কইলাম, পানি খামু। হাজি সাহেব মেয়ে আনোয়ারারে পাঠায় গ্লাস আর পানির জগটা দিয়া। ওইদিনই আনোয়ারারে প্রথম দেহি। লোক পাঠায়া বিয়ার প্রস্তাব দিলে পরে আমগো বিয়াও হয়।''

জীবনের গল্প এভাবেই শুরু করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল শহীদ। পিতা আরব আলী ফরাজী আর মা গুল রেহান বেগমের তৃতীয় সন্তান তিনি। বাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার বাগমারা গ্রামে। এক সকালে তাঁর নিজ বাড়িতে বসেই আলাপ হয় আমাদের।

[আবদুল শহীদের বক্তব্যের ভিডিও:

১৯৭১এ শহীদের বয়স ছিল একত্রিশ বছর। পরিবারে তখন বাবা-মা ছাড়াও স্ত্রী আনোয়ারা আর এক মেয়ে। সংসারের এমন মায়ার বন্ধন ত্যাগ করে কেন গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে? এমন প্রশ্নে স্মৃতি হাতড়ে শহীদ জানালেন নানা কথা।

''আমরা মূর্খ মানুষ। রাজনীতি বুঝি না। ওইখানে তহন রাজনীতি করত নুরুল হুদা, ওমর আলী মোড়ল। রেডিও থাইকা আমরা নানা খবর পাইতাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও শুনছি রেডিওতে। বঙ্গবন্ধু কইলেন, 'রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব…..'। এরপরই তো যুদ্ধ শুরু হইল। কান্দাগাঁও পর্যন্ত পাঞ্জাবি আইল। প্রতিদিনই ওরা গ্রাম জ্বালায়, মেয়েমানুষ ধইরা নিয়া যায়। অনেকেই তহন পাকিস্তানের পক্ষে কমিটি করে। বেতুরার ফকির চেয়ারম্যান ছিল নামকরা পাকিস্তানের দালাল।''

''দেশে মানুষ মরতাছে। এইসব দেইখা একদিন বাবায় আমগো ডাইকা কয়, 'আমি আল্লাহর ওয়াস্তে একটা ছেলেরে বাংলার মাটির জন্য দান করলাম।' কিন্তু কে যাইব যুদ্ধে? বড় ভাই নায়েব আলি বলে, 'বাবা, আমি বড়, আমিই যামু।' পরদিনই ও চলে যায় ভারতের বালাটে। ওইখানের শরণার্থী শিবিরগুলোতে তহন কলেরার মহামারি। প্রতিদিনই মানুষ মরতাছে। দেইখাই ভাই ভয়ে বাড়িত ফিরা আহে। ওরে দেইখা ওইদিন বাবার সে কী কান্দন! কয়, 'তগো লাগব না, আমিই যামু যুদ্ধে। মরতে হয় দেশের লাইগা মরমু।' আমি বাবারে থামাই। বলি, 'যুদ্ধে আমি যামু। দেইখো স্বাধীনতা না নিয়া ফিরা আসমু না।' আমার স্ত্রী আমারে বাধা দেয় নাই। দেশের লাইগা হাসিমুখেই বিদায় দিছে।''

তখন আষাঢ় মাস। আবদুল শহীদরা বুগলা বাজার ও বাঁশতলা হয়ে চলে আসেন ভারতের চেলা ইয়ুথ ক্যাম্পে। সেখানে বাঁশ দিয়ে ট্রেনিং চলে পনের দিন। অতঃপর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইকো ওয়ান ক্যাম্প, মেঘালয়ে। ২৭ নম্বর ব্যাচে আঠাশ দিনের হায়ার ট্রেনিং হয় সেখানে। থ্রি নট থ্রি, মার্ক ফোর, গ্রেনেড, স্টেনগান, এসএলআর ট্রেনিং করায় ভারতের গুরখা রেজিমেন্ট। পরে তাদের অস্ত্র দেওয়া হয় শিলং থেকে।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল শহীদ যুদ্ধ করেছেন ৫ নং সেক্টরের দোয়ারবাজার থানা, টেংরাটিলা, বালিউড়া বাজার, টেবলাই প্রভৃতি এলাকায়। তিনি বলেন:

''আমারে আর মোনতাজরে পাথরঘাটা ও বাঁশতলা হয়ে পাঠায়া দেয় টেগলাই ক্যাম্পে। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আলি ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার আবু সাইদ আর সেকশন কমান্ডার ছিলেন রাজশাহীর আব্বাস উদ্দিন। ওখান থেকেই আমরা অপারেশন করি। গেরিলা ছিলাম। গুপ্তভাবে গিয়া দেখতাম কোন দিক দিয়া পাঞ্জাবি আহে। তারপর হঠাৎ আক্রমণ করেই সরে পড়তাম। পরে আমি বদলি হয়ে চলে যাই পাপা কোম্পানিতে। তোফাজ্জল সাহেব ছিলেন ওই কোম্পানির কমান্ডার।''

এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল শহীদের বাম হাতের কনুইয়ের নিচের হাড় গুঁড়ো হয়ে যায়। ফলে সারাজীবনের জন্য তাঁর হাতটি কর্মক্ষমতা হারায়। কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে? প্রশ্ন শুনে এই বীর যোদ্ধা নীরব হয়ে যান। চোখের কোণে জমে কষ্টের জল। এক হাতে সে জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন:

''আমরা তহন দোয়ারা বাজারে। সুরমা নদীর পাড়ে সেন্ট্রি লাগায়ে বইসা রইছি। দেখতাছি, পাঞ্জাবিরা কোন দিকে যায়। টেংরাটিলার পশ্চিমের গ্রামে ঢুকে পাঁচ পাঞ্জাবি। ওরা এক বুড়াকরে মারধর কইরা বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দেয়। তার দুই মেয়ে। এক মেয়ে কোনো রকমে দৌড়াইয়া পালায়। আরেক মেয়ে ওদের রোষানলে পড়ে। বুড়া ও তার মেয়ে ছুইটা আসে আমাদের কাছে। সব শুইনা আমরা পজিশনে যাই।''

''তিনজন পাঞ্জাবি বুড়ার ঘরের সামনে পাহারা দিতাছে। একটু পরে খালি গায়ে ঘর থেইকা বাইর হয় আরও দুই পাঞ্জাবি। কিছু বোঝার আর বাকি থাকে না। পায়ের রক্ত তখন মাথায় উইঠা যায়। গুলি কইরা তিন জনরেই প্রথম শোয়ায়া ফালাই। পরে ঘর থেইকা বা্ইর হওয়া বাকি দুই জনরেও। মেয়েটারে উদ্ধার করি রক্তাক্ত অবস্থায়। তার চিকিৎসা করেন ডা. রাকিব আলী। সে সুস্থ হই্লে পরে তাকে বিয়া করেন আমাদের সহযোদ্ধা আব্বাস উদ্দিন।''

''পাঞ্জাবিরা এই ঘটনা সহজভাবে নেয় না। তারা ক্ষিপ্ত হইয়া ওঠে। টেংরাটিলায় ছিল ওদের শক্তিশালী কোম্পানি। আমাদের টেবলাইতে। প্রতিশোধ নিতে পরদিনই ওরা ৪-৫শ পাঞ্জাবি পাঠায় আমাদের দিকে।''

''নভেম্বরের ২৮ তারিখ। সকাল ৭টার মতো। আমরা তাস খেলতেছি ছোট্ট একটা টিলার উপর। ওইখান থেইকা ওদের ঘাঁটি দেখা যায়। টিলা থেইকা নামলেই ছোট একটা খাল। ওইটা পার হইলেই আমাদের ঘাঁটি। বন্ধুদের বললাম, 'চল, রেইকি কইরা আসি।' ওরা উঠল না। আমি এসএলআর আর ৫টা গ্রেনেড নিয়া টিলার উত্তর পাশে গেলাম। হঠাৎ দেখি নিচের দিকে ওদের হেলমেট আর হাতের চকচকে অস্ত্রগুলা দেখা যায়। ওরা শত শত। তখনও ওদের কমান্ডিং অফিসার আসে নাই। তাই অপেক্ষায় আছে।''

''তাড়াতাড়ি টিলা থেইকা সবাইরে সইরা যাইতে কইলাম। নিজে খাল পার হইয়া পজিশন নেই ওই পারে। অন্যরাও তাই করে।''

''আমাদের সঙ্গে রহিম নামে আইএ পাশ এক ছেলে ছিল। খালটা সে পার হইছে মাত্র। তীরে উঠতেই পাঞ্জাবিরা ওপারে চইলা আসে। চিৎকার দিয়া বলে, 'মাদারচোদ, মুজিব কা বাচ্চা, ঠেরো, ইন্ডিয়াকে বাচ্চা, ঠেরো'। বইলাই ওরে ফায়ার করে। চোখের সামনে ছেলেটা মাটিতে লুটায়ে পড়ে। শরীরটা তার কয়েকটা ঝাড়া দিয়াই নিথর হইয়া যায়।''

''চোখের সামনে সহযোদ্ধার মৃত্যু। রক্ত তখন টগবগ করতেছিল। দূরত্ব মাত্র চারশ গজ। মাঝখানে শুধু খাল। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলতেছে। আমিও গুলি করতেছি। কিন্তু কখন যে রক্তাক্ত হইছি টেরই পাই নাই। হঠাৎ দেখলাম বাম হতে রক্ত। তখনও থামি নাই। অন্য হাতে গুলি করতেছি। খালেক ছিল পাশে। বলল, 'শহীদ ভাই, আপনার তো গুলি লাগছে।' আমি বলি, 'দুর শালা, গুলি লাগলে আমি গুলি করি কেমনে?'''

''তখনও বুঝি নাই। রক্ত পড়তে ছিল। হঠাৎ বাম হাতটা শিরশির করে। চুলকাইতে গিয়া দেখি বাম হাতের কনুইয়ের নিচে হাড্ডিটা গুড়া হইয়া বাইর হইয়া আসছে। পিলপিল কইরা রক্তও বাইর হইতাছে। কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমি বাঁশতলা অস্থায়ী হাসপাতালে।''

বাঁশতলা থেকে মুক্তিযোদ্ধা শহীদের চিকিৎসা হয় প্রথমে শিলং হাসপাতালে এবং পরে গৌহাটি ও লখনৌতে। ডাক্তাররা প্রথমে তাঁর হাত কেটে ফেলতে চাইলেও অপারেশনের ফলে সেটি রক্ষা পায়। ক্ষতের জায়গাটা ধোয়ার করার সময় প্রচণ্ড কষ্ট পেতেন শহীদ। প্রতি রাতে 'মাগো বাবাগো' বলে চিৎকার করে পানি খেতে চাইতেন। প্রতিদিন ৫-৬টা লাশ বের করা হত হাসপাতালে তাঁর রুম থেকেই। এসব দেখে শহীদ ধরেই নেন যে, অন্যদের মতো তিনিও মারা যাবেন। আনমনা হয় তাঁর মন। কিন্তু না, তেমনটি ঘটল না।

কয়েকদিন পরই হাসপাতালের নার্সরা হাসিমুখে শহীদকে বলেন, 'তোমারা দেশ আজাদ হো গিয়া।' স্বাধীনতার আনন্দে শহীদ তখন খুব কাঁদেন। তাঁর ভাষায়:

''আমাদের রক্তে রাঙা হইছে বাংলাদেশ। পরিবার জানে আমি বাঁইচা নাই। স্বাধীনের পরে চল্লিশার দোয়া পড়ানোও শেষ। লখনৌ থেইকা এক লোকের মাধ্যমে চিঠি লিখা পাঠাই বাড়িতে। সেই চিঠি পাইয়া বাপ, মা আর স্ত্রী জানতে পারে আমি বাঁইচা আছি।''

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চিকিৎসার জন্য মুক্তিযোদ্ধা শহীদকে পাঠানো হয় যুগোস্লোভিয়ায়। সেখানে তাঁর হাতের অপারেশন করে ভেতরে পাত বসিয়ে ছটি স্ক্রু লাগিয়ে দেওয়া হয়। একটি স্ক্রু এখন খুলে গেছে। আরেকটি খুলে যাওয়ার পথে। মাঝে মাঝেই হাতে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। অমাবস্যার রাতে ঘুমাতে পারেন না। ডাক্তার বলেছেন, আর কোনো চিকিৎসা নেই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্যথার কষ্ট নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।

বাড়ি ফিরেই মুক্তিযোদ্ধা শহীদের জীবনে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। সেই গল্প শুনি তাঁর জবানিতে:

''স্বাধীনের পর আমগো জমিজমা অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে যায়। তহন বাড়িঘর কিছুই নাই। মাইনসের কাছে হাত পাইতা খাই। আমার স্ত্রী মাইনসের বাড়িত ধান মাড়াইয়ের কাম করত। একদিন দেহি, ওর হাতে বড় বড় ঠোসা পইড়া গেছে। তবুও আমারে বুঝতে দেয় নাই। খুব কষ্ট লাগছিল সেদিন। প্রথম থেকেই ভাতা পাই ৭৫ টাকা। সরকার এহন ছোট্ট একটা ঘর কইরা দিছে। ভাতা যা পাই তা দিয়াই পরিবার চলে।''

যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন সে দেশ কি পেয়েছেন?

প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ অকপটে বলেন:

''অবশ্যই পেয়েছি। রাষ্ট্র পেয়েছি, পেয়েছি স্বাধীন পতাকা। একাত্তরের জয় বাংলা স্লোগান আজ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর সোনার বাংলা এখনও হয়নি।''

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এই বীর যোদ্ধা তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়:

''আমগো দোয়ারাবাজার থানায় ভাতা খাইতাছে ১৩ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে ৬ জনই ভুয়া। খালি কাগজ থাকলেই এহন মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়। কাগজ নেন নাই এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও কম না। মুক্তিযোদ্ধাগো যেমন গুলি লাগছে, রাজাকারগোও গুলি লাগছিল। আজকে ওই রাজাকাররা কোথায়? স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের নয় বরং রাজাকারগো তালিকা করা উচিত ছিল। এই ব্যর্থতা শুধু সরকারের নয় মুক্তিযোদ্ধাগোও।''

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। এরপর সব কিছু বদলে যেতে থাকে। রাজাকারদের বিচারের আইন বাতিল হয়। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জিয়া। স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয় শাহ আজিজের মতো রাজাকার। লাল সবুজের পতাকা ওড়ে রাজাকারদের গাড়িতে। দুঃখ নিয়ে সে সময়কার অনুভূতির কথা বলেন এই বীর যোদ্ধা।

''ওইটা ছিল কলঙ্কিত সময়। সে সময়ের কষ্টের কথা বুঝাইতে পারমু না। ওরা চাইছিল শেখ মুজিবের নাম মুইছা ফেলতে। কিন্তু যার ডাকে দেশ স্বাধীন হইল তারে কি মারা যায়! শেখ মুজিব তো সবার মনের ভেতর বাঁইচা আছে।''

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে অকপটে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বলেন:

''শেখ হাসিনা সরকার না থাকলে এই বিচার হইত না। জাতি হিসাবে আমরাও কলঙ্কমুক্ত হইতে পারতাম না। অনেকরে বলতে শুনি এইটা ভারতের বুদ্ধিতে হইছে। আমি বলি শেখ হাসিনার বুদ্ধি কি কম? রাজাকারগো লাইগা শেখের মাইয়ার ব্রেইনই যথেষ্ট। জামায়াত শিবির হইছে গোখরা সাপ। ওরা চাইব না দেশে শান্তি থাক। দেহেন না একের পর এক গুপ্ত হত্যা হইতেছে। হাসিনা তো দিতে রাজি আছে, খাইতে রাজি না। তাঁর মতো সৎ তো দলের নেতাগো হইতে হইব। তাইলেই দেশ আগাইব।''

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তর তিনি বলেন:

''মানুষ এখন খাবারের কষ্টে মারা যায় না। দেশের উন্নয়ন দেখলে সত্যি ভালো লাগে। নানা বিষয়ে দেশের ছেলেমেয়েদের সফলতার কথা শুনলে গর্বে বুক ভইরা যায়।''

খারাপ লাগে কখন?

''এই যে একের পর এক হত্যা হইতেছে আমরা কী করতে পারতেছি? দেশে আর্মি, র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা আছে। হত্যার আগে কেন তারা ঠেকাইতে পারে না? শরিষার মধ্যে ভুত ঢুইকা বইসা আছে কিনা সেইটাও দেখা দরকার। মানুষও কেমন যেন স্বার্থবাদী হয়া গেছে। একজনরে প্রকাশ্যে হত্যা করা হইতেছে, কিন্তু কেউ আগায়া যায় না। একটা খুনের বিচার হইতে ১০ বছর লাগে। এই ১০ বছরে আরও হাজারটা খুন হয়। বিচার দ্রুত করতে না পারলে কিন্তু দেশ আগাইব না। এই সব দেখলে বাবা খুব খারাপ লাগে।''

এই দেশ একদিন অনেক উন্নত হবে এবং সেটি ঘটবে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ধরেই, এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল শহীদের। তাই বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:

''তোমরা সৎ পথে নিঃস্বার্থভাবে চল। দেশের জন্য যারা রক্ত দিছে তাদের ভুইলা যাইও না। মনে রাখবা ভবিষ্যত বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধে তোমরাই হবা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল শহীদ

ট্রেনিং: ২৭ নম্বর ব্যাচে ২৮ দিনের ট্রেনিং করেন ইকো ওয়ান ক্যাম্প, মেঘালয়ে।

যুদ্ধ করেছেন: ৫ নং সেক্টরের দোয়ারবাজার থানা, টেংরাটিলা, বালিউড়া বাজার, টেবলাই প্রভৃতি এলাকায়।

যুদ্ধাহত: ১৯৭১ সালের নভেম্বরের ২৮ তারিখ। সকাল ৭টার মতো। টেবলাইতে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে তাঁর বাম হাতের কনুইয়ের নিচের হাড় গুঁড়ো হয়ে যায়। চিকিৎসা হলেও হাতটি সারা জীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারায়।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন